এস এম রানা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ০১:০৫ এএম
আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৪৫ এএম
দুবাইয়ের হারমিয়া বন্দর জেটিতে ভেড়ার পর এমভি আব্দুল্লাহর নাবিকদের উচ্ছ্বাস। ছবি : প্রবা
আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে কয়লা নিয়ে দুবাইয়ের হারমিয়া বন্দরের দিকে রওনা দেওয়ার সময়ই উপকূলকে বিদায় দিয়েছিলেন এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ নাবিক। কথা ছিল দুই সপ্তাহের মধ্যেই সাগর পাড়ি দিয়ে উঠবেন দুবাইয়ের আল হারমিয়া বন্দরে। কিন্তু পথে ঘটে গেল চরম বিপত্তি।
যে বিপত্তি জীবন কেড়ে নেওয়ার হুমকি হয়ে এসেছিল। সেই জীবন কেড়ে নেওয়ার হুমকি, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে শেষ দেখার স্মৃতি মন্থন এবং এই জীবনে আর দেখা হবে না- এমন সব দুশ্চিন্তার অন্তরালে হারিয়ে যায় ৩৩টি দিন। মাঝে কুয়াশাচ্ছন্ন দূর থেকে সোমালিয়া উপকূল দেখা গেলেও সেই উপকূল ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী।
মৃত্যুকূপে ৩৩ দিন জিম্মি থাকার পর গত ১৪ এপ্রিল যখন জলদস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যায়, তখনই নাবিকদের মনে বেঁচে ফেরার আশা স্থায়ী হয়। আকুতি বাড়ে ঘরে ফেরার, স্বজনদের দেখার, সন্তানদের আদর করে আবার কোলে তুলে নেওয়ার। সেই স্বপ্ন বুনন করতে করতেই পরবর্তী আট দিন সাগরেই কাটিয়েছেন নাবিকরা। সোমালিয়া উপকূল থেকে জাহাজ নিয়ে পৌঁছে গেছেন দুবাইয়ের হারমিয়া বন্দরে। গত রবিবার বহির্নোঙরে অবস্থান নিলেও কয়লা খালাসের জন্য বন্দরে পৌঁছতে পারেনি। বন্দর জেটিতে পৌঁছার আগে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সোমবার (২২ এপ্রিল) বাংলাদেশ সময় রাত ৯টার পর এমভি আব্দুল্লাহ জেটিতে ভেড়ে। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় ৪৮ দিনের জলবাস। মাঝে ৩৩ দিনের জিম্মিকাল।
এমভি আব্দুল্লাহ বন্দর জেটিতে পৌঁছার তথ্য নিশ্চিত করেছেন এস আর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম। প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপকালে সোমবার রাতে তিনি বলেন, রবিবার হারমিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে ছিল এমভি আব্দুল্লাহ। সোমবার সন্ধ্যার পরপরই হারমিয়া বন্দরে নোঙর করেছে। এরপর কয়লা খালাস কার্যক্রম শুরু হবে।
৪৮ দিন পর তীরের দেখা পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন ওই জাহাজের নাবিকদের একজন প্রকৌশলী তানভীর আহমেদ। প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘রবিবার বহির্নোঙরে জাহাজ অবস্থান করছিল। সোমবার বন্দরে পৌঁছে। মাঝে ৩৩ দিন জিম্মি অবস্থায় কেটেছে। না হলে অনেক আগেই তীরের দেখা পেতাম।’
এর আগে তিনি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্ট করেন। সেই কথার প্রায় পুনরাবৃত্তি করেছেন প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে। বলেন, ১২ মার্চ আমরা জিম্মি হওয়ার পর দেশবাসী যারা আমাদের জন্য রোজার সময় দোয়া করেছেন, তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এস আর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতি। উনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় মাত্র ৩৩ দিনে জাহাজটি মুক্ত হতে পেরেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জিম্মিকালে অনেক কিছু দেখেছি, শিখেছি। মেশিনগান তাক করা অবস্থায় প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজ করা যায়, তা জিম্মি না হলে বুঝতে পারতাম না। এই ৩৩ দিনে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। জলদস্যুরা যখন আমাদের জিম্মি করল, ফাঁকা গুলি ছুড়ল, নেভির জাহাজ যখন এমভি আব্দুল্লাহ ঘিরে চক্কর দিচ্ছিল তখন জলদস্যুরা ফাঁকা গুলি ছুড়ছিল আবার সবাইকে ব্রিজে নিয়ে গাদাগাদি করে শুইয়ে দিয়েছিল। তখন মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সব শেষ। পরিবারের কারও সঙ্গে বুঝি আর দেখা হবে না। তবে ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ জলদস্যুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ফলে জলদস্যুরা অনেক বিষয়ে নমনীয় হয়েছিল। বাকিরা সবাই একজন অন্যজনকে মানসিক সাপোর্ট দিয়েছি।’
জাহাজটির ২৩ নাবিকের মধ্যে দুজন দুবাইয়ে সাইন অফ করে বিমানযোগে বাংলাদেশে ফিরবেন। বাকি ২১ জন পরবর্তীতে কার্গো প্রাপ্তিসাপেক্ষে দেশে ফেরার কথা। ইতোমধ্যে জাহাজটির মালিকপক্ষের প্রতিনিধি দুবাইয়ে পৌঁছেছেন।