ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪ ১১:৫৭ এএম
আপডেট : ০১ মে ২০২৪ ১২:০৩ পিএম
দাবদাহে যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে সেখানে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কাজ করছেন ইট ভাটা শ্রমিকরা। মঙ্গলবার রাজধানীর অদূরে আমিন বাজার এলাকায়। ছবি : আরিফুল আমিন
চারদিকে খাঁখাঁ রোদ। মাথা ও কপাল থেকে টপ টপ করে ঘাম ঝরছে। শরীরের ত্বক গেছে পুড়ে। এই অবস্থা নিয়ে একটু ছায়া খুঁজছিলেন মো. মোবারক হোসেন। দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীতে রিকশা চালান তিনি। কিন্তু মঙ্গলবারের রোদে অনেকটাই নাজেহাল হয়ে পড়েন। বেলা সোয়া ১১টার দিকে সেগুনবাগিচায় তার সঙ্গে কথা হয়।
তিনি বলেন, গরমের কারণে বেশি ভাড়া পাওয়া যায় না। আবার একটা ভাড়া মেরে দ্বিতীয়টা নেওয়াও যায় না। বিশ্রাম নিতে হয়। পানি বা সামান্য নাশতা খেতে হয়। পুরো এপ্রিলেই এভাবে দিন কাটাতে হয়েছে। আয়-রোজগার প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। করোনাকালে সরকার যেমন ব্যবস্থা নিয়েছিল, এখন এই গরমেও কিছু একটা করতে পারে আমাদের জন্য। শুধু মোবারক নয়, এ অবস্থা সব শ্রমিক-মজুরের।
শ্রমঘণ্টা কমায় ক্ষতি হচ্ছে অর্থনীতির
দাবদাহের কারণে শ্রম ও উৎপাদনশীলতা হারানো দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০২২ সালে এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটার্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দাবি করা হয়, তাপপ্রবাহের কারণে খোলা আকাশের নিচে কাজ করা মানুষের কর্মঘণ্টা কমে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশ বছরে কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে ৩ হাজার ২০০ কোটি। ঢাকা শহরে কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়া বিষয়ে গবেষণা করেছে আদ্রিয়ান আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার। সেই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ঢাকায় ৬০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ শ্রম উৎপাদনশীলতা নষ্ট হচ্ছে। এটি ঢাকার মানুষের মোট বার্ষিক শ্রমক্ষমতার ৮ শতাংশ।
হিট স্ট্রোকে মৃত্যু
অত্যধিক গরমে হিট স্ট্রোকে কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীসহ দেশে এ পর্যন্ত ৩০ জনের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবারও সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, নাটোর, ঝিনাইদহে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা কেন নয়
তাপমাত্রা বৃদ্ধি বর্তমানে নতুন এক বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এপ্রিল মাসে টানা ৩০ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। সেখানে ২৯ ও ৩০ এপ্রিল যথাক্রমে চুয়াডাঙ্গায় ৪৩ ও যশোরে ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। এটি অতি তীব্র তাপপ্রবাহ। এই এপ্রিলে দেশের ৭৬ বছরের ইতিহাসে টানা দীর্ঘতম তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। তার আগে গত বছরের এপ্রিলে টানা ১৮ দিন তাপপ্রবাহ ছিল।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মিলন বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও বাতাসের তাপমাত্রা বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ার নেতিবাচক প্রভাব উপকূলীয় অঞ্চলে বেশি পড়ছে। কেননা একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে, অপরদিকে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে বাতাসের তাপমাত্রাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব উপকূলীয় মানুষকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাত ও দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য। এর কারণে ফসল উৎপাদনে ক্ষতির পাশাপাশি জনজীবনেও অস্বস্তি বয়ে আনছে। মানুষের প্রশান্তি বা আরাম অনুভবের দিনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি বাড়লে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ৩ ডিগ্রি বাড়বে। এ অবস্থায় উচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, দেশব্যাপী বয়ে চলা তাপপ্রবাহ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তথা প্রান্তিক শ্রমিক, বস্তিবাসীদের আর্থিক সহযোগিতা দরকার। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি কোনো পর্যায় থেকেই তাদের কোনো সহযোগিতা সংবাদ আমরা দেখছি না। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ কোথাও থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতার কথা শোনা যাচ্ছে না। এমনকি দেশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও কোনো ধরনের কথা বলা হচ্ছে না। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (সিসিটিএফ) থেকেও এদের কোনো সহযোগিতা করা হচ্ছে না।
হিট ইমার্জেন্সি জারির দাবি বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির
এ ব্যাপারে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, দেশজুড়ে তাপমাত্রার মারাত্মক বৃদ্ধি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের কাছে গজবের মতোই। গরমে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, ত্রাহিত্রাহি অবস্থা। তাদের এক বড় অংশের কাজ নেই। পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত জরুরি অবস্থা (হিট ইমার্জেন্সি) জারি করে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। অভাবগ্রস্ত শ্রমজীবী পরিবারগুলোকে টাকা ও খাদ্যসামগ্রী দিতে হবে সরকারকে।
কী বলছে আন্তর্জাতিক আইন
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মানবিক এবং উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে প্রথমে প্রত্যেক ব্যক্তির শারীরিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই যেন তারা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা বেসরকারি শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে সরকারি প্রতিষ্ঠানÑ এমনকি প্রান্তিক শ্রমজীবীদের ক্ষেত্রেও একই রকম পদক্ষেপ নিতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি অস্বাভাবিক উল্লেখ করে এই জলবায়ু বিষয়ক গবেষক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সারা পৃথিবীর পাশাপাশি আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এর মধ্যে এলনিনোর প্রভাবে বাংলাদেশসহ ৬টা দেশে তীব্র দাবদাহ চলছে। প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ৬ এ ‘স্লো অনসেট ইভেন্ট’ হিসেবে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বা দাবদাহ অন্তর্ভুক্ত, সামনে এটা কমবে না, বাড়তেই থাকবে। বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড থেকে দ্রুত অর্থ পেতে বাংলাদেশের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তীব্র দাবদাহ ও শৈত্যপ্রবাহকে দুর্যোগ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে সে অনুযায়ী সব ধরনের প্রতিরোধমূলক আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে প্রান্তিক শ্রমিক, বস্তিবাসী, গ্রামের শ্রমিককে করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর), সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তথা ভিজিএফ কার্ডসহ নানা ধরনের সহযোগিতা দেওয়া উচিত। আর্থিকভাবে অসামর্থ্য ব্যক্তি বা পরিবারকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জাকাত বা অনুদান দেওয়া যেতে পারে। ভর্তুকিভিত্তিক জীবন ও চিকিৎসা বীমা চালু করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ফান্ড কীভাবে পায়
তাপপ্রবাহে কর্মক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও হিট স্ট্রোকে মৃত ব্যক্তির পরিবারকে লস অ্যান্ড ড্যামেজের আলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায় কি না এ ব্যাপারে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) জয়নাল আবেদীন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদেরকে অর্থায়ন করা হয়। এক্ষেত্রে তাপপ্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক, কৃষকসহ কর্মক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও হিট স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ দেওয়া হয়নি। কেননা আমরা নিজেরা কিছুই করতে পারি না। এই অর্থ নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক প্রকল্প আসতে হয়। বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে প্রকল্প এলে সেটি ট্রাস্ট্রের মিটিংয়ে উত্থাপন করা হয়। সেখানে পাস হলে অর্থ দেওয়া যায়। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট্র থেকে আমরা সরাসরি অর্থ দিতে পারি না।
তাপপ্রবাহে দুর্যোগ ঘোষণার মতো সব বৈশিষ্ট্যই আছে
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, তাপপ্রবাহকে সরকার দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে। কেননা দুর্যোগ বলতে যা বোঝায়, তাপপ্রবাহের মধ্যে তার সকল ধরনের বৈশিষ্ট্যই রয়েছে। এতে মানুষের জীবন ও জীবিকা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। মারাও যাচ্ছে।