দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
বিশেষ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:৫৩ এএম
আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:৪৭ এএম
ফাইল ছবি
প্রতীক বরাদ্দ পেয়েই প্রচারে নেমে পড়েছেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। অনেকে নির্বাচনী পোস্টার আগেই ছেপে রেখেছিলেন, নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় তা এখন টানানো শুরু হয়েছে।
সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) প্রার্থীদের জন্য প্রতীক বরাদ্দ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ছাড়া নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দিয়ে গতকাল ইসি বলেছে, উপজেলা-থানা পর্যায়ে সেনা মোতায়েন করতে হবে। আগামী ২৯ ডিসেম্বর থেকে এই সেনা মোতায়েন হবে। প্রিসাইডিং অফিসারদের মধ্যে বিতরণের আগে ব্যালট পেপারসহ বিভিন্ন ধরনের সিল সংরক্ষণ ও সেসবের গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্যও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘বেশিরভাগ কেন্দ্রে সকালেই ব্যালট পেপার পাঠানো হবে। নির্বাচন নিয়ে অস্বস্তি বা স্বস্তি কোনোটিই আমার মধ্যে নেই। তিনি বলেছেন, নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে কি না সেটি ভোটের পরে দেখা যাবে।
বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকাতেই প্রচার শুরু হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশে। রয়েছে ব্যতিক্রমও। চট্টগ্রাম-৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তার প্রচার শুরু করেন নির্বাচনী এলাকায় সাইকেল চালিয়ে। লাঙ্গলের পক্ষে ভোট চেয়ে বিশাল শোডাউন করেন ঢাকা-৪ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। প্রতীক পেয়েই টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ছুটে যান মাগুরা-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে কি না সেটি ভোটের পরে দেখা যাবে বলে মন্তব্য করেছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল নির্বাচন ভবনে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরির সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এমন মন্তব্য করেন।
বিএনপি অংশ নিলে দেশের উপকার হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন, এখন কী মনে করছেনÑ এ প্রশ্নে সিইসি বলেন, আগেও বলেছি, তারা অংশ নিলে নির্বাচনটা অনেক বেশি অংশগ্রহণমূলক হতো, ভালো হতোÑ এটা সবাই মনে করেন।
ভোটে আন্তর্জাতিক চাপ এসেছে বলেছিলেন, সেটা কি কাটিয়ে উঠেছেনÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাজারে একটা শব্দ চালু আছেÑ চাপ, চাপ, চাপ; বিষয়টি হলো সব দেশ আমাদের নির্বাচনের খোঁজ-খবর নিচ্ছে। দাতা দেশগুলো নির্বাচন দেখতে চাচ্ছে। সেটাকে চাপ বলেন বা সেনসেটাইজেশন বলেন, ওরা দৌড়ঝাঁপ করছে। যার ফলে সরকারও বারবার বলেছে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে। আমাদের তরফ থেকেও আমরা বলেছি, নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু হবে। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটির মেম্বার এবং কমিটি অব নেশনসে আমরা সদস্য। আন্তর্জাতিকভাবেও নির্বাচনটা সুন্দর হোক, স্বচ্ছ হোক, গ্রহণযোগ্যতা পাক সেই প্রত্যাশা সবার মধ্যে; আমাদেরও আছে। আমাদের দিক থেকেও ফ্রি, ফেয়ার এবং পিসফুল ইলেকশন নিশ্চিত করার জন্য জোর দেওয়া হচ্ছে।
সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে অস্বস্তি বা স্বস্তি কোনোটিই আমার মধ্যে নেই। আমার দায়িত্বটা হচ্ছে সরকার, পুলিশ, প্রশাসন সবার সহায়তা নিয়ে নির্বাচনটা করা। আমার ব্যক্তিগত স্বস্তি, অস্বস্তিটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে এটা ঠিক যে, নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দল অংশগ্রহণ করছে না। করলে ভালো হতো। আপনারা জানেন যে, আমরা প্রথম থেকেই তাদেরকে আহ্বান জানিয়েছিলাম, আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তারা সাড়া দেয়নি।
যারা নির্বাচনে আসছে না তারা তো প্রতিরোধেরও ঘোষণা দিয়েছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেনÑ এ প্রশ্নে সিইসি বলেন, সেটা উনাদের রাজনৈতিক ব্যাপার, আমরা কোনো বক্তব্য দেব না। আমরা চাইব ইলেকশনটা পিসফুলি হোক।
জাপানের ১৬ জন পর্যবেক্ষক থাকবেন
সংসদ নির্বাচনে জাপানের ১৬ জন পর্যবেক্ষক থাকবেন বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি।
গতকাল দুপুর ২টায় নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জাপানের ১৬ জন পর্যবেক্ষকের মধ্যে তিনজন জাপান থেকে আসবেন, আর বাকিরা ঢাকায় দূতাবাস অফিসের লোকজন।
এ বিষয়ে সিইসি বলেন, ওরা আমাদের নির্বাচনটাকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছে। সেজন্য পর্যবেক্ষণ করতে চাচ্ছে। আমরা তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়েছি। তারা আরও বিস্তারিত জানতে চেয়েছে। আমরা তাদেরকে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে সর্বশেষ অবস্থা জানিয়েছি।
ব্যালট সকালে পাঠালে ফেয়ারনেস নিয়ে ‘সংশয়’ কমবে
গতকাল সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে সিইসি বলেন, কেন্দ্রে কেন্দ্রে সকালে ব্যালট পেপার পাঠানো হলে নির্বাচনের ফেয়ারনেস নিয়ে সংশয় কিছুটা কমবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বেশিরভাগ কেন্দ্রে সকালেই ব্যালট পেপার পাঠানো হবে। এতে স্বচ্ছতা বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, আমরা অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যতদূর সম্ভব ভোটগ্রহণ শুরুর আগে সকালে ব্যালট পেপার পাঠানো হবে। এটা নিয়ে আমরা অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছি। তবে কিছু কিছু এলাকায় সকালে পাঠানো সম্ভব হবে না। যেমন দুর্গম ও দূরবর্তী এলাকা, হাওর-বাঁওড় এলাকা অথবা যেখানে জলপথে যেতে হয়। এ ছাড়া দ্বীপাঞ্চলেও সম্ভব হবে না। এজন্য পরিপত্র জারি করেছি। ব্যালট পেপার ভোটগ্রহণের পূর্বে সকালে যাবে। তবে রিমোট এলাকা বা যেখানে সকালে পাঠানো যাবে না, সেসব এলাকার ব্যাপারে রিটার্নিং কর্মকর্তারা আমাদের কাছে অনুমোদন গ্রহণ করবেন।
ব্যালট পেপার সংরক্ষণ ও গোপনীয়তা রক্ষার নির্দেশ
প্রিসাইডিং অফিসারদের মধ্যে বিতরণের আগে ব্যালট পেপারসহ বিভিন্ন ধরনের সিল সংরক্ষণ ও সেসবের গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করা হয়েছে। পরিপত্রে আরও বলা হয়, নির্বাচনে ভোটগ্রহণের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রিসাইডিং অফিসারকে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, তাদের নির্বাচনী এজেন্ট অথবা পোলিং এজেন্ট ও নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের সম্মুখে আইন দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসারে ভোট গণনার কাজ শেষ করতে হবে। ভোট গণনার কাজ ভোটকেন্দ্রেই শেষ করা প্রিসাইডিং অফিসারদের আইনগত দায়িত্ব। এই দায়িত্ব তাদেরকে অবশ্যই পালন করতে হবে। কোনো অবস্থায়ই ভোটকেন্দ্র ছাড়া অন্য কোথাও ভোট গণনা করা যাবে না। ভোট গণনার বিবরণী ভোটকেন্দ্রের নোটিস বোর্ড বা দেয়ালে ঝুলিয়ে প্রকাশ করতে হবে।
ভোট গণনার কাজ শেষ হওয়ার পরপরই প্রত্যেক প্রিসাইডিং অফিসারকে ব্যবহৃত ব্যালট পেপারভর্তি সিলমোহরকৃত বিভিন্ন ধরনের প্যাকেট, ভোট গণনার বিবরণী, ব্যালট পেপারের হিসাব এবং অন্যান্য কাগজপত্র সরাসরি উপযুক্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় সহকারী রিটার্নিং অফিসারের মাধ্যমে রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাতে হবে। ভোটের বেসরকারি ফলাফল সংগ্রহ ও প্রচারের সময় ‘ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্রে’ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, তাদের নির্বাচনী এজেন্ট অথবা দলের প্রতিনিধি এবং অন্যান্য সংগঠন যেমনÑ স্থানীয় প্রেস ক্লাব, বারের সভাপতি-সেক্রেটারি অথবা তাদের প্রতিনিধিকে লিখিতভাবে আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
সেনা মোতায়েন হবে উপজেলা-থানা পর্যায়ে
নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৩ দিনের জন্য মাঠে নামছে সশস্ত্র বাহিনী। গতকাল সোমবার নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভিাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারকে (পিএসও) একটি চিঠি পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা প্রতিটি জেলা-উপজেলা-মেট্রোপলিটন এলাকার নোডাল পয়েন্ট এবং সুবিধাজনক স্থানে নিয়োজিত থাকবে।
ইসির উপ-সচিব মো. আতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে উল্লেখ করে বলা হয়Ñ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠান করার জন্য নির্বাচন কমিশন সম্ভব সব আইনানুগ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখার জন্য সার্বিক প্রস্তুতিও গ্রহণ করা হয়েছে। ভোটগ্রহণের আগে, ভোটগ্রহণের দিন ও ভোটগ্রহণের পরে শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য ‘ইন এইড টু দ্য সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশের ৩০০ নির্বাচনী এলাকায় আগামী ২৯ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত (যাতায়াত সময়সহ) সশস্ত্র বাহিনী নিয়োজিত হবে মর্মে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
চিঠিতে নির্বাচন কমিশন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে জানায়, ফৌজদারি কার্যবিধি ও অন্যান্য আইনে বিধান অনুসারে এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ইনস্ট্রাকশন রিগার্ডিং এইড টু দ্য সিভিল পাওয়ারের ৭ম ও ১০ম অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনী পরিচালিত হবে। রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে সমন্বয় করে উপজেলা-থানায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হবে, সশস্ত্র বাহিনীর টিমের সঙ্গে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত করা হবে এবং আইন, বিধি ও পদ্ধতিগতভাবে কার্যক্রম গৃহীত হবে।
প্রার্থিতা ফিরে পেলেন না শামীম হক ও শাম্মী আহমেদ
ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হক এবং বরিশাল-৪ আসনে দলটির প্রার্থী শাম্মী আহমেদের প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। উভয়ের রিট খারিজ করে গতকাল বিচারপতি মো. ইকবাল কবীর ও বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। তবে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ময়মনসিংহ-৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুস সালাম এবং বরিশাল-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদিক আব্দুল্লাহ।
এদিকে গত রবিবার হাইকোর্টে নির্বাচন কমিশনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ৬ জন। বিচারপতি মো. ইকবাল কবীর ও বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। প্রার্থিতা ফিরে পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন- মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সোহানা তাহমিনা, টাঙ্গাইল-৬ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ মাহমুদুল ইলাহ, মানিকগঞ্জ-২ আসনের তৃণমূল বিএনপির মো. জসীম উদ্দিন, লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সেলিনা ইসলাম, রাজশাহী-১ আসনেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. গোলাম রব্বানী ও বগুড়া-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. ফেরদৌস স্বাধীন ফিরোজ।