× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অগ্নিঝুঁকি, নির্মাণ বিধিতেই গলদ

ফয়সাল খান

প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪ ০৯:১৬ এএম

আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২৪ ১০:৫১ এএম

অনুমোদন না থাকায় রাজধানীর ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কের গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের রুফটপ রেস্তোররাঁ ভেঙে ফেলে রাজউক। সোমবার দুপুরে। প্রবা ফটো

অনুমোদন না থাকায় রাজধানীর ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কের গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের রুফটপ রেস্তোররাঁ ভেঙে ফেলে রাজউক। সোমবার দুপুরে। প্রবা ফটো

দেশে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩ এবং জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী ৬ তলার বেশি উচ্চতার ভবনকে বহুতল ভবন বলা হয়েছে। অনুমোদন নেওয়ার ক্ষেত্রে ভবন পাঁচ তলার বেশি হলেই দুটি সিঁড়ি বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু ২০২০ সালের সংশোধিত বিধিমালায় ১০ তলা পর্যন্ত এ নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। তা ছাড়া অগ্নিনিরাপত্তার আরও কিছু বিষয় শিথিল করা হয়েছে। এতে ভবনগুলোতে আগুনের ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

তারা বলছেন, আইন ও বিধিমালা সাংঘর্ষিক হয়ে গেছে। নিয়ম অনুযায়ী আইনের সঙ্গে বিধিমালার বিরোধ থাকলে আইনের বিধান কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। বিধিমালার দোহাই দিয়ে আইন অমান্য করা হচ্ছে। কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য অগ্নিনিরাপত্তার মতো গুরুতর বিষয়কে শিথিল করা হয়েছে বলেও মনে করেন তারা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩ এবং জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী ২০ মিটারের চেয়ে উঁচু (ছয়তলা) ভবনকে বহুতল ভবন বলা হয়। বহুতল ভবনের অনুমোদন নিতে হলে ২০০৬ সালের বিধিমালায় ভবনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধোঁয়া বা তাপমাত্রা শনাক্তকরণ ব্যবস্থা রাখা, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা থাকা (স্প্রিংকলার), ন্যূনতম ১৭ হাজার গ্যালন পানি ধারণক্ষম জলাধার এবং জলাধার থেকে যেন পানি নেওয়া যায় সেই ব্যবস্থা, ফায়ার ফাইটিং পাম্পহাউস (বিদ্যুৎ, ডিজেল বা বাষ্পচালিত পাম্প যা জলাধার থেকে পানি সংগ্রহ করে ও সরবরাহ করে), জরুরি নির্গমন সিঁড়ি ও ফ্লোরে আলোর ব্যবস্থা, বিকল্প সিঁড়ি, ফায়ার লিফট এবং রিফিউজ এরিয়া অর্থাৎ আগুন, তাপ ও ধোঁয়ামুক্ত নিরাপদ এলাকা রাখার বাধাবধ্যকতা ছিল। কিন্তু ২০২০ সালের বিধিমালায় ১০ তলা পর্যন্ত ভবনে এই বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। 

২০২০ সালের বিধিমালায় ভবনের প্রতি ফ্লোরে ৫০ জনের কম মানুষ হলে একটি নির্গমন পথ বা সিঁড়ি থাকার কথা বলা হয়েছে। ৫০০ জন হলে দুটি সিঁড়ি, ১০০০ জন হলে তিনটি সিঁড়ি এবং এর ওপরে হলে কমপক্ষে চারটি সিঁড়ি রাখার কথা বলা হয়েছে। 

উদাহরণ দিতে গিয়ে একজন স্থপতি জানান, অফিস স্পেস হলে প্রতি ৩০ মিটারে একজন ধরা হয়। ১৫০০ স্কয়ার ফিট ফ্লোরের জন্য ৫০ জন হিসাব করা হয়। আবার আবাসিক হোটেলের ক্ষেত্রে প্রতি রুমে ২ জন হিসাব করা হয়, অর্থাৎ কোনো আবাসিক হোটেলের ফ্লোরে ২৪টি রুম থাকলে দুটি সিঁড়ির বাধ্যবাধকতা নেই। 

ফায়ার অ্যান্ড ইলেক্ট্রিক্যাল সেফটি কনসালট্যান্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. হাশমতুজজামান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ভবনে দুটি সিঁড়ি রাখার অর্থ হলো এক সিঁড়িতে দুর্ঘটনা ঘটলে অন্য সিঁড়ি দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। ২০০৬ সালের বিধিমালায় যেখানে ৬ তলার ওপরে হলে দুটি সিঁড়ি রাখার কথা বলা আছে, সেখানে পরবর্তী সময়ে কার স্বার্থে এটি বাদ দেওয়া হলো। 

তিনি বলেন, আগে এত রেস্টুরেন্ট ছিল না। এখন ঘরে ঘরে রেস্টুরেন্ট হচ্ছে। সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাড়ছে। আগুনের ঝুঁকিও বাড়ছে। কিন্তু ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি শিথিল করা হয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, ভবন মালিকদের দোষ দেওয়ার আগে এসব সমস্যা সমাধান করতে হবে। আইন ও বিধিতে সমন্বয় করতে হবে। তার মতে, কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলের জন্য মানুষকে আগুনের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

দিন দিন বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন

ফায়ার সার্ভিস প্রতি বছরই দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে ভবন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি করে। ২০২৩ সালে সংস্থাটির প্রতিবেদনে দেখা যায় দেশের ৩৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ২০২২ সালের ভবন পরিদর্শনের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল। একইভাবে ২০২৩ সালে পরিদর্শন করা ভবনগুলোর প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩৯ দশমিক ৪১ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে।

২০২৩ সালে ৫ হাজার ৩৩৭টি মার্কেট ও শপিং মল পরিদর্শন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে সন্তোষজনক অবস্থায় আছে ৩ হাজার ২৫৬টি ভবন। বাকি ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলোর মধ্যে ৪২৪টি ভবন অতি ঝুঁকিপূর্ণ।

অগ্নিঝুঁকিতে ঢাকার ৬০ শতাংশ ভবন

ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার ৬০ দশমিক ২৯ ভাগ ভবন আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে। তা ছাড়া চট্টগ্রামে ৫১ দশমিক ৮৯, খুলায় ৩৪ দশমিক ৫৮, রংপুরে ২৯ দশমিক ২৭, বরিশালে ১৯ দশমিক ৬৩, সিলেটে ১৮ দশমিক ৭২, রাজশাহীতে ১৬ দশমিক ১০ এবং ময়মনসিংহে ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। 

ফায়ার সার্ভিস জানায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ১৬ হাজার ২৭৩টি ভবন পরিদর্শন করেছে। এগুলোর মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ছিল দুই হাজার ৩৩৫টি। সাধারণ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ছিল ৬ হাজার ৪১৬টি। আর সন্তোষজনক অবস্থায় ছিল ৭ হাজার ৫২২টি ভবন। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় শপিং মল ও মার্কেট ছিল ৬৭৪টি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ৩৩৬টি। তাছাড়া ১১টি ব্যাংক, ১৩৪টি হাসপাতাল/ক্লিনিক, ২৯টি আবাসিক হোটেল এবং তিনটি মিডিয়া সেন্টার ছিল। ওই পাঁচ বছরে মোট ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা ছিল প্রায় ৫৪ ভাগ। ওই সময় পরিদর্শন করা ১ হাজার ৫৯৫টি মার্কেট ও শপিং মলের মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল ৬৮৪টি। আর সাধারণ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল ৮৯৭টি। অর্থাৎ পরিদর্শন করা মার্কেট ও শপিং মলের ৯৮ দশমিক ৫০ ভাগই ছিল ঝুঁকির তালিকায়। মাত্র ২৪টি প্রতিষ্ঠান (শতকরা দেড় ভাগ) ছিল সন্তোষজনক পর্যায়ে।

বেশিরভাগ আগুনের উৎপত্তি বৈদ্যুতিক গোলযোগে

ফায়ার সার্ভিসের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালে দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯ হাজার ৮১৩টি অগ্নিকাণ্ডের উৎপত্তি হয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে, যা শতকরা হিসাবে ৩৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। তা ছাড়া ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে এবং চুলা থেকে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ আগুনের উৎপত্তি হয়েছে। 

গত বছর হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁয় ২৪৬টি আগুনের ঘটনা ঘটে। আর আবাসিক ভবনে ঘটে ৬ হাজার ৯৬৫টি, রান্নাঘরে ২ হাজার ৯৩৮টি, মুদি দোকানে ১ হাজার ৮২১টি, হাট-বাজারে ১ হাজার ২৬৪টি, কল-কারখানায় ৭৬৯টি এবং গাড়িতে ৫০৬টি ঘটনা।

এক বছরে আগুনে নিহত ১০২

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আগুনে ১০২ জন মানুষ মারা গেছে। এর মধ্যে ৭৩ জন পুরুষ এবং ২৯ জন নারী। এ সময় মোট আহত হয় ২৮১ জন। এদের মধ্যে ২১১ জন পুরুষ এবং ৬০ জন নারী। 

জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, পরিদর্শনের সময় যেসব ভবনে নিরাপত্তার ঘাটতি থাকে, সেসব ভবন কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য নোটিস দেওয়া হয়। আইনে পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় আমরা এসব ভবনের বিরুদ্ধে মামলা সংক্রান্ত ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে এসব ভবনে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করে পর্যায়ক্রমে মামলা করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। 

তিনি বলেন, ১৯৮১ সালের অর্গানোগ্রাম দিয়ে চলছে ফায়ার সার্ভিস। এখন সারা দেশে জনবল মাত্র ১৪ হাজার। ফায়ার সার্ভিসের জনবল ৩০ হাজারে উন্নীত করার জন্য অর্গানোগ্রাম পুনর্গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা