ভূমধ্যসাগরে নিহত ৮ বাংলাদেশি
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০২ মে ২০২৪ ১৯:৪৬ পিএম
আপডেট : ০২ মে ২০২৪ ২০:৪৩ পিএম
লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে মারা যাওয়া আট বাংলাদেশির মরদেহ দেশে ফিরেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিউনিসিয়া থেকে উড়োজাহাজে করে তাদের মরদেহ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনা হয়।
‘জমিজমা বিক্রি করে ও সুদে ঋণ নিয়ে দালালদের ৮ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। তারা বলেছিল, কায়সারকে লিবিয়া থেকে জাহাজে করে ইতালি পৌঁছে দিবে। তার আর ইতালি যাওয়া হলো না। নৌকার তলায় রাখায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেল কায়সার। এখন তার লাশ পেলাম। কিন্তু সেটাও এখন বাড়িতে নিতে পারছি না।’
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ক্ষোভ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কবিরাজপুরের কায়সারের ভগ্নিপতি শাওন ফকির।
লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে মারা যাওয়া আট বাংলাদেশির মরদেহ দেশে ফিরেছে। বৃহস্পতিবার (২ মে) দুপুরে তিউনিসিয়া থেকে উড়োজাহাজে করে তাদের মরদেহ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনা হয়। মৃতদের একজন কায়সার।
এ সময় বিমানবন্দরে কান্নায় ভেঙে পড়েন আগে থেকেই মরদেহের অপেক্ষায় থাকা নিহত ব্যক্তিদের স্বজনরা। তারা সকাল থেকে মরদেহের জন্য বসে ছিলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও বিমানবন্দর থানা পুলিশ মরদেহ হস্তান্তর না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন স্বজনরা।
পুলিশ বলছে, ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ হস্তান্তর করা হবে না। আজ সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ফলে মরদেহ বুঝে পেতে শুক্রবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে স্বজনদের।
১৫ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার পথে তিউনিসিয়া উপকূলে অন্তত নয়জন অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা যান। তাদের আটজনই বাংলাদেশি। অপর নিহত পাকিস্তানি।
নিহত বাংলাদেশিরা হলেন- মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ির নয়ন বিশ্বাস, খালিয়ার মামুন শেখ ও সজল, বাজিতপুর নতুনবাজারের কাজি সজীব ও কবিরাজপুরের কায়সার, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাগদীর রিফাত, দিগনগরের রাসেল এবং গঙ্গারামপুর গোহালার ইমরুল কায়েস ওরফে আপন।
নৌকার পাটাতনের নিচে অক্সিজেন সংকটে মারা যান ৮ বাংলাদেশি
বিমানবন্দরে মরদেহের অপেক্ষায় থাকা নিহত ব্যক্তিদের স্বজনরা বলছেন, ৩০ জন যেতে পারবেন এমন একটি ছোট নৌকায় ৫২ জন তুলেছিল দালালরা। যে আটজন মারা গেছেন, তাদের নৌকার পাটাতনের নিচে জোর করে রাখা হয়েছিল। তারা অক্সিজেন সংকটের কারণে পাটাতন থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু দালালরা মারধর করে আবার তাদের সেখানে পাঠান। এভাবে নির্যাতন ও অক্সিজেন সংকটে দমবন্ধ হয়ে মারা যান ইতালি যেতে ইচ্ছুক আটজন।
নিহত কায়সারের ভগ্নিপতি শাওন ফকির বলেন, ‘লিবিয়া থেকে ইতালি নেওয়ার সময় দালালরা কায়সারসহ আটজনকে নৌকার পাটাতনের নিচে রাখে। সেখানে অক্সিজেন সংকটে দমবন্ধ হয়ে মারা যায় তারা। কায়সারের ছোট দুটি মেয়ে আছে। বাবাকে ছাড়া কীভাবে দুটি মেয়ে মানুষ হবে?’
এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি হত্যা ও একটি মানব পাচার আইনে মামলা হয়েছে। মামলার তদন্তের স্বার্থে মরদেহ হস্তান্তরের আগে ময়নাতদন্ত করা হবে বলে জানায় বিমানবন্দর থানা পুলিশ। এ ঘোষণায় উত্তেজিত হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নিহতদের স্বজনরা। তাদের দাবি, ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করতে হবে।
গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার নিহত রিফাতের মামা রনি বলেন, ‘ভাই আমার ভাগ্নে মরেও ওরা শান্তি পাচ্ছে না। সেই দুপুরে লাশ এসেছে। এখন পুলিশ লাশ হস্তান্তরে টালবাহানা করছে। তারা বলছে ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দিবে না। এখন আমরা কী করব বলেন। কতক্ষণ অপেক্ষা করব। আজ (বৃহস্পতিবার) ময়নাতদন্ত হবে না। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত লাশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিমানবন্দর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মরদেহের সুরতহাল করা হবে। মরদেহের সঙ্গে যদি এমন কোনো ডকুমেন্টস থাকে যে, তাদের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে; তাহলে আমরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ হস্তান্তর করব। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত কোনো নথি পাইনি। তাই ময়নাতদন্ত করে মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হবে। বৃহস্পতিবার আর ময়নাতদন্ত সম্ভব নয়। শুক্রবার ময়নাতদন্ত করে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।’
জানা গেছে, ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে ১৫ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে নৌকাযোগে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ওই নৌকায় প্রায় ৫২ অভিবাসনপ্রত্যাশীসহ ৫৩ জন ছিলেন। আগের দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি অভিবাসী দলটি নৌকায় করে স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১১টায় লিবিয়ার জোয়ারা উপকূল থেকে ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। যাত্রাপথে নৌকাটি তিউনিসিয়া উপকূলে গেলে রাত সাড়ে ৪টার দিকে নৌকাটি ডুবে যায়। তাদের মধ্যে ৪৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ২৭ জন বাংলাদেশি। অন্যান্যদের মধ্যে পাকিস্তানের আটজন, সিরিয়ার পাঁচজন, মিসরের তিনজন ও নৌকাচালক রয়েছেন।
দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ দূতাবাস ও লিবিয়ার একটি প্রতিনিধিদল তিউনিসিয়ার জারবা ও গ্যাবেস হাসপাতালে খোঁজ নিতে থাকে। সেখানে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের সহায়তায় সম্ভাব্য মৃত আট বাংলাদেশি নাগরিকের ছবি ও প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর বাংলাদেশে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত করা হয় এবং মরদেহ দেশে পাঠানোর সব কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়।