ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:৪৫ পিএম
আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:৫৮ পিএম
ফাইল ফটো
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে ভোটের তফসিল ঘোষণার দিন আজ মঙ্গলবার। তবে এসব আসনে যারা আসতে চান; তাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে আরও আগেই। নিয়ম অনুযায়ী, সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভোটে সংরক্ষিত আসনের নারী প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। দেশের প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো নারী চাইলেই জনসেবক হওয়ার এই দৌড়ে শামিল হতে পারেন। এবার সেই সুযোগ কাজে লাগাতে জোরালো তৎপরতা চালাচ্ছেন সমতলের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার নারী নেত্রীরা। কারণ এবারের সংসদে সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসা কোনো প্রতিনিধি নেই তাদের।
এর আগে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সংসদে সমতলের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্ব করেছেন গারো সম্প্রদায়ের প্রমোদ মানকিন। ময়মনসিংহ-১ আসন (ধোবাউড়া-হালুয়াঘাট) থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার সম্প্রদায়ের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে ছিলেন তিনি, ঠাঁই পেয়েছেন মন্ত্রিসভাতেও। প্রমোদ মানকিনের মৃত্যুর পর নিজেদের সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব পান তার ছেলে জুয়েল আরেং। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে একটি উপনির্বাচন ও একটি জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদে যান। কিন্তু সর্বশেষ নির্বাচনে জুয়েল পরাজিত হওয়ায় এবার সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব হারিয়েছে সমতলের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। মূলত সেই শূন্যতা ঘোচাতেই এবার নারী নেত্রীদের তোড়জোড় বেশি।
এ প্রসঙ্গে প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা বিচিত্রা তির্কী। সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ওরাওঁ জাতিগোষ্ঠীর এই নারী বলেন, জাতীয় সংসদে আমাদের হয়ে কথা বলার কেউ নেই। আদিবাসীদের মধ্যে সমতলের জাতিগোষ্ঠীরা বঞ্চিত হয়েই আসছি। একজন ছিলেন তিনিও হারিয়ে গেলেন। আমাদের কথাগুলো কে বলবে? আমাদের অন্তত একটা সিট দেওয়া হলেও কিছুটা নিজেদের কথা তুলে ধরতে পারব।
আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী পটুয়াখালীর বাসিন্দা রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর নিউ নিউ খেইন। তার বাবা ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা উ থুন অং জাঁ। নিউ নিউ খেইন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের রাখাইনদের মধ্যে তো কেউই নেই। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় তিন পার্বত্য জেলা থেকে একজন নারীকে দেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজার, কুয়াকাটা, বরগুনা, পটুয়াখালীতে রাখাইন সম্প্রদায় আছে। আমি সংরক্ষিত আসনে একটা আসন চাই বৃহৎ স্বার্থে। আমরা যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করি, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা রাজনৈতিক জায়গায় আমরাও নিজেদের গড়ে তুলেছি।
এবার সংসদে দ্বাদশ সংসদে ৩০০ আসনের বিপরীতে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ২২৩ জন নির্বাচিত সদস্য নিয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে। এরপর সর্বোচ্চ ৬২ জন জনপ্রতিনিধি স্বতন্ত্র। সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টির (জাপা) আছেন ১১ জন। বাকি তিনটিতে আছেন ১৪ দলীয় শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং কল্যাণ পার্টির সংসদ সদস্য। সাধারণভাবে প্রতি ছয়টি আসনের বিপরীতে কোনো দল বা জোট একটি সংরক্ষিত আসন পেয়ে থাকে। সেই হিসাবেÑ আওয়ামী লীগ ২২৩টির বিপরীতে ৩৮টি, স্বতন্ত্ররা ৬২টির বিপরীতে ১০টি, জাতীয় পার্টি ১১টির বিপরীতে দুটি এবং অন্যরা একটি আসনের দাবিদার। স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দলের সংসদ সদস্যরা এবার সংসদ নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর তাদের আসন বণ্টনের ভার ছেড়ে দিয়েছেন। যে কারণে আওয়ামী লীগ নিজেদের ৩৮টির সঙ্গে আরও ১০টি আসন বেশি পাচ্ছে।
একাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও জাতিসত্তার প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন আরমা দত্ত, বাসন্তী চাকমা ও গ্লোরিয়া ঝর্না সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এবারও সংরক্ষিত আসনে গতবারের কয়েকজনকে রাখা হতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পুরোনোদের মধ্যে এবারও সরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে। তাদের মধ্যে বাসন্তী চাকমা এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করবেন বলে নিশ্চিত করেছেন। পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির এই নেত্রী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যা ভালো মনে করেন তাই করবেন। ধারাবাহিকতা থাকলে উন্নয়ন ভালো হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী চারবার নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি যে উন্নয়ন করে যেতে পারছেন তা একবার থেকে গিয়ে করে যেতে পারবেন না। আমি পাঁচ বছর ছিলাম। এ সময়ে এ জায়গার সমস্যা-সংকট সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আবার সুযোগ পেলে আরও ভালো কাজ করতে পারব।
তবে আওয়ামী লীগের কার্যানির্বাহী কমিটির সদস্য রেমন্ড আরেং প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার জন্য আলাদা করে কোনো আসন বরাদ্দ নেই। এটা সম্পূর্ণ নেত্রীর এখতিয়ার। অনুমান করে তো বলা যাবেই না কয়টি আসন পেতে পারে। নেত্রী যাকে মনে করেন তাকেই দেবেন। এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত নেত্রীর।
বিধি অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচনে জয়ী দল বা জোটগুলোর মধ্যে ৫০টি সংরক্ষিত আসন আনুপাতিক হারে বণ্টন করা হয়। প্রত্যেক দলের সংসদ সদস্যরা ভোটের মাধ্যমে তাদের পাওয়া সংরক্ষিত আসনগুলোর নারী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন। আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংরক্ষিত আসনে এবারও ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীÑ নির্বশেষে রাজনীতি ও অন্যান্য অঙ্গনে ভূমিকা রাখা নারীদের নিয়ে বৈচিত্র্যময় সংসদ সাজাবে আওয়ামী লীগ।
সংখ্যালঘু জাতিসত্তার জন্য আসন বরাদ্দ করার যৌক্তিকতা নিয়ে আলাপকালে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সংখ্যার দিক বিবেচনায় অন্তত পাঁচটা আসন বরাদ্দ থাকলে ভালো হতো। এতে সমতল ও পাহাড়Ñ দুদিকই প্রাধান্য দেওয়ার সুযোগ থাকে।
অবশ্য এ নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। ‘সিলেক্টেড’ জায়গায় নয়, সরাসরি নির্বাচনেও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার নারীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আরও এগিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন মানবাধিকারকর্মী ডোনাই প্রু নেলি। তিনি বলেন, আমি নিজেই সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। জানি কঠিন, তবু চেয়েছি আমাকে দেখে নারীরা উৎসাহিত হোক। সংরক্ষিত নারী আসনে পাহাড়-সমতল সব জায়গার প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। সমতলের আদিবাসীরা বেশি অবহেলিত। তাদের একজন নেতা ছিলেন সংসদে, এবার সেটাও নেই।
সার্বিক বিষয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপির সঙ্গে। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, বিভিন্ন গোষ্ঠী, বর্ণ, ধর্ম, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার সমন্বয়ে সংসদে অংশগ্রহণ থাকবে। আওয়ামী লীগ সব সময় যোগ্য ব্যাক্তিদের মনোনয়ন দিয়ে থাকে। সংখ্যালঘু জাতিসত্তা নিয়ে আলাদা কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমার জানা নেই। তবে সব শ্রেণির অংশগ্রহণই থাকবে। লক্ষ্য অর্জনে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা এসব লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছেন।