× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নির্মলেন্দু গ‍ুণের আনন্দকুসুম

আলফ্রেড খোকন

প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:০৪ পিএম

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:২২ পিএম

নির্মলেন্দু গ‍ুণের আনন্দকুসুম

মাথার ওপর হুলিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েও ভর্তি হতে না-পারা। প্রতিবাদের মিছিলে জড়িয়ে যাওয়া, মানুষের পক্ষে, শ্রমজীবীর পক্ষে, শোষণের বিপক্ষে, নিরন্ন-আর্ত-পীড়িতদের দুয়ারে দাঁড়িয়ে কড়া নেড়ে বলতে পাড়ার এক সংবেদনশীল মন ও মনীষা নিয়ে আমাদের কালের একজন কবি, আজও দাঁড়িয়ে আছেন স্বমহিমায়।

কবি নির্মলেন্দু গ‍ুণের প্রথম লেখা ইংরেজি কবিতার অনুবাদ দিয়েই তাকে আমার এ অর্ঘ্য নিবেদন।

Future

Nirmalendu Goon

1st year I.Sc

Work, work and work-

In our daily life I see,

No leisure, no peace

Men though struggle like a bee,

What is life? What is future?

In this game all shall die must

But fame is the only thing 

Which will ever last

`What will our future be?’

Arise the question in my head

The answer is, to work for country,

And to feed the unfed.

ভবিষ্যৎ

নির্মলেন্দু গ‍ুণ

প্রথম বর্ষ, আইএসসি

কাজ, কাজ এবং কাজেই আছি-

আমাদের প্রতিদিনের জীবনে

কোনো অবসর নেই, নেই শ্রান্তি

মানুষ যেন সংগ্রামরত একটা মৌমাছি

জীবন কী? কী তার অদূর ভবিষ্যৎ?

এ খেলায় সবাই মরে যাবে

কিন্তু একমাত্র খ্যাতির খেলায় কোনো

শেষ নেই পুরে না মনোরথ

মাথায় কেবলি প্রশ্ন ভিড় করে

কী হবে আমাদের ভবিষ্যৎ?

উত্তর আসে-

বুভুক্ষের মুখে অন্ন তুলে দাও

কাজ করে যাও, স্বদেশের তরে

কাজ, কাজ এবং কাজ, কবি নির্মলেন্দু গ‍ুণের এত কাজ! আইএসসি ক্লাসের এক তরুণ ইংরেজিতে এই কবিতা লিখেছিল ১৯৬২ সালে আনন্দমোহন কলেজ ম্যাগাজিনে। তখন আমার জন্মই হয়নি। তারপর তার কত ইতিহাস, আমি তার কোনটা বলব!

মাথার ওপর হুলিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েও ভর্তি হতে না-পারা। প্রতিবাদের মিছিলে জড়িয়ে যাওয়া, মানুষের পক্ষে, শ্রমজীবীর পক্ষে, শোষণের বিপক্ষে, নিরন্ন-আর্ত-পীড়িতদের দুয়ারে দাঁড়িয়ে কড়া নেড়ে বলতে পাড়ার এক সংবেদনশীল মন ও মনীষা নিয়ে আমাদের কালের একজন কবি, আজও দাঁড়িয়ে আছেন স্বমহিমায়। আজ তার কবিতা নিয়ে আমি কিছু লিখব না। কারণ কবিতা নিয়ে লেখার চেয়ে জীবনানন্দের সমারূঢ় কবিতার মতো বলা যেতে পারে ’বরং তুমি নিজেই লিখোনাকো একটি কবিতা।’ তাই হুলিয়া কবিতার অংশবিশেষ-

আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলাম তখন দুপুর

আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ

শোঁ শোঁ করছে হাওয়া।

আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন

একটি রেখায় দাঁড়িয়েছে।

কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,

ট্রেনে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে

একজনের কাছ থেকে আগুন চেয়ে নিয়েছিলুম

মহকুমা স্টেশনে উঠেই একজন 

আমাকে জাপটে ধরতে চেয়েছিল

কেউ চিনতে পারেনি আমাকে, একজন রাজনৈতিক নেতা

দূর থেকে বারবার চেয়ে দেখলেন, কিন্তু চিনতে পারলেন না

বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি

অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি দিতে এসেও

রফিজ আমাকে চিনল না।

আমি বাড়ির পেছন থেকে দরজায় টোকা দিয়ে

ডাকলুম মা

বহুদিন যে দরজায় কোনো কণ্ঠস্বর ছিল না

মরচে পড়া সেই দরজা মুহূর্তেই ক্যাচক্যাচ

শব্দ করে খুলে গেল। 

বহুদিন চেষ্টা করেও গোয়েন্দা বিভাগ 

আমাকে ধরতে পারেনি।

চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভেতরে

সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে

একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম।

খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসীন

তিন মাইল বৃষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য।

রাত্রে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে 

আমতলা থেকে আসবে আব্বাস।

ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর

আমাদের ভবিষ্যৎ কী?

আয়ুব খান এখন কোথায়?

শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?

আমার নামে কতদিন আর এরকম হুলিয়া ঝুলবে?

(১৯৭০ সালে রচিত ‘হুলিয়া’ কবিতার অংশবিশেষ)

কবিতাটি উদ্ধৃত করা এজন্য যে, এ কবিতায় যেমন ধরা পড়েছে কবির উত্তাল যৌবনের দিন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের এক বছর আগে এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তবতা। হুলিয়া নিয়ে ছদ্মবেশে নিজেকে চালিয়ে চলার দিন। আর তো রয়েছেই তার দেখার গভীরতম চোখ। তার বহুদিনের পরিচিত সহচর, স্বজনেরা অনেকেই তাকে চিনতে পারল না, সেখানে একমাত্র মা শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ছেলের কণ্ঠস্বর যিনি বুঝতে পারেন, তিনিই তো একমাত্র মা। এবং মুহূর্তেই খুলে দেন বন্ধ ঘরের দরজা। তিনি একাধারে মা এবং মাতৃভূমি। আর ‘চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে,/অফুরন্ত হাওয়ার ভেতরে/সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে/একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম’।

আমার মনে হয় প্রকৃতি তার নিজস্ব প্রয়োজনে কিছু মানুষের জন্ম দেয়, যাকে অন্যদের প্রয়োজনে দরকার হয়। সেই প্রয়োজন কেমন? কেউ একজন ফড়িং হতে চাইলে অনেকেই তার পাখা ভেঙে দিতে যাবে। কিন্তু প্রকৃতির নিজস্ব প্রয়োজনে জন্ম দেওয়া এই মানুষ, তাকে কাছে এনে বাহুর সমীপে রেখে বলবে, তোর পাখা ভেঙেছে, তাতে কী হয়েছে? চল্ পঙ্গু হাসপাতালে তোকে নিয়ে যাই। ওখানে আমার কবিতা পড়ার নার্স আছে, ডাক্তারও আছে, তাদের কাছে গিয়ে তোকে আগে ডানা জোড়া লাগাই। তারপর তুই জোড়া দেওয়া ডানায় ভর করে উড়বি, ওড়ার কোনো শেষ নেই। তুই উড়তে যেহেতু চেয়েছিস, ওড়া তোর থামবে না।

আমি রবীন্দ্রনাথকে দেখিনি, নজরুল কিংবা সুকান্তকেও। দেখিনি আরও কত দেশ-বিদেশের মন ও মনীষাকে। কিন্তু আমার সৌভাগ্য আমি নির্মলেন্দু গ‍ুণকে দেখেছি। তার একটা কবিতার বই আছে, ২০০০ সালে প্রকাশ পেয়েছিল। আমি সময়কে জন্মাতে দেখেছি। যদিও এই বই নিয়ে তৎকালীন ভোরের কাগজে আমি সমালোচনা লিখেছিলাম‘আমি সময়কে জন্মাতে দেখেছি, সময় উত্তীর্ণ নয়’। এরপর অনেক দিন ভেবেছি, বড়রও আছে কিছু ছোট ছোট ক্ষুদ্রতা, সেসব ক্ষুদ্রতাকে দিয়ে বৃহৎ ম্লান করা যায় না। কারণ প্রত্যেক স্রষ্টাই তো মানুষ, মানুষের কিছু সংকীর্ণতা থাকবে। একজন মানুষ নিরঙ্কুশ মানুষ হলে মানুষ থাকে না, অন্য কেউ হয়ে যায়। 

কবি নির্মলেন্দু গ‍ুণ আমার সময়ের এমন একজন মানুষ, একদিন যাকে মাথার ওপর হুলিয়া নিয়ে লুকিয়ে চলতে হয়েছে, আজ আর লুকানোর কিছু সে গোপন রাখেনি। গণিকালয় থেকে মন্দিরসর্বত্রই গমন করা এমন একজন মানুষ, যে অপ্রকাশের ভার ব্যক্ত করে যাচ্ছে একটা জীবনব্যাপী। 

আর এ কথা তো অবশ্যই বলা যায় যে, কবি বা স্রষ্টা বলে আমরা তাকে নিয়ে এই আলোচনায় মাতি। এবার তার একটি সৃষ্টিকর্মের তালিকা সাজাই। কবিতা, গদ্য, গল্প, ভ্রমণকাহিনি, খেলা, গান লিখেছেন, বিজ্ঞাপন হয়েছেন। চিত্রনাট্য, পেইন্টিং, অভিনয়, সবই তো করেছেন। পত্রিকার সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। বিবাহ করেছেন, বিবাহবিচ্ছেদও করেছেন। এই সেই কবি তিনি কি না করেছেন! থানায় পুলিশের কাছে গিয়ে নিরপরাধ অভিযুক্তকে ছাড়িয়ে এনেছেন রাত-বিরাতে। এতিমকে খাদ্য দিয়েছেন, দিয়েছেন পিতৃস্নেহ। ঘরহীনকে ঘর দিয়েছেন। অবলম্বনহীনকে দিয়েছেন অবলম্বনও!

তার রয়েছে এত দারুণ রসবোধ। এটা না বললেই নয়। একবার শাহবাগে সাহিদুল ইসলাম বিজুর পাঠক সমাবেশের সামনে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছেন কবি। তার পেছনে একটি মেয়ে। আমি সেই মেয়েটির পেছনে। আমার সামনের মেয়েটি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যখন দেখলেন কবি কথায় মশগুল তার সামনের জনের সঙ্গে, তখন মেয়েটি বলল, ‘দাদা সালাম, পেছন থেকেই দিলাম। কবি ঘুরে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার দুদিক থেকেই চলে।’ এই দৃশ্য আমি দেখেছিলাম। আর ভেবেছিলাম একজন মানুষ, একজন কবি কতটা মননশীল হলে, কতটা রসিক হলে এই ধরনের উত্তর দিতে পারেন! এই পক্ষে, এ কথা বলে রাখলাম যে, রসবোধ তার আরেকটি অসাধারণ গুণ। 

আমাদের হীনম্মন্যতা এমন যে, বেলির সুগন্ধ নিয়ে প্রশ্ন করলে যদি নয়নতারা অসন্তুষ্ট হয়, সেজন্য উভয়ের প্রশ্নে নিজেকে গুটায়ে রাখি। আরে বাবা সূর্য তো সূর্যই। চন্দ্র তো চন্দ্রই। চন্দ্রকে আলো ধার করতে হয় সূর্য থেকে, এই সাধারণ ধারণা নিয়ে চন্দ্র-সূর্য কারুরই প্রশংসা করতে দ্বিধান্বিত হই কেন! এর নাম সংকীর্ণতা। মরে গেলে, সে বড় ভালো লোক ছিল। মরে গেলে, সে বড় কবি ছিল। মরে গেলে তাঁর ছবি বড় করে ছাপা হবে পত্রিকার রঙিন পৃষ্ঠায়। বেঁচে থাকতে কেন হয় না! এইসব বেদনা আমরা কেন পুষে রাখিআমার জানাই হয় না। তবে কবি নির্মলেন্দু গ‍ুণ এখানেও ব্যতিক্রম। জীবিতকালেই তিনি মুদ্রিত হয়েছেন নানা রঙে, নানা বর্ণে।

এটা ঠিক যে, কোথাও না কোথাও থামতে হয়। গ‍ুণ যদি আরও আগে লেখা থামাতেন, তবুও তিনি বিস্ময়কর নির্মলেন্দু গ‍ুণই হয়ে থাকতেন। কিন্তু ওই যে আজ তার ইংরেজি কবিতাটি অনুবাদ করলাম, এর কারণকাজ, কাজ এবং কাজ। কাজই একমাত্র মরণশীল এই পৃথিবীতে কিছুকাল মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। 

১৯৭০-এ প্রেমাংশুর রক্ত চাই দিয়ে শুরু করা একজন কবি আজও ২০২২-এ লিখে যাচ্ছেন, তাতে ব্যর্থতাও যে কিছু নেই তা তো নয়। কারণ অধিক লেখার ছলে কিছু দুর্বল পদও রচিত হতে পারে। যা না লিখলে তার এমন কোনো ক্ষতি হতো না। যদিও এখানেও তাকে ম্লান হয়তো করা যাচ্ছে না। কারণ, এর চেয়ে আরও অচল পদ্য রচয়িতা তো এখনও ঢের রচনা করে চলেছেন। হয়তো তিনি বেঁচে থাকার আনন্দ নিয়ে অনবরত লিখে যাচ্ছেন। এজন্য সমালোচনাও তার গা ঘেঁষে বসতে পারে  না। বেঁচে থাকার আনন্দে তো আমরা অনেক কিছুই করি। তার সবই কি মাত্রা পায়? পায় না। ফলে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি‘যে আমারে দেখিবারে পায়, অসীম ক্ষমায়, ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি’।

তবে পুরস্কার প্রসঙ্গে তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড কিছুটা বিস্মিত করে! সব পুরস্কার কি পেতেই হবে? চেয়ে পেতে হবে কেন পুরস্কার? পুরস্কারের সঙ্গে এখন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে তিরস্কার। এই তিরস্কার কেন তাকে গ্রহণ করতে হবে? যদিও ওই পুরস্কার পাওয়ার জন্য এমনিতেই তিনি যোগ্য। এই না মেলাটুকু বাদ দিলে হয়তো তিনি নিরঙ্কুশভাবে হতে পারতেন অনন্য। নিরঙ্কুশভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সৃজনশীলকে দেখতে চায় পাঠক, দেখতে চায় সাধারণজন, আমিও। অবশ্য কবির অভিপ্রায় বুঝতে পারার সরল সমীকরণ এভাবে হয়তো সম্ভব নয়। যখন যোগ্যতমের স্থান সমাজে সর্বত্র যথাযথ হয় না, তখন এটা তার প্রতিবাদের অংশও হতে পারে।

১৯৮৪ সালে আমি তার ’ক্ষেতমজুরের কাব্য’ পড়েছিলাম। এই পদ্যের কাছে আমি আজও স্তব্ধ হয়ে নুইয়ে পড়ি। পদ্যটি ছিল এমন-

মুগর উঠছে মুগর নামছে

ভাঙছে মাটির ঢেলা,

আকাশে মেঘের সাথে সূর্যের

জমেছে মধুর খেলা।

ভাঙতে ভাঙতে বিজন মাঠের

কুয়াশা গিয়েছে কেটে,

কখন শুকনো মাটির তৃষ্ণা

শিশির খেয়েছে চেটে।

অতটা খেয়াল রাখেনি কৃষক,

মগ্ন ছিল সে কাজে।

হঠাৎ পুলক পবনও হৃদয়

পুষ্পিত হলো লাজে।

ফিরিয়া দেখিল বঁধুটি তাহার

পিছনে আলের পরে

বসে আসে যেন, ফুটে আছে ফুল,

গোপনে চুপটি করে।

সামনে মাটির লাল সানকীটি

জ্বরীর আঁচলে বাঁধা,

আজ নিশ্চয় মরিছে রসুনে

বেগুন হয়েছে রাঁধা।

হাসিয়া কৃষক মরাল বাঁশের

মোগর ফেলিয়া দিয়া

কামুক আঁখির নিবিড় বাঁধনে

বাঁধিল বঁধুর হিয়া।

বরুণ গাছের তরুণ ছায়ায়

দুজনে সারিল ভোজ,

বঁধুর ভিতরে কৃষক তখন

পাইল মনের খোঁজ।

মেঘ দিল ছায়া, বনও সঙ্গমে

পুড়িল বঁধুর আশা; 

মনে যাই থাক, মুখে সে বলিলঃ

‘মর্গে’ বর্গা চাষা।

শব্দটি তাঁর বক্ষে বিঁধিল

ঠিক বর্ষার মতো,

এই জমিটুকু আমার হইলে

কার কিবা ক্ষতি হতো।

কাতর কণ্ঠে বঁধুটি সুধালোঃ

আচ্ছা ফুলির বাপ,

আমাগো একটু জমিন অবে না?

জমিন চাওয়া কি পাপ?

খোদার জমিন ধনীর দখলে,

গেছে আইনের জোরে,

আমাগো জমিন অইব যেদিন

আইনের চাকা ঘোরে।

অসহায় বঁধু জানে না নিয়ম

কানুন কাহারে বলে;

স্বামীর কথায় আঁখি দুটি তাঁর

সূর্যের মতো জ্বলে।

বলদে ঘোরায় গাড়ির চাক্কা,

নাড়ীর চাক্কা স্বামী;-

আইনের চাক্কা আমারে দেখাও

সে-চাক্কা ঘুরামু আমি।

কৃষক তখন রুদ্র বঁধুর

জড়ায়ে চরণ দুটি,

পা তো নয় যেন অন্ধের হাঁতে

লঙরখানার রুটি।

যতটা আঘাত সয়ে মৃত্তিকা

উর্বর হয় ঘায়ে

ততটা আঘাত সইল না তার

বঁধুর কোমল পায়ে।

পা দুটি সরায়ে বঁধুটি কহিলঃ

কর কি? কর কি? ছাড়ো,

আরে মানুষে দেখলে জমিন তো দিবে না,

দুর্নাম দিবে আরও।

পরম সোহাগে কৃষক তখন

বঁধুর অধর চুমী!

হাসিয়া কহিলঃ ভূমিহীন কই?

আমার জমিন তুমি।

আকাশে তখনও সূর্যের সাথে

মেঘেরা করিছে খেলা,

মুগর উঠছে মুগর নামছে

ভাঙছে মাটির ঢেলা।

( ক্ষেত মজুরের কাব্য)

ইয়েস, এ কবিতা লিখেছিলেন পয়েট নির্মলেন্দু গ‍ুণ।

আমি যেহেতু কৃষকের পুত্র, তাই জানি মধ্যদুপুরে জমির আলে হিজল গাছের ছায়ায় মা যখন বাবার জন্য খাবার দিতে যেত, তখন যে আলিঙ্গন আমিও দেখেছিলাম, সে দেখা প্রেম আমার প্রিয়তম। এই প্রেম বাংলা কবিতায় একজনই বর্ণনা করতে পেরেছেন, তার নাম কবি নির্মলেন্দু গ‍ুণ। ফলে নির্মলেন্দু গ‍ুণ, পদ্য বা অচল পদ্য যা রচিততা সবই আনন্দ কুসুমে সুবাসিত।

ডিমের ভেতর কুসুমের আনন্দ হচ্ছে আরেকটি নতুন জন্ম। কিন্তু সব কুসুম নতুন জন্ম দিতে পারে না। কিছু কুসুম জন্মের মধ্যেই মরে যায়।কিছু কুসুম অন্য প্রাণী খেয়েও ফেলে। আবার যেমন মানবের সব ভ্রূণ জন্ম হয় না। একজন কবির সব পঙ্‌ক্তিও কবিতা হয় না। যা হয়, তা নিয়েই আমরা কেন গর্ব করি না! আমার দেখা একজন অগ্রজ কবি নির্মলেন্দু গ‍ুণ তারও অনেক ভ্রূণ জন্ম নেয়নি। কিন্তু যা জন্ম নিয়েছে, তাতে ফলে গেছে বাংলার প্রান্তর। তার প্রসঙ্গে দৈনিকের খাতায় এত অল্পতে সমীকরণ করা অবান্তর। সমকালীন বাংলা ভাষার ব্যাপক জনপ্রিয় এই কবিকে অভিবাদন।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা