প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৪ ১১:৪০ এএম
আপডেট : ২০ মে ২০২৪ ২০:৪১ পিএম
টিআইবির সংবাদ সম্মেলন। ছবি : সংগৃহীত
উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হয়ে সম্পদ অর্জন এবং তা বৃদ্ধি করা প্রার্থীদের মূল লক্ষ্য। উপজেলা পরিষদের ষষ্ঠ সাধারণ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এ নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে অর্থসম্পদ বিকাশের সুবিধাজনক সুযোগের কারণে জনপ্রতিনিধি হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে।
প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে টিআইবি জানায়, গত পাঁচ বছরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচিত হননি এমন প্রার্থীদের তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আয় ও সম্পদ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে দ্রুত আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যারা পদে ছিলেন এমন প্রার্থীদের গত দশ বছরের হিসাব তুলনা করলে দেখা যায়, পদে থাকা প্রার্থীদের আয় ও অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে যথাক্রমে ৫৪০ দশমিক ৬৮ শতাংশ ও ২১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে পদে না থাকাদের আয় ৫৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ বাড়লেও সম্পদ কমেছে ৪৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এর আগে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রায় একই রকম চিত্র পেয়েছিল টিআইবি।
দ্বিতীয় ধাপের বিশ্লেষণে দেখা যায়, যারা পদে ছিলেন পাঁচ বছরে তাদের আয় বেড়েছে ১৪০ দশমিক ৬১ শতাংশ, অন্যদিকে যারা পদে ছিলেন না তাদের আয় বেড়েছে ৭৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। একইভাবে এ সময়ে পদে থাকা প্রার্থীদের অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ২৩১ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং যারা পদে ছিলেন না, তাদের বেড়েছে ১০০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এক্ষেত্রে শুধু নির্বাচিতদের নিজেদেরই নয়, স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের আয় ও সম্পদ বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়ের মতোই ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য প্রায় একচ্ছত্র। একদলীয় আধিপত্যের বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। বাড়ছে স্থানীয় পর্যায়ে পরিবারতন্ত্র।’
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, যারা আগে থেকেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন তাদের আয়-সম্পদ বৃদ্ধি যারা জনপ্রতিনিধি ছিলেন না তাদের থেকে বহু গুণ বেশি। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, কেন জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় নির্বাচিত হওয়ার মূল আগ্রহের জায়গা অনেক ক্ষেত্রেই জনগণের কল্যাণ থেকে সরে গিয়ে নিজের সম্পদ বৃদ্ধিতে স্থির হয়েছে।’
নির্বাচনে জনস্বার্থের পাশাপাশি দলীয় আদর্শ কিংবা দলীয় শৃঙ্খলার বিষয়গুলো উপেক্ষিত উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘এই নির্বাচনের লড়াই একদিকে যেমন অসুস্থ, অগণতান্ত্রিক, আত্মকেন্দ্রিকÑ অন্যদিকে জনগণ বা জনকল্যাণের সঙ্গে এর সম্পর্ক ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।’
হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা যায়, দ্বিতীয় ধাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৭০ দশমিক ৫১ শতাংশই ব্যবসায়ী। ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ, নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৯ দশমিক ২৬ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৫১ দশমিক ৬৩ শতাংশই নিজেকে গৃহিণী হিসেবে উল্লেখ করেছেন অথবা গৃহস্থালির কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে গৃহিণী-গৃহস্থালিকে পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে।
বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, সার্বিকভাবে প্রার্থীদের ৪২ শতাংশই আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ প্রার্থী। চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রার্থীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য আয় বৈষম্য লক্ষ করা গেছে। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২১ শতাংশ প্রার্থীদের আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, যেখানে অন্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে তা ৫৩ শতাংশ। একইভাবে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশের আয় সাড়ে ষোলো লাখ টাকার ওপরে। অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে তা মাত্র ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ চেয়ারম্যান পদে অপেক্ষাকৃত ধনীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তা ছাড়া সার্বিকভাবে দ্বিতীয় ধাপের প্রার্থীদের মধ্যে ১১৬ জনের ১ কোটি টাকা বা তার বেশি সম্পদ রয়েছে। কোটিপতির সংখ্যা আগের নির্বাচনের তুলনায় হয়েছে তিন গুণের বেশি।
দ্বিতীয় ধাপের প্রার্থীদের হলফনামার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পাঁচ বছরে একজন প্রার্থীর আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৯০০ শতাংশ, অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ। দশ বছরে একজন প্রার্থীর আয় বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৩৩৬ শতাংশ। পাঁচ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা পেছনে ফেলেছেন সংসদ সদস্যদের। সংসদ নির্বাচনে একজন সংসদ সদস্যের সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, সেখানে একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর সম্পদ বেড়েছে ১১ হাজার শতাংশের বেশি। তা ছাড়া আইনি সীমা বা ১০০ বিঘা বা ৩৩ একরের বেশি জমি আছে ৪ জন প্রার্থীর।
অস্থাবর সম্পদের শীর্ষে সেনবাগের জাহাঙ্গীর
প্রার্থীদের মধ্যে অস্থাবর সম্পদের তালিকার শীর্ষে আছেন নোয়াখালীর সেনবাগের চেয়ারম্যান প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। তার মোট অস্থাবর সম্পদের মূল্য ৮৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। তালিকার ২ নম্বরে আছেন ঢাকার ধামরাইয়ের সুধীর চৌধুরী, তার সম্পদ ৩৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। তৃতীয় অবস্থানে আছেন মোহাম্মদ ইদ্রিস ফরাজী, তার অস্থাবর সম্পদমূল্য ২২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
আইনি সীমার বেশি জমি ৪ প্রার্থীর
জমির মালিকানার দিক দিয়ে আইনি সীমা অতিক্রম করেছেন চারজন প্রার্থী। আইন অনুযায়ী, একজন নাগরিক সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর জমির মালিক হতে পারেন। এই তালিকার শীর্ষে আছেন শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী এস এম আমিনুল ইসলাম। তার মোট জমির পরিমাণ ৫৪ দশমিক ৬ একর। চার নম্বরে থাকা শিবালয়ের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আবদুর রহিম খানের রয়েছে ৩৪ দশমিক ২৯ একর জমি।
বেশি আয় বেড়েছে সোনালী খাতুনের
২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় আয় বৃদ্ধির দিক দিয়ে সবার ওপরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সোনালী খাতুন। তার আয় বেড়েছে ১০ হাজার ৯০০ শতাংশ। ২০০০ শতাংশের বেশি আয় বেড়েছে আরও সাত প্রার্থীর। তাদের তিনজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও দুজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী।
বেশি অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে আরিফুরের
অস্থাবর সম্পদের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ঝালকাঠি সদরের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী খান আরিফুর রহমানের। তার সম্পদ বেড়েছে ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ। ২০০০ শতাংশের বেশি অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে আরও ৯ জন চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সহ-সমন্বয়ক ইকরামুল হক ইভান। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক ও গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা- নির্বাহী ব্যবস্থাপনা ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা দলের সদস্য ও আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সহ-সমন্বয়ক রিফাত রহমান ও কে. এম. রফিকুল আলম।