নারীর জন্য বিনিয়োগ
শাহীন আনাম
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৪ ১২:৪৭ পিএম
আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৪ ১৮:৪৮ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
বিশ শতকে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে নারী শ্রমিকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা ঘটে। এরপর দিনটি বৈশ্বিক রূপ লাভ করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে নারী অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনরতদের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে এই দিন। জাতিসংঘ চারটি গ্লোবাল ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্সের আয়োজনের মাধ্যমে দিনটিকে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। জাতিসংঘের আয়োজনে বিশ্বজুড়ে নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে অংশগ্রহণের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হয়। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের বেইজিং কনফারেন্স এ ক্ষেত্রে অনন্য মাইলফলক হয়ে আছে। ১৮৯টি রাষ্ট্র ‘প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন’ স্মারকে স্বাক্ষর করে বিশ্বকে বৈষম্য ও সংঘাতমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে।
প্রতি বছর জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে। প্রতিপাদ্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সুশীলসমাজের সংস্থাগুলো জেন্ডার-বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে তাদের পরিকল্পনা ও প্রাধান্যের বিষয়টি নির্ধারণ করে থাকে। এ বছরের মূল প্রতিপাদ্য : নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ-এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ।
বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক নারীকে বাড়ি, কর্মস্থল এমনকি গণপরিসরে নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হতে হয়। মহিলা পরিষদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ১ হাজার ২৩৫ জন নারী ও মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। তার মধ্যে ৬২ জন মেয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় এবং ৩১ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫১ শতাংশ। জাতিগত, শারীরিক বৈকল্য, লিঙ্গীয় এমনকি পেশাগত প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক নারী এখনও প্রান্তিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এমনকি নারীর ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তাজনিত সংকটও স্ফীত হচ্ছে। কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে নারীর শ্রমের মূল্যায়ন আজও নিশ্চিত করা যায়নি। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর শ্রমের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় এ খাতে নারীশ্রমের অবমূল্যায়ন বাড়ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব শুধু অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পারিবারিক নির্যাতনও বাড়তে শুরু করেছে।
জাতিসংঘের এ বছরের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী নারীর ওপর বিনিয়োগ বাড়াতে বলা হয়েছে। বিনিয়োগ ত্বরান্বায়নের বিষয়টি বাংলাদেশের নারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত নিম্ন আয়ের নারীদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বাজার ও আর্থিক সাক্ষরতার ক্ষেত্রে সব সময় প্রান্তিক পর্যায়ে রাখা হয়। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর মাধ্যমে নারীর অগ্রগতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পূর্বশর্ত বলে বিবেচিত। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের স্বার্থে বিনিয়োগকে আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা ঠিক হবে না। নারীর যাপিত জীবন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দক্ষতার মানোন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নারীর সামাজিক-মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করাও জরুরি। একজন নারী যেন আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে, তার স্বপ্নপূরণের পথে হাঁটতে পারে এবং নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এ বিনিয়োগ করতে হবে যেন নারী বৈষম্যহীন বাস্তবতায় বেঁচে থাকতে পারে।
নারী ও মেয়েদের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব রয়েছে বলে অপুষ্টিজনিত দুর্বলতা, মাতৃমৃত্যু হার এবং প্রজননসংশ্লিষ্ট অসুস্থতা বাড়ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ পুরুষ শিক্ষার্থীর সমান হলেও মাধ্যমিক পর্যায়ে নারীর ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক। সিপিডির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের আওতাভুক্ত নয়। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রীও সম্প্রতি সংসদ অধিবেশনে জানান, মাত্র ১৬ শতাংশ নারী স্টেম-এর মতো বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার সঙ্গে জড়িত আছে।
নারীর ওপর বিনিয়োগের পথে বাধাগুলোর মধ্যে একটি হলো সামাজিক ধ্যানধারণা এবং এর অনুশীলন। এর ফলে নারীদের প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দেওয়া হয়। একটি মেয়ে বা নারীর কী করা উচিত এবং কী করা অনুচিত, তারা কেমন পোশাক পরবে, কোথায় কাজ করবে ইত্যাদি নির্ধারণ করে দেয় সমাজ। পরিবার ও সমাজ নারীকে দুর্বল মনে করার কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও তার থাকে না। আবদ্ধ পুরুষতান্ত্রিক ধারণায় পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব বড় করে দেখা হয়। এভাবে নারীর জন্য পর্যাপ্ত ও অর্থপূর্ণ বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়।
আর এ বাস্তবতাকেই আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী ও মেয়েদের অবদানের মূল্যায়নের নিরিখে বিনিয়োগ করতে হবে। বিনিয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে যেন নারী স্বাবলম্বী হওয়ার আগ পর্যন্ত পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা পায়। দেশের সার্বিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে এর বিকল্প নেই। বিশেষত ১৮ বছরের আগে কোনো মেয়েকে যেন বিয়ে দেওয়া না হয় এ ব্যাপারেও মনোযোগ বাড়ানো জরুরি। সামাজিক ও আর্থিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কোনো মেয়ের ভবিষ্যৎ যেন বলি না হয়। সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সবাই যেন বিশ্বাস করে এখন নারীর ওপর বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি সুফল দেবে।
পরিশেষে সহিংসতা ও বৈষম্যমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা হলে শুধু নারীই নয়, পুরুষও সমভাবেই উপকৃত হয়। এভাবে শান্তি ও সম্প্রীতি গড়ে ওঠে। নারী ও পুরুষ উভয়কে সমান অংশীদার বিবেচনা করে সব স্তরে অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে তারা যেন প্রতিবন্ধকতা ছাড়া পরিবার ও সমাজের কল্যাণে ইতিবাচকভাবে অবদান রাখতে পারে। সময় এসেছে নারী ও মেয়েদের ওপর সঠিক বিনিয়োগ করার এবং ২০৩০ সালের মধ্যে প্ল্যানেট ৫০-৫০-এর বৈশ্বিক রূপকল্প নারী ও মেয়েদের জন্য বাস্তবে পরিণত করার।