× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশন(পিডিবিএফ)

আলো ছড়ানোর প্রকল্প দুর্নীতিতে আঁধার

ফসিহ উদ্দীন মাহতাব

প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২২ ২২:৩৪ পিএম

আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২২ ১৩:১৪ পিএম

পিডিবিএফ লোগো। ছবি: সংগৃহীত

পিডিবিএফ লোগো। ছবি: সংগৃহীত

  • আসল ঠিকাদারের পরিবর্তে কাজ করছে সাব-ঠিকাদার 
  • চড়া দাম দেখানো হলেও লাগানো হয় নিম্নমানের সৌর সড়কবাতি
  • অনিয়মের গন্ধ পেয়ে সরে যান এক প্রকল্প পরিচালক 

কথা ছিল গ্রামের পথে পথে আলো ছড়াবে। এর জন্য নেওয়া হয়েছে পাঁচটি প্রকল্প। সোলার ব্যবস্থাপনার এসব পকল্পে আলো তো জ্বলেইনি, উল্টো ‘মহাদুর্নীতির’ তকমা লাগিয়ে প্রকল্প ডুবেছে অন্ধকারে।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের (পিডিবিএফ) ১০০ কোটি টাকার প্রকল্পগুলোর পদে পদে হয়েছে নয়-ছয়। অথচ জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর চাপ কমাতে বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে সৌরশক্তির এই প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। প্রকল্পের কাজে অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বেছে নেওয়ায় গ্রামীণ পর্যায়ে সড়কবাতি লাগানো ও সোলার হোম পদ্ধতিটি এখন লেজেগোবরে অবস্থা। 

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, কাজ পাওয়া মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের করার কথা থাকলেও সাব-ঠিকাদার দিয়ে কাজ করানো হয়েছে। ব্যবহৃত সৌর সড়কবাতির চড়া মূল্য দেখানো হলেও লাগানো হয় নিন্মমানের বাতি। প্রকল্প কাজে অনিয়ম টের পেয়ে স্বেচ্ছায় একজন প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব থেকে সরেও যান। প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে সম্প্রতি সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগের সচিবের কাছে তথ্য-উপাত্তসহ অভিযোগ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সূত্র বলছে, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের কাজ পেতে বাঁকা পথে হাঁটে ডকইয়ার্ড ইঞ্জিন নামক প্রতিষ্ঠানটি। অথচ ‘আরএসএফ’ ও ‘বি-ট্রাক ইঞ্জিন’ নামে প্রতিষ্ঠান দুটি দরপত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছিল। ‘বিকল্প পথে’ কাজ পাওয়ায় ডকইয়ার্ড ইঞ্জিনের প্রতি নমনীয় থাকে পিডিবিএফের অসাধু কর্মকর্তারা। আসল ঠিকাদারের খবর না থাকায় সব ‘বাহাদুরি’ বর্তায় সাব-ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিকে কর্পোরেশনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আফরিন এন্টারপ্রাইজের ওপর। এর আগে সোলারিক নামক একটি প্রতিষ্ঠানকেও কাজ দেওয়া হয়। পিডিবিএফের অসাধু কর্মকর্তারা দুর্নীতির দায় এড়াতে দরপত্র প্রতিষ্ঠান থেকেই উৎকোচ নেন মোটা অঙ্কের। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিন্মমানের সামগ্রী ব্যবহার করে তাদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়। ফলে সরকার যে উদ্দেশ্যে জনবান্ধব প্রকল্প নিয়েছিল, তার সুফল পাচ্ছে না গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। 

সোলার সূত্র মতে, একই প্রতিষ্ঠানে একই ব্রান্ড ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্পের সৌর সড়কবাড়ি কেনার ক্ষেত্রে বিস্তর তফাত খুঁজে পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, সড়কবাতি কেনার ক্ষেত্রে একই পণ্য-সামগ্রী কোনো প্রকল্পের একক মূল্য ৫৪ হাজার, অন্য প্রকল্পের তা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৭৪ হাজার টাকা। আরেকটিতে দাম  দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪০০ টাকা। জানতে চাইলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মো. মসিউর রহমান বলেন, এমন অভিযোগ তার নজরে এলে অবশ্যই খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে পিডিবিএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সোলার সিস্টেম সংক্রান্ত সব প্রকল্পের পরিচালকের সঙ্গে কথা বললে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তারা বলেছেন, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দরপত্রে ইজিপি প্রক্রিয়ায় অনিয়ম করার সুযোগ নেই। কারো মুখের কথায় মিথ্যা অভিযোগ সত্য হয়ে যাবে না। সব কাজ স্বচ্ছতার সঙ্গে করা হয়েছে। আগামীতে যে প্রকল্পই নেওয়া হবে তার সুফল পাবে দেশবাসী। কারণ পিডিবিএফ প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণা ও করোনাকালীন প্রণোদনায় সঠিক পথেই চলছে। 

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্ধকার সড়কে সৌর বিদ্যুতের উৎস দিয়ে আলোকিত করার জন্য ইডকল ও শ্রেডার নিয়ম না মেনে পিডিবিএফের তত্ত্বাবধানে পাঁচটি সোলার সিস্টেম প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। প্রকল্পগুলো হলো: আলোকিত পল্লী সড়ক প্রকল্প, দিনাজপুর জেলার খানসামা ও চিরিরবন্দর উপজেলায় সোলার সড়কবাতি স্থাপন প্রকল্প, সিলেট জেলার জুড়ি ও বড়লেখা উপজেলায় সোলার সড়কবাতি স্থাপন প্রকল্প, গঙ্গাচড়া উপজেলার বিদ্যুৎবিহীন চরাঞ্চলে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন প্রকল্প এবং চুয়াডাঙ্গায় স্ট্রিট লাইট প্রকল্প। পাঁচটির  মধ্যে আলোকিত পল্লী সড়কবাতি প্রকল্প বরাদ্দের ৪৮ কোটি টাকার মধ্যে ২৩ কোটি টাকা উন্মুক্ত দরপত্র করা হয়। কিন্তু সর্বনিন্ম দরদাতা প্রথম দুটির বদলে পছন্দের একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় কাজ। প্রতিষ্ঠান দুটি হচ্ছে: আরএসএফ ও বি-ট্রান্স ইঞ্জিনিয়ারিং। যোগ্য প্রতিষ্ঠান না পাওয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে আড়াই কোটি টাকার। 

এদিকে বিকল্প পথে কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা কম থাকায় কম টেকসই প্যানেল স্থাপন করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। নিন্মমানের সামগ্রীর কারণে এটার স্থায়িত্ব কম। প্রকল্প চলাকালীন অনেক সড়কবাতি বিকল হয়ে গেছে। এমনকি ডিপিপিতে বরাদ্দের চেয়ে কম সংখ্যাক প্যানেল বসানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) গৌতম ভৌমিক বলেন, ইজিপিতে দরপত্র আহ্বানে অনিয়মের সুযোগ থাকে না। কারণ এখানে দশটি সংস্থা অংশ নিয়েছিল। কাগজপত্রে ত্রুটি থাকা পাঁচটির মধ্যে দুটি প্রথম ও দ্বিতীয় দরদাতা হিসেবে সর্বনিন্ম ছিল। কিন্তু শর্তানুযায়ী না হওয়ায় পরবর্তী পাঁচটির মধ্যে যে প্রতিষ্ঠান সর্বনিন্ম হয়েছে, দরপত্র কমিটি তাকেই কাজ দিয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।

তবে অনুসন্ধানে পিডি গৌতম ভৌমিকের বক্তব্যের ভিন্নতা পাওয়া যায়। অভিযোগ রয়েছে, ইজিপি পদ্ধতি অনুসরণ না করে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার বিদ্যুতবিহীন চরাঞ্চলে সোলার হোম সিস্টেম প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এতে বরাদ্দ ছিল ৩৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে বাজারদরের দ্বিগুণ মূল্যে সোলার হোম সিস্টেম ক্রয় করা হয়। নথির তথ্য বলছে, কাজটি সোলারিক নামক প্রতিষ্ঠানটি পেলেও তা পরিবর্তন করে ডিকে কর্পোরেশনকে দিয়ে কাজ করা হয়। অনিয়মের খবর বাইরে প্রকাশ হলে পিডিবিএফ তার নিজস্ব তহবিল থেকে ২৫ লাখ টাকা দিয়ে সমাপ্ত প্রকল্পের তালিকাভুক্ত সুফলভোগীদের সোলার হোম সিস্টেম সরবরাহ করে। বিষয়টি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলেও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। 

প্রকল্প পরিচালক আমিনুল্লাহ বলেন, এই প্রকল্পে তিনি প্রথম থেকেই পিডি ছিলেন না। মনোয়ারুল ইসলাম বলে একজন ছিলেন। প্রকল্পের চুক্তিপত্রে যা ছিল তা আগের। নতুন করে তিনি কিছুই করেননি। আর কভিডের কারণে যথাসময়ে কাজগুলো করানো সম্ভব হয়নি। তার করা কাজে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। 

অভিযোগ উঠেছে, নামসর্বস্ব কোম্পানির মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গায় স্ট্রিট লাইট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ প্রকল্পের ব্যয় হয়েছে মাত্র আড়াই কোটি টাকা। চুয়াডাঙ্গা জেলায় সৌর সড়কবাতি স্থাপন প্রকল্পে একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান আলম অ্যান্ড কোম্পানিকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং ও আর্থিক সুবিধা নিয়ে স্বয়ং এমডি ওই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অনিয়স টের পেয়ে এই প্রকল্পের পিডি মমতাজ বেগম স্বেচ্ছায় দায়িত্ব থেকে সরে যান। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে মমতাজ বেগম বলেন, মাঝপথে কয়েকমাসের জন্য তিনি এই প্রকল্পে যুক্ত হন। প্রকল্পের মালামাল তিনি কেনেননি বা বরাদ্দ যোগ করেননি। অনিয়মের আভাস পেয়েই স্বেচ্ছায় তিনি দায়িত্ব থেকে সরে এসেছেন। 

নথিপত্র দেখে আরও জানা গেছে, কোটি টাকা বরাদ্দ রেখে দিনাজপুর জেলার খানসামা ও চিরিরবন্দর উপজেলায় হাতে নেওয়া হয় সড়কবাতি লাগানো প্রকল্পের কাজ। এই প্রকল্পে বিস্ময়কর বিষয় হলো আসল ঠিকাদারের হদিস নেই। পুরো কাজই করেছে সাব-ঠিকাদার। পণ্য-সামগ্রী কেনাকাটায় এখানে হয়েছে পুকুরচুরি। অভিযোগ তদন্ত করে দিনাজপুর জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) অনিয়ম খুঁজে পান। তার পরেও সাব-ঠিকাদার ডিকে কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

এই প্রকল্পের পিডি শফিকুল ইসলাম বলেন, অভিযোগগুলো সম্পর্কে তিনি অবগত। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) অনিয়ম তদন্তে প্রকল্প এলাকায় গিয়েছিলেন। কিছুটা অনিয়ম পেয়েছিলেন। সেগুলো সংশোধন করা হয়েছে।

সিলেট জেলার জুড়ি ও বড়লেখা উপজেলায় সোলার সড়কবাতি স্থাপন প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ মাত্র ৫ কোটি টাকা। এখানেও ডিপিএম পদ্ধতিতে ডকইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারের মাধ্যমে সাব-ঠিকাদার ডিকে কর্পোরেশনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আফরিন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডকে কাজ দেওয়া হয়। একটি প্রকল্পে সড়কবাতি লাগাতে ৫৪ হাজার টাকা খরচ হলেও অন্যটিতে সাড়ে ৭৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। অবার অন্যটিতে একই সোলার সামগ্রী কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪০০ টাকা। এভাবে অস্বাভাবিক মূল্য বাড়িয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠলেও নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন সংস্থাটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালকরা।

এ প্রসঙ্গে পিডিবিএফের এমডি মউদুদউর রশীদ বলেন, একটা ক্রয় কমিটি (প্রোকিউরমেন্ট) রয়েছেন, তারাই সব কাজগুলোই দেখভাল করেন। সেখানে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিও থাকেন। বাজারের দরমূল্য অনুযায়ী কোড করে দরপত্র আহবান করা হয়। সর্বনিন্ম দরপত্র অনুযায়ী যিনিই নির্বাচিত হন তাকেই কাজটি দেওয়া হয়। এখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। তবে দামে কিছুটা প্রকল্পভেদে তফাত থাকতে পারে; সেটাও প্রতিযোগিতা অনুযায়ী হয়ে থাকে। আর ক্রয় কমিটি সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকে। এরপরও তার সততা নিয়ে কেউ প্রশ্ন উঠালে সেটা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। এখানে কিছু মানুষ চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তারাই প্রতিনিয়ত তথ্য বিকৃত করে অভিযোগ তুলছেন, যা সত্য নয়।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা