রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১১ বছর
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:৩৯ এএম
আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৫৬ এএম
গুলশানে জান্নাত ওরফে শাবানা
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিল্প ট্র্যাজেডি রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর আজ। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে আটতলা রানা প্লাজা ধসে পড়লে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শিল্প-দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মারা যান ১ হাজার ১৩৮ জন। আহত ও জীবিত উদ্ধার করা হয় প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিককে।
সেই দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার কাজীহাল ইউনিয়নের ডাঙ্গা গ্রামের আতাউর রহমানের স্ত্রী গুলশানে জান্নাত ওরফে শাবানা। তখন তার বয়স ছিল ২৭ বছর। রানা প্লাজার ষষ্ঠতলায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন তিনি। দুর্ঘটনার পর তাকে আর পাওয়া যায়নি। নিখোঁজের তালিকায় এখনও নাম আছে শাবানার।
শাবানার স্বামী আতাউর রহমান বলেন, ‘দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও স্ত্রীর সন্ধান পাইনি। নিখোঁজ তালিকায় শাবানার নাম থাকায় ১৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছি। কিন্তু পাইনি স্ত্রীকে কিংবা তার মরদেহ। সেদিনের ঘটনায় এলোমেলো হয়ে যায় আমার সাজানো-গোছানো সংসার। মা-হারা শিশুদের অনেক কষ্টে লালন-পালন করছি। স্ত্রীকে হারানোর ব্যথা আজও বয়ে বেড়াই। স্মৃতিগুলো মনে পড়ে।’ আতাউর বলেন, ‘ওই সময় আমাদের ছেলে সাজ্জাদ আহম্মেদ সজীবের বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। এখন তার বয়স ১৮। সে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। মেয়ে সোহানা আফরিন সানুর বয়স ছিল ৩ বছর। বর্তমানে তার বয়স ১৪। সে বর্তমানে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। আজ তাদের মা থাকলে কত খুশি হতো।’ শাবানার মেয়ে সানু বলেন, ‘মায়ের চেহারা মনে নেই। মাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে। আজ মা থাকলে কত আদর করত!’
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর থেকে সেই নিখোঁজদের আজও খুঁজে বেড়ান স্বজনরা। হাতিয়ে বেড়ান নানা স্মৃতি। সেই ভয়াবহ ঘটনার পর সাভার থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ নির্মাণে অবহেলা ও ত্রুটিজনিত কারণে ভবনমালিক সোহেল রানাসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ তদন্তের পর ২০১৫ সালের মাঝামাঝি মোট ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলাটি বর্তমানে ঢাকা জেলা আদালতে বিচারাধীন। রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা গ্রেপ্তার হয়ে তখন থেকে কারাগারে আছেন।
নিহতদের স্মরণ
রানা প্লাজা সাইটের সামনে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির উদ্যোগে দোষীদের শাস্তি ও সম্মানজন ক্ষতিপূরণের দাবি এবং মৃতদের স্মরণ ও জীবিতদের জন্য লড়াইয়ের আহ্বান নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন ওই ঘটনায় আহত শ্রমিক জেসমিন। তিনি কারখানায় দুই দিন আটকা ছিলেন। প্রধান বক্তা হিসেবে আলোচনা করেন নিহত শ্রমিক আঁখি আক্তারের মা নাসিমা আক্তার, নিহত ফজলে রাব্বীর মা রাহেলা আক্তার, নিহত শাহীদার মা এবং গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার ও সাধারণ সম্পাদক বাবুল হোসেন।
বিলসের আলোচনা সভা
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) উদ্যোগে ‘নিরাপদ কর্মক্ষেত্রের অর্জন ও চ্যালেঞ্জ : রানা প্লাজা পরবর্তী উদ্যোগসমূহের অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক আলোচনা সভা গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ট্রেড ইউনিয়ন ও নাগরিক সমাজ নেতৃবৃন্দ এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তারা বক্তব্য রাখেন। দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রকে আগামী দিনে নিরাপদ করে তোলার আহ্বান জানান বক্তারা।
বিলসের চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান সিরাজের সভাপতিত্বে ও নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মহাসচিব নজরুল ইসলাম খান। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিলসের ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসাইন, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সমন্বয়কারী নূর কুতুব আলম মান্নান, গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সমন্বয়কারী নইমুল আহসান জুয়েল, ইন্ডাস্ট্রি অল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ বাদল, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক মো. কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া, শ্রম অধিদপ্তরের উপপরিচালক রোখসানা চৌধুরী, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা গবেষণা ইনস্টিটিউটের যুগ্ম মহাপরিদর্শক মো. মাহফুজুর রহমান ভূইয়া, আইএলওর প্রকল্প কর্মকর্তা মরিস লেন ব্রুকস, জিআইজেড-এর সিনিয়র উপদেষ্টা আমিনুল ইসলামসহ অনেকে।
বক্তারা বলেন, নিহত শ্রমিকদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পোশাক খাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প। সকল পক্ষের এই উদ্যোগকে টেকসই করার মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি সত্যিকার ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন এবং সেই শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে জাতীয় কর্মসূচির আওতায় অন্য যেসব সহযোগী ও অংশীদাররা আছে তাদের নিয়ে একটি যুগোপযোগী কর্মসূচি গ্রহণ করা। তারা জোর দিয়ে বলেন, ফায়ার সার্ভিসের কর্মী বৃদ্ধি এবং এর আধুনিকায়ন নিশ্চিত করে দুর্যোগ মোকাবিলায় একে সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি দুর্যোগ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে তা পরে কাজে লাগাতে হবে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োগ করতে ট্রেড ইউনিয়নের মধ্য থেকে স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করার বিষয়ে পরামর্শ দেন বক্তারা।