× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষ বাড়বে আরও ৫ শতাংশ

আমিনুল ইসলাম মিঠু

প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০০:১৪ এএম

খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষ বাড়বে আরও ৫ শতাংশ

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। এগুলো মানুষের খাদ্য, কৃষি, স্বাস্থ্য, জীবনমান ও জীবিকায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। তবে সব থেকে বেশি প্রভাব পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তায়। ফলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়াসহ বাড়ছে খরচ, যা খাদ্য ব্যবস্থাপনায় চাপ বাড়াচ্ছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে অর্থাৎ ২১০০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ৩.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি হলে ২০২১-২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অধিবাসীদের মধ্যে মাঝারি থেকে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার মানুষের হার পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।

গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার উন্নতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন এ খাতের ভবিষ্যৎ উন্নতির পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা কমাতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ এবং সহযোগিতাও প্রয়োজন।

গত মঙ্গলবার প্রকাশিত লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের (এলএসই) গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্টের ‘ট্যাকলিং দি ইম্পাক্টস অফ ক্লাইমেট চেঞ্জ ও ফুড সিকিউরিটি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্য নিরাপত্তায় জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশ্নে বাংলাদেশের সামনে আবির্ভূত জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক সংঘাতের এই নতুন দ্বৈত সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এদেশে এ যাবৎকালের বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রচেষ্টাগুলোর বিশ্লেষণও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে।

এলএসইর প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের ঘূর্ণিঝড়, খরা এবং বন্যা পরিস্থিতি বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তীব্র হচ্ছে। আবহাওয়া সংক্রান্ত এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান বন্যা এবং তীব্র দাবদাহের দ্বৈত দুর্যোগের কারণে সমস্যাগুলো আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে। যেমন- ফসলের ফলন কমে যাওয়া, গবাদি পশুর স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা, অল্টার্ড পেস্ট ও ডিজিস ডিস্ট্রিবিউশনের মতো কৃষি বিপর্যয় এবং কৃষি শ্রমিক কমে যাওয়া অন্যতম। এসব কারণে মানুষের আয় কমে যায় ও পরিবারগুলোর পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার জোগান সীমিত হয়ে পড়ে।

গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বাড়তি ঝুঁকিতে রয়েছে। এই সংকট আরও বাড়িয়েছে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। কারণ যুদ্ধের কারণে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে প্রধান খাদ্যশস্য, জ্বালানি এবং সারের দাম। আর এই কারণে বেড়েছে দারিদ্র্যের হার এবং অবনতি হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তার। 

যদিও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রবণতার কারণে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে অর্থাৎ ২১০০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ৩.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি হলে ২০২১-২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অধিবাসীদের মধ্যে মাঝারি থেকে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার মানুষের হার পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। তবে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, তাপমাত্রা বৃদ্ধি যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে বেঁধে রাখা যায় তাহলে ২০২১-২০৪০ সালের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আক্রান্তের এই হার বাড়বে ৪.৪ শতাংশ। তাই জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করতে বিশ্বব্যাপী গৃহীত জোরালো পদক্ষেপ খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব রাখতে চলেছে।

প্রতিবেদনে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক এলিজাবেথ রবিনসন বলেন, ‘বাংলাদেশ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার উন্নতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন এ খাতে ভবিষ্যৎ উন্নতির পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে হাজির হয়েছে।’

এলএসইর প্রতিবেদনটির বিষয়ে বুয়েটের জলবায়ু গবেষক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তার দুটি উৎসÑ একটি আমদানি ও আরেকটি নিজস্ব উৎপাদন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে নিয়মিত ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা ও লবণাক্ততার কারণে আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আমরা জলবায়ু সহনশীল বিভিন্ন উদ্যোগও নিচ্ছি। কিন্তু বিভিন্ন মৌসুমে তাপমাত্রার বড় ধরনের পরিবর্তন আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করছে। সার্বিকভাবে উন্নত দেশগুলোর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো ও আমাদের অভিযোজন পরিকল্পনাগুলো বাস্তবসম্মত করাসহ বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে সরকারকে।’

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ সাম্প্রতিক বিপর্যয়গুলো খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক এবং জলবায়ুগত অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় সহনশীলতা এবং অভিযোজনের সক্ষমতার ওপর জোর দিয়ে বাংলাদেশ সরকার নীতিতেও কিছু পরিবর্তন এনেছে। যা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের দৃঢ় প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, আগামীতে নীতি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অভিযোজন এবং সহনশীলতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আর এটি নিশ্চিত করতে জলবায়ু সহনশীলতার সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল (২০০৮) এবং ২০২৩-২০৫০ এর জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার (এনএপি) মতো নীতিমালাগুলোতে জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি অনুশীলন এবং টেকসই চাষ পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের উচিত লবণাক্ততা-সহনশীল ফসল, ভাসমান কৃষি, সহনশীল ধানের জাত, কৃষি বনায়ন এবং টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রচলন করার মাধ্যমে জলবায়ু-স্মার্ট কৃষিতে আস্থা রাখা। একোয়াকারচার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ এবং সিস্টেম অফ রাইস ইনটেনসিফিকেশনের (এসআরআই) মতো সরকারি উদ্যোগগুলোর অগ্রগতি বাড়ানো। এ ছাড়া জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নীতি (২০২৩-২০৫০)-এ বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যাভাস্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। জলবায়ু-স্মার্ট প্রযুক্তিগুলো বেশি পুষ্টিসম্পন্ন শস্যের চাষাবাদকে ত্বরান্বিত করে। আর সেই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্পগুলো ক্রয়ক্ষমতা নিশ্চিত করে। জলবায়ুসংক্রান্ত পরিষেবা, শস্যবীমা এবং কোল্ড স্টোরেজের মতো সরকারি সহায়তা এই খাতকে আরও মজবুত করবে। কৃষিতে জলবায়ুর প্রভাবকে বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার পালাক্রমে ভেজা ও শুকানো পদ্ধতি, উন্নত সার ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলোতে জোর দিচ্ছে এবং খড় পোড়ানো কমানোরও উদ্যোগ নিয়েছে। 

এদিকে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর ফলে সৃষ্ট খাদ্য নিরাপত্তার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করতে হলে নীতিনির্ধারক, গবেষক এবং অংশীজনদের যুক্ত করার মাধ্যমে অভিযোজনমুখী কৌশল নির্ধারণ এবং টেকসই অনুশীলনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

তারা বলছেন, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা মোকাবিলার জন্য জরুরি গবেষণায় জোর দেওয়া, সুনির্দিষ্ট ভোক্তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং উন্নত স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার মতো প্রচেষ্টাগুলো বৃদ্ধি করার মাধ্যমে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি সাধনে সক্ষম হয়েছে। সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও, এই বিনিয়োগগুলো পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতির মধ্যে আরও জলবায়ু সহনশীল এবং উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী সৃষ্টির জন্য ইতিবাচক।

পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ও এলএসইর গ্র্যান্টহাম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং সিনিয়র ফেলো ড. সৌর দাশগুপ্ত বলেন, ‘খাদ্য উৎপাদন এবং খাদ্য ও পুষ্টির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আগাম কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের নীতি প্রয়োজন। যেমন- ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য পুনর্বীমা স্কিম চালু এবং ক্যাশ ট্রান্সফার সুবিধা।’

অধ্যাপক রবিনসন বলেন, বাংলাদেশের সরকার ইতোমধ্যেই জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি অনুশীলনকে উৎসাহিত করছে। তাদের বেশ কয়েকটি সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু তারপরও খাদ্য মূল্য শৃঙ্খলে সহনশীলতা তৈরি করতে জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার উন্নয়নে আরও প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আলীম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের খরা, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা বেশি হলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। তাই আগে আমরা সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এটা করে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। আর এখন আমরা উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। এজন্য এখন সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও সুষম খাদ্য প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট খাদ্য আছে কিন্তু ডিস্ট্রিবিউশন নেই। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া থেকে গম আসছে না। আবার ভারত যদি পেঁয়াজ না দেয় তাহলে বাজারে সেটার প্রভাব পড়ছে। আমরা অনেকগুলো নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগেরও প্রয়োজন আছে।’ 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা