জোনায়েদ মানসুর, ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৫৯ এএম
আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:০৩ এএম
তীব্র দাবদাহে বিপর্যস্ত জনজীবন। খেটে খাওয়া মানুষ পড়েছে বিপাকে। কাজে যেতে পারছে না। গরমে দীর্ঘ সময় বসে থেকে ক্লান্ত ফল বিক্রেতা। মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টনে। প্রবা ফটো
ঢাকাসহ দেশজুড়ে তীব্র গরম পড়ছে। ঘোষিত হয়েছে হিট অ্যালার্ট। তাপমাত্রা কোথাও কোথাও ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিপণিবিতানগুলোতে কমেছে ক্রেতার ভিড়। ঈদের ছুটি শেষে শিল্পকারখানায় পুরো দমে উৎপাদন শুরু হয়েছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রিকশাচালক, দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, কুলি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তীব্র গরমের কারণে তারা চাহিদামতো কাজ করতে পারছেন না। হিট স্ট্রোকে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
মালিবাগের শান্তিবাগ এলাকায় একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনে কাজ করছিলেন শাহান শাহ। আলাপকালে তিনি জানান, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় ভাড়া থাকেন। সংসারের খরচ চালিয়ে বাবা-মাকেও কিছু টাকা পাঠাতে হয়। তাই চাইলেই কাজ মিস করতে পারেন না।
তিনি বলেন, গরমের মধ্যে কাজ করতে কষ্ট হয়। কিন্তু কাজ না করলে তো কেউ টাকা দেবে না। কাজ না করলে পরিবারসহ না খেয়ে থাকতে হবে। তাই গরমের মধ্যেও প্রতিদিন বিল্ডিং তৈরির জন্য ইট, বালু ও সিমেন্টের বস্তা মাথায় নিয়ে ছুটতে হচ্ছে।
পাশেই ইট, বালু আর সিমেন্টের মিশ্রণ তৈরির কাজ করছেন শাহনাজ বেগম নামের এক মধ্যবয়সি নারী। তিনি বলেন, ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার আগেই কন্ট্রাক্টর ফোন করে আসতে বলেছেন। বলিছিলাম কয়টা দিন পরে আসি। কিন্তু পরে আসলে আমার জায়গায় অন্য লোক নিয়ে নেবে। তাই অসুস্থ শরীর নিয়েই চলে আসছি। এখনও শরীরটা খারাপ। রাতে জ্বর আসে। কিন্তু ছুটি চেয়ে লাভ নেই।
রাজধানীর নাখালপাড়ায় একটি গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন রিকশাচালক মো. ইদ্রিস আলী, আমিনুল ইসলাম এবং সিএনজিচালক মোমিনুর রহমান। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটায় তাদের সঙ্গে কথা হয়।
রিকশাচালক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘গরমের মধ্যে একটা ভাড়া মারার পর পানি খেতে হয়, বিশ্রাম নিতে হয়। শরীরে জোর কমে আসে। রিকশা চালানো শক্তির কাজ, কিন্তু অত্যধিক গরম পড়ায় দীর্ঘক্ষণ কাজ করা সম্ভব হয় না। ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বিশ্রাম নিলে আবার কিছুটা বল পাওয়া যায়।’
সিএনজিচালক মোমিনুর রহমান বলেন, ‘একটা সিএনজির ভাড়া বাবদ প্রতিদিন ১ হাজার ৪০০ টাকা জমা দিতে হয়। তেল খরচ আছে ৩০০ টাকা। নিজের খরচ আছে, সব মিলে আড়াই হাজার টাকা ভাড়া মারতে পারলে ঘরে ৫০০ টাকা নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু এই গরমে যাত্রী কম থাকায় সেই ভাড়া পাওয়া যায় না।’
ফেরি করে মাছ বিক্রি করেন মো. আনোয়ার হোসেন। তেজকুনিপাড়ায় তার সঙ্গে দেখা। তিনি বলেন, ‘আমরা সকালে কারওয়ান বাজার থেকে মাছ কিনে সারা দিন মাথায় ফেরি করে মহল্লায় বিক্রি করি। এক সপ্তাহের গরমে এখন বেশি মাছ কেনা যায় না। দুপুর পর্যন্ত অনেক মাছ নষ্ট হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয় ছোট মাছ। এত গরম! পাতিলে রাখা বরফও গলে যায়।’
তবে গরম বাড়ায় বিক্রি বেড়েছে শরবত বিক্রেতাদের। তেজগাঁও কলেজের সামনে আখের শরবত বিক্রি করছিলেন মো. কবির হোসেন। তিনি বলেন, ‘গরমে তার বিক্রির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। আগে যেখানে দৈনিক ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা বিক্রি করতেন, বর্তমানে করেন ৭ থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকার।’
এদিকে সোমবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে জানা যায়, অতিরিক্ত তাপের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১৮ হাজার ৯৭০ জন শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
‘এনশিউরিং সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাট ওয়ার্ক ইন আ চেঞ্জিং ক্লাইমেট’ (জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা) শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সব অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা যাচ্ছে। ৩৪০ কোটি শ্রমশক্তির মধ্যে ২৪০ কোটি মানুষই কোনো-না কোনোভাবে অতিরিক্ত তাপের সংস্পর্শে আসছে। অর্থাৎ বৈশ্বিক শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ অতিরিক্ত তাপের সংস্পর্শে আসছে।
২০২০ সালের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সালের তুলনায় ২০২০ সালে প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি কর্মী অতিরিক্ত তাপের কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে। তাপমাত্রা ও শ্রমশক্তি বাড়ার কারণে এ সংখ্যা বেড়েছে বলে ধারণা প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে অতিরিক্ত তাপ, আলট্রাভায়োলেট রেডিয়েশন, চরম আবহাওয়া, কর্মক্ষেত্রে বায়ুদূষণ, পরজীবী-ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসবাহিত রোগ এবং অ্যাগ্রোকেমিক্যাল (কৃষি খাতে ব্যবহৃত রাসায়নিক)Ñ এই ছয় ক্ষেত্রে কর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, অতিরিক্ত তাপের পাশাপাশি বন্যা, খরার মতো চরম আবহাওয়ায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে হতাশা, উদ্বেগ, সব বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) বা মানসিক আঘাতজনিত দুশ্চিন্তা ও মাদকাসক্তি বাড়ছে। দুর্যোগের মধ্যে জরুরি কাজে নিয়োজিত কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, জেলে, কৃষি ও নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যেও নাজুক মানসিক অবস্থা দেখা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম জাকির হোসেন খান বলেন, ‘আমাদের দেশে জীবন বীমা আছে, কিন্তু খেটে খাওয়া শ্রমিকশ্রেণির মানুষের জন্য কোনো ঝুঁকিভাতা নেই। বর্তমানে প্রায় সারা দেশেই তাপপ্রবাহের কারণে শ্রমিকরা কাজ করতে পারছেন না। তাদের সংসার কীভাবে চলছে, সেই খবর কিন্তু নেওয়া হচ্ছে না। এজন্য এসব মানুষের জন্য ঝুঁকিভাতা থাকা দরকার। আর এটি অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আছে, সেখান থেকে দিতে হবে। হিট স্ট্রোকে যারা মৃত্যুবরণ করেন, তাদের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া দরকার।’
পোশাক কারখানায় বিশেষ সতর্কতা
তীব্র দাবদাহ বিবেচনায় নিয়ে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইর পক্ষ থেকে কারখানার শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনাটি কারখানার মালিকরা ঠিকমতো মেনে চলছেন বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি এসএম মান্নান কচি। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘তীব্র দাবদাহে সারা দেশের মানুষ কষ্টে আছে। আমরা প্রতিটি কারখানার মালিকদের সরকারের জারিকৃত ও আইসিডিডিআরবির নির্দেশনা প্রজ্ঞাপন আকারে পৌঁছে দিয়েছি এবং সুস্থ থাকার জন্য যা যা করণীয়Ñ সব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
এসএম মান্নান কচি আরও বলেন, ‘শ্রমিক ভাই-বোনদের যাতে কোনো রকমের কষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমাদের ফ্যাক্টরিতে কমপ্লায়েন্স রয়েছে। পর্যাপ্ত আলো, বাতাস, ফ্যান, এসি এবং পানিজাতীয় খাবারের ব্যবস্থা আছে। কোনো শ্রমিক অসুস্থ হলে গাড়িসহ দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো খারাপ ঘটনা বা অসুস্থতার সংবাদ পাওয়া যায়নি।’
বিজিএমএ পরিচালক ও শিন শিন গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ সোহেল সাদাত প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রতি বছরের এ সময়টায় আমাদের মানসিক প্রস্তুতিতে থাকতে হয়। বর্তমানে বেশি হিট হচ্ছে। আমরা বিজিএমইএর নির্দেশনা মেনে চলছি। শ্রমিকদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি। তাদের সুস্থ রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টায় আছি। আমার ফ্যাক্টরিগুলোতে খাবার স্যালাইন ও লেবুর শরবত সরবরাহ করা হচ্ছে।’
এদিকে গাজীপুরের কোনাবাড়ী, সাভার, নারায়ণগঞ্জে লোডশেডিং বেড়েছে। বিজিএমএ পরিচালক ও স্পারসো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, ‘পর্যাপ্ত গ্যাস নাই, বিদ্যুৎ নাই, শিল্প-কারখানাগুলো এনার্জি ঘাটতিতে। স্পিনিং ও টেক্সটাইলগুলো বিদ্যুতের অভাবে ঠিকমতো চলছে না।
তীব্র দাবদাহ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিজিএমইএ থেকে চিঠি পেয়েছি, তারা সরকারসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিটি কারখানায় চিঠি দিয়েছে। চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছি। শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে দিয়েছি।’
হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শ
হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে তীব্র গরম থেকে দূরে থাকতে হবে। মাঝে মাঝে ছায়ায় বিশ্রাম নিতে হবে। নিরাপদ পানি পান ও রাস্তার খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে দিনে একাধিকবার গোসল করতে হবে। ঢিলেঢালা ও পাতলা এবং হালকা রঙের পোশাক পরতে হবে।
বমি বমি ভাব, তীব্র মাথাব্যথা, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, খিঁচুনি এবং অজ্ঞান হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।