সুন্দরবনে আগুন
আমিনুল ইসলাম মিঠু
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৪ ০০:৪৪ এএম
আপডেট : ০৬ মে ২০২৪ ১৩:১১ পিএম
সুন্দরবনে আগুন নেভাতে বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার দিয়ে পানি ফেলা হচ্ছে। ছবি: বিমান বাহিনীর সৌজন্যে
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলায় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের আওতাধীন চাঁদপাই রেঞ্জের বনে প্রায়ই বাঘ বিচরণ করে। আর এই বনেই গত শনিবার দুপুরে আগুনের সূত্রপাত হয়ে রবিবার (৫ মে) সাড়ে ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জ্বলছে। এতে বন ও বন্য প্রাণীর কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনও অজানা। তবে বন ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের এই অংশটি উঁচু হওয়াতে সেখানে অজগরের আবাসস্থল রয়েছে। এ ছাড়া হরিণ, বানর, শূকর, বাদুড়সহ নানা প্রজাতির প্রাণীর বিচরণ তো রয়েছেই। ফলে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারা এবং তাদের আবাসস্থল। তবে আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দ্রুত চলাফেরা করতে না পারা প্রাণী, পতঙ্গ এবং বিশেষ করে অজগর।
অন্যদিকে বাঘ গবেষকরা বলছেন, বাঘেরা আগুন ও শব্দকে বেশি ভয় পেয়ে থাকে। তাই সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া ক্যাম্পের বনাঞ্চলের আগুনে বেশি প্রভাব পড়বে বাঘের ওপর। কারণ টেরিটোরিয়াল প্রাণী হওয়াতে বাঘেরা সহসা অন্য এলাকায় গিয়ে থিতু হতে পারবে না। অন্যদিকে আগুন বেশিদূর না গড়ালেও বাঘের শিকার প্রাণীরা আগুনের কারণে এই এলাকা ছেড়ে চলে গেলে খাদ্য সংকটে পড়তে পারে বাংলার বাঘেরা। এ ছাড়া বনের বাঘের বিচরণক্ষেত্রে আগুন লাগার নেপথ্যে বাঘ শিকারিদের যোগাসাজশ রয়েছে কি নাÑ তাও খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন সুন্দরবনের বাঘ গবেষকরা।
সুন্দরবনের বাঘ, হরিণসহ বন্য প্রাণী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এমএ আজিজ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, যে জায়গায় আগুন লেগেছে এলাকাটি উঁচু, বর্ষার জোয়ার ছাড়া এখানে পানি ওঠে না। আর সারা বছর এলাকাটি শুষ্ক ছিল। যে তাপপ্রবাহ চলছে এতে এই এলাকা এমনিতেই তীব্র তাপের প্রভাবে ছিল। তার ওপর এই আগুন বন ও বন্য প্রাণীর ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। তিনি মনে করেন, সুন্দরবনের যারা বনজীবী তারা ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগাতে পারে না। তবে কিছু দুষ্কৃতকারী যারা ভেতরের জলাশয়ে মাছ ধরে তাদের যোগসাজশ থাকতে পারে। এই আগুনের কারণে বড় প্রভাব পড়তে পারে অজগরের ওপর। কারণ এই প্রাণীটি ধীরে চলে। এ ছাড়া কীটপতঙ্গ এবং ক্ষুদ্র প্রাণী যারা দ্রুত চলাফেরা করতে পারে না তারা ক্ষতির মুখে পড়বে। বাঘ, শূকর, হরিণ তারা দ্রুত সরে যেতে পারে; তাই তাদের ক্ষতির সম্ভাবনা কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ফিরোজ জামান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনে সাধারণত আগুন লাগার সুযোগ কম। কারণ সারা বছর এতে পানি থাকে। এই বনে ঝরা পাতা কম থাকে । আর এখানকার ফরেস্ট ট্রিতেও আগুন ধরে না। কোনো দুষ্কৃতকারী এটি করেছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার। অনেক সময় মাছ ধরা বা মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বনে ধূমপান করে সেখান থেকেও আগুন লাগতে পারে। তবে যে বিষয়টি ভাবাচ্ছে সেটি হলোÑ বাঘ আগুন ও শব্দ এই দুটিকেই বেশি ভয় পায়। তাই বাঘকে বনের ওই এলাকা থেকে সরিয়ে দিতেও কেউ আগুন লাগাতে পারে।
তিনি বলেন, বন বিভাগকে আরও সতর্ক হতে হবে। পাহারা জোরদার করতে হবে। ম্যানগ্রোভ বন না থাকলে ঝড়-ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যাবে। কত এলাকায় আগুন ছড়িয়েছে তা দেখতে হবে। আগুনের কারণে সুন্দরী, কেওয়ার মতো গাছ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
তিনি বলেন, বাঘেরা নির্দিষ্ট এলাকায় বিচরণ করে থাকে। এই এলাকায় যে বাঘগুলো ছিল সেগুলো এখন বনের অন্য পাশে চলে যেতে বাধ্য হবে। এতে খাদ্য শিকারে তারা সমস্যায় পড়তে পারে। কারণ বাঘের শিকার প্রাণী হরিণ, শূকর, শজারুসহ বিভিন্ন ছোট-বড় প্রাণী এই এলাকা থেকে সরে যেতে পারে। যেহেতু বনের ওই এলাকায় একটি দুর্যোগ ঘটেছে, তাই সহসা এই এলাকায় ফিরে আসতে চাইবে না বাঘ, হরিণসহ বন্য প্রাণীরা। শিকারি প্রাণী কমে গেলে বাঘের খাদ্যের অভাব হবে। আর বাঘেরা বেশি দিন ক্ষুধার্ত থাকলে লোকালয়েও তাদের শিকার খুঁজতে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন গবেষক মনিরুল হাসান খান বলেন, যতদিন আগুনের ক্ষয়ক্ষতি থাকবে ততদিন আগুন লাগা বনে বন্য প্রাণীর আনাগোনা থাকবে না। তবে শোনা যায়, বিভিন্ন কারণে ইচ্ছে করেই আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। যেসব প্রাণী চলাচল করতে পারে তারা দ্রুত সরে গিয়ে রক্ষা পেতে পারে। তবে উদ্ভিদসহ নিম্ন শ্রেণির যে প্রাণীগুলো রয়েছে; যেমন- পোকামাকড়, শামুক, সরীসৃপ ইত্যাদি প্রাণী এ ধরনের আগুনে বেশিই মারা পড়ে। এ ছাড়া আগুনের ঘটনা থেকে বন ও বন্য প্রাণীকে রক্ষায় ম্যানগ্রোভকে আবারও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।
এদিকে সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক নাগরিক সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা-(ধরা)’ এবং ‘সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’। ধরার সদস্য সচিব শরীফ জামিল এবং ‘সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’-এর সমন্বয়ক নূর আলম শেখ এই যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন।
শরীফ জামিল বলেন, প্রতি বছরই এই সময়ে সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ড হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন চক্র রয়েছে যারা এই ধরনের অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে। আমরা মনে করি, সুন্দরবনের এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে বন বিভাগকে আরও সচেষ্ট হতে হবে।
নূর আলম শেখ বলেন, মানবসৃষ্ট সুন্দরবনের পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড বন্ধে বনবিভাগসহ সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। সুন্দরবন সংরক্ষিত বনাঞ্চল হলেও আমরবুনিয়া টহল ফাঁড়ি অঞ্চলে চোরা শিকারিসহ মানুষের অবাধ যাতায়াত রয়েছে। পরিবেশকর্মী, সংবাদকর্মী, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা এবং অতীতে সংগঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করার কারণেই সুন্দরবনের আমরবুনিয়া এলাকায় চার বছর পরে আবারও অগ্নিকাণ্ড সংগঠিত হলো।