× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বেইলি রোডে আগুন

মৃত্যুকূপেই চলছে বাণিজ্যের বেসাতি

কাজী হাফিজ

প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৪ ০৮:৩০ এএম

আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৪ ১৩:৪২ পিএম

রাজধানীর বেইলি রোডের আগুন পুড়ে যাওয়া ভবন। ফাইল ফটো

রাজধানীর বেইলি রোডের আগুন পুড়ে যাওয়া ভবন। ফাইল ফটো

শুধু বেইলি রোড নয়, রাজধানীর প্রায় সর্বত্রই যেন মৃত্যুকূপে চলছে বাণিজ্যের বেসাতি। ধানমন্ডি থেকে লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুর, বনানী-গুলশান থেকে উত্তরা কিংবা পুরান ঢাকা থেকে মালিবাগ- ভবনে ভবনে রেস্তোরাঁ আর খাদ্যপণ্যের প্রলোভনী বিজ্ঞাপন চোখে পড়লেও যে জিনিসটি সচরাচর চোখে পড়বে না, সেটা হচ্ছে নিরাপত্তা। এখানে বড়ই মূল্যহীন মানুষের জীবন। বেইলি রোডে প্রায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যুর মাত্র দুদিনের মাথায় পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হয় না। না হলে রাজধানীজুড়ে ঝুঁকিপূর্ণ আবাসিক ভবনে অনুমোদনহীনভাবে কী করে চলমান থাকতে পারে একের পর এক ব্যবসা। অনুভূতিও যেন ভোতা হয়ে গেছে- না হয় বারবার একই ঘটনা ঘটবে কেন?

‘দুর্ঘটনার পর জানা যায় গাড়ির ফিটনেস ছিল না। ভুল চিকিৎসার পর জানা যায় ক্লিনিকের লাইসেন্স নেই। আগুন লাগার পর জানা যায় ভবনের নকশায় ত্রুটি। ধরা পড়ার পর বেরিয়ে আসে দুর্নীতির ফিরিস্তি। তাহলে প্রশ্ন একটাই- সংশ্লিষ্টরা আগে কী করে’- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম বক্তব্যের বেশকিছু প্লেট ও স্ট্যাটাস গতকাল শনিবার সারা দিন বিভিন্ন জনের টাইমলাইনে ঘুরেফিরে এসেছে। কড়া কিছু বক্তব্য দেখা গেছে, কিন্তু এটুকুই। দুয়েক দিনের মধ্যেই যেগুলো মিলিয়ে গিয়ে তলানিতে ঠেকবে। 

দেশের খ্যাতনামা স্থপতি মোস্তফা খালিদ পলাশ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ধানমন্ডিতে তারই ডিজাইন করা একটি ভবনে না যেতে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন। তার বক্তব্য- গাউছিয়া টুইন পিক নামক ওই ভবনে ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিয়েই চলছে প্রায় এক ডজন রেস্টুরেন্ট। গতকালও যা চলমান ছিল। স্থপতির স্ট্যাটাসের পর সংশ্লিষ্টরা কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা যায়নি।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ক্রমাগত ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো আমাদের অনুভূতি ভোতা করে দেয়। একটা বহুতল ভবনে অগ্নি-দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা ধরেই নিতে পারি যে, সেখানে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার ঘাটতি ছিল। পর্যাপ্ত সিঁড়ি ছিল না। ভবনের অনুমোদন ছিল না। হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা গেলে জানতে পারব যে, ওই হাসপাতালের লাইসেন্স ছিল না। তার মতে, একই ধরনের ঘটনা বছরে একাধিকবার ঘটলে তা গা-সহা হয়ে যায়। 

তিনি বলেন, ‘আমরা দ্রুত নগরায়নের দিকে যাচ্ছি। এর কুফলটি হচ্ছেÑ আমাদের মানবিক গুণগুলো কমে যাচ্ছে। আমরা যান্ত্রিক সংস্কৃতির দিকে এতটাই ধাবিত যে, একই ভবনে থেকেও একে অপরকে চিনি না।’

কিন্তু সমাধানের পথ কী। সংশ্লিষ্ট সবার বক্তব্য এক্ষেত্রে এক- ‘চাই সব পক্ষের সচেতনতা। এক্ষেত্রে সব পক্ষকেই যার যার কাজ সঠিক সময়ে সঠিকভাবে করতে হবে। বিশেষ করে মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা যাদের দায়িত্ব, তাদের গাফিলতি কোনোভাবেই কাম্য নয়’। গতকাল বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে অগ্নিনির্বাপক বিশেষজ্ঞরা প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন, নিজেরা লিখেছেনও। ড. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, মেজর (অব.) এ কে এম শাকিল নেওয়াজসহ বিশেজ্ঞরা বলেছেন, সর্বশেষ বেইলি রোড ঘটনা থেকে যে বার্তা পাওয়া গেছে, তাতে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। ব্যবস্থাপনার ত্রুটি সারাতেও তারা গুরুত্ব দিয়েছেন। দায়ীরা বারবার পার পেয়ে গেলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে বলেও বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন।

গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের বহুতল ভবনটির পাশেই তিনটি সংগঠন-সংস্থার ছোট্ট তিনটি ব্যানার-ফেস্টুন টানানো। ইএসএসইবি (ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ), এফইওবিএবি (ফায়ার ফাইটিং ইক্যুইপমেন্ট বিজনেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) এবং ওএসএল-কেএনএস নামের সেফটি ইক্যুইপমেন্ট প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠান- এই তিন ব্যানার-ফেস্টুনে গত বৃহস্পতিবার রাতে ভয়াবহ অগ্নি-দুর্ঘটনায় নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা ও তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে। এছাড়া আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে যে, ‘অগ্নি-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সকলেই সচেতন হই’- এটুকুই। গতকাল শনিবার বিকালে ঘটনাস্থলে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানাতে, যাদের গাফিলতিতে প্রায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যু তাদের শাস্তির দাবি জানাতে কোনো সামাজিক বা মানবাধিকার সংগঠনের পুষ্পস্তবক, ব্যানার-ফেস্টুন চোখে পড়েনি।

বেলা ৩টার দিকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মালিক তালহা ইসমাইল বারি, ভাইস প্রেসিডেন্ট জুনায়েদ ইবনে আলি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের মূল বক্তব্য, এ দুর্ঘটনার জন্য কোনো একটি পক্ষকে দায়ী করা ঠিক হবে না। দায় সকল পক্ষের। 

বৃহস্পতিবার ছিল বেইলি রোডের মার্কেটগুলোর সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। শুক্রবারও অর্ধদিবস বন্ধ। মার্কেটগুলো খুলেছে গতকাল শনিবার। গ্রিন কোজি কটেজের কাছে পৌঁছানো ছাড়া বোঝার উপায় নেই, এই এলাকায় দুদিন আগে কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে। গ্রিন কোজি কটেজের সামনে পুলিশ পাহারা। পথচারীদের সামান্য জটলা। পোড়া ভবনটির ছবি তুলছেন কেউ কেউ। এই ভবনের গা ঘেঁষা ১৩ তলা ভবন গোল্ড প্যালেসের সব দোকান-রেস্টুরেন্ট খোলা। কেএফসি ভবন নামে পরিচিত ভবনটিতে ছোট-বড় মোট ছয়টি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। ‘মোভেন পিক’ আইসক্রিম পার্লার থেকে মো. সেতু মণ্ডল বলেন, ‘আজ কাস্টমার একটু কম। তবে দ্রুত সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’

গ্রিন কোজি কটেজের পূর্ব পাশের মার্কেটটিতেও কাস্টমারের অপেক্ষায় ছিলেন সংশ্লিষ্টরা। এ মার্কেটে রয়েছে ‘আর্টিসান’ ও ‘অঞ্জনস’। আর্টিসানের ম্যানেজার প্রকাশ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বাইরে গ্রিন কোজি কটেজের সামনে পুলিশ পাহারা, পথচারীদের ভিড়- এসব কারণে আতঙ্কময় পরিবেশ এখনও বিরাজ করছে। এ কারণে কাস্টমার নেই বললেই চলে। পাশের অঞ্জনস থেকে প্রতিষ্ঠানটির সুপারভাইজার ফারজানাও একই পরিস্থিতির কথা জানালেন। 

রাস্তার অপর পাশের শপিং মল নাভানা বেলি স্টার-এর নিরাপত্তাকর্মী তহিদুল বললেন, ‘আগের শনিবারগুলোর তুলনায় আজ মার্কেটে লোকজন কম আসছে বলে মনে হচ্ছে, এ শপিং মলের লুবনান স্টোর থেকে বিক্রয়কর্মী মো. নাজমুল হক বলেন, ‘কাস্টমার অর্ধেকে নেমে এসেছে।’ তবে পাশের ‘জেন্টল পার্ক’ থেকে ম্যানেজার মো. রিয়াদ বললেন, এখন তো বিকাল। বেইলি রোডের মার্কেটগুলোতে ভিড় বাড়ে সন্ধ্যার পর। 

সার্বিক এ পরিস্থিতি সম্পর্কে একজন প্রবীণ পথচারী মইনুল ইসলাম বললেন, ‘আরও অনেক অগ্নিদুর্ঘটনার মতো বেইলি রোডের ঘটনাটিও আমাদের সচেতন করবে না। এখানে এতগুলো মানুষ প্রাণ হারাল, তা আমরা ভুলে যাব। এসব ঘটনা আমাদের অনুভূতিকে তেমনভাবে আলোড়িত করবে না। সবকিছু যেন গা-সহা হয়ে যাচ্ছে। আমরা কোথাও কেউ নিরাপদে নেই, এই ভাবনা আমাদের অনুভূতিহীন করে দিচ্ছে।’ 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা