× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা এখনও হয়নি

আসিফ মুনীর

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৫৬ পিএম

আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৫৮ পিএম

মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। ছবি: সংগৃহীত

মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯১ সালে আমরা যখন ‘প্রজন্ম ৭১’ গঠন করি তখন সবাই বয়সে তরুণ। দীর্ঘদিনের সামরিক জান্তার পতনের পর গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। আমরা সবাই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। ছিল অনেক স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জায়গা থেকেই গঠন হয়েছিল ‘প্রজন্ম ৭১‘। অন্যতম লক্ষ্য ছিল শহীদদের আদর্শ বাস্তবায়ন করা। বঙ্গবন্ধু যেভাবে দেখেছেন, আমাদের শহীদ বাবা-মারা যেভাবে দেখেছেন তা বাস্তবায়ন করা এবং সঠিক ইতিহাস জাতির কাছে তুলে ধরা।

এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে আমরা একটি স্মৃতিফলক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিই। ১৯৯১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ‘প্রজন্ম ৭১’ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিরক্ষার দাবিতে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করে রায়েরবাজারে। এটা করতে যেয়েই অনেক বাধা মুখে পড়ি। আমরা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছি। বুঝিয়েছি সবাইকে স্মৃতিফলক নির্মাণের গুরুত্ব। সে সময়টায় শহীদের পরিবার হিসেবে এ কাজগুলো করা মানসিকভাবে বেশ কষ্টের ছিল। আমরা ধারণা করি রায়েরবাজারে আমাদের বাবাসহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। যেখানে হত্যা করা হয় সে স্থানটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি আমরা। সে স্থানে একটি টিনের ফলকে কবি আসাদ চৌধুরীর ‘তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কি তা বাংলাদেশ?’ কবিতার লাইনটি উল্লেখ করি। এর পরই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সেখানে আরেকটি স্মৃতিফলক করে আমাদের আহ্বান করেছিলেন যেতে। কিন্তু আমরা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলাম; কারণ স্মৃতিফলক নির্মাণের প্রথম উদ্যোগটি সরকার নেয়নি, নিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু তারা আমাদের উদ্যোগটিকে স্বীকৃতি না দিয়ে নতুন স্মৃতিফলক নির্মাণ করে। তবে আমাদের করা স্মৃতিফলকে তৎকালীন বিরোধী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। সেই ধারাবাহিকতায় পরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রায়েরবাজারে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শহীদদের সন্তানদের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এটা ছিল একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। 

এরপর আমরা দেখলাম বিএনপি জোট সরকার আমলে রাজাকারদের এ দেশে ক্ষমতায় আসীন করা হলো। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, বাবাদের সেই আদর্শ কী আদৌ বাস্তবায়িত হলো! বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে একজন শহীদসন্তান হিসেবে বলা যায়, যারা এ দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাদের আদর্শ আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। এ কথাটি আমি কয়েক বছর ধরেই বলে আসছি। আমাদের বাবারা শুধু ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দিয়েই দেশের মুক্তিসংগ্রামে যুক্ত ছিলেন না; তারা ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে দেশের হয়ে কাজ করে গেছেন। সেই ’৪৭-পরবর্তী থেকেই বাংলার রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা দেশের জন্য পাশাপাশি কাজ করে গেছেন। বুদ্ধিজীবীরা তাদের সৃজনশীল চিন্তা ও কর্ম দিয়ে দেশের জন্য রূপকল্প তৈরি করে গেছেন। তৎকালীন পূর্ববাংলার জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজে বরাবরই ছিলেন তৎপর। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে যেমন গ্রেফতার করা হয়, তেমনি শিক্ষকদেরও প্রতিবাদী করে তোলার অপরাধে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের অন্তরিন অবস্থায় যোগাযোগ, উভয় পক্ষকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণে সাহায্য করেছে। 

জাতি হিসেবে ’৭১-এর বিজয় ও ’৭২-এর সংবিধান আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। পুরো আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের অবদান রয়েছে ’৭২-এর সংবিধানে। ’৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতির অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি এ চার মূলনীতিকে অসম্মান করা হয়েছে। এখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার যখন আছে তখন আমরা প্রত্যাশা করি এ চার মূলনীতি প্রশ্নাতীতভাবে বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু সেটা আমরা সব সময় দেখতে পাইনি। বিগত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি সাম্প্রদায়িক উস্কানি এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু যথাযথ প্রতিকার আমরা পাইনি। পাঠপুস্তকে যেভাবে ‘হেফাজতে ইসলাম’ প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে সে ক্ষেত্রে সরকারের নমনীয়তা আমরা লক্ষ করেছি। আমাদের বাবারা একীভূত শিক্ষাব্যবস্থার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আমরা দেখতে পাইনি এখনও। ধর্মীয় শিক্ষার স্বীকৃতি দিয়ে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে মূলধারার শিক্ষা থেকে। আবার এ ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার জবাবদিহিও নেই যেখানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না বা যে চার মূলনীতি তার গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এটা আবার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকারের সময়ই ঘটছে। এটা মেনে নেওয়া আমাদের জন্য খুবই কষ্টকর। আমরা তো আমাদের মায়ের কাছেই শুনেছি ‘৫২ থেকে ’৭১ আন্দোলন সংগ্রামে আমাদের বাবারা কতটা আন্তরিক ছিলেন। পাকিস্তান সরকার থেকে আমার বাবা মুনীর চৌধুরীকে সিতার-ই-ইমতিয়াজ রাষ্ট্রীয় উপাধি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমার বাবা সেই উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের সেই ঐতিহাসিক সত্যগুলো তো রয়েছে। তারা দেশের জন্য ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে গেছেন। আর তাই পাকিস্তানি দোসররা চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করে হত্যা করে। এই যে জীবন দিয়েছেন আমাদের বাবারা, যখন চার মূলনীতিকে অসম্মান করা হয় তখন তাদের আত্মত্যাগও অসম্মান করা হয়। বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কিছু কিছু স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন ছিল তা আমরা পাইনি।

সে সময়ের রাজনীতিবিদরা বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাধারাকে যতটা গুরুত্ব দিতেন, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী রাজনীতিবিদরা সামগ্রিকভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের থেকে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা গ্রহণ করতে পারেননি বলেই প্রতীয়মান হয়। না হলে এত দিনেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা সম্পন্ন করা গেল না কেন? কেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ জীবনী ও কর্মকাণ্ড সংরক্ষণ করে প্রচার করা হয় না? কেন অধিকাংশ শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবার নীরবে নিভৃতে নেপথ্যে চলে গেল? শহীদজায়া যারা রয়েছেন তাদের জন্য কোনো সম্মানের জায়গা তৈরি করা হয়নি। ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে এসব শহীদজায়া কী পরিমাণ মানসিক কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করেছেন তা কেউ খোঁজ নেয়নি। এখন হয়তো অনেক শহীদজায়া বেঁচেও নেই; তবু তো রাষ্ট্র এসব শহীদজায়ার প্রতি কোনো স্বীকৃতির ব্যবস্থা করতে পারত বা এখনও পারে।

২০০৮ সালের পর এর অনেক কিছুই করা যেত শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে। এর পরও বলব, আংশিক কিছু বিষয় বাস্তবায়ন হয়েছে, যেমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তবে এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। আমাদের বাবাদের হত্যাকাণ্ডের যে বিচার তার রায় হয়েছে কিন্তু কার্যকর হয়নি। এ রায় বাস্তবায়ন করতে গেলে যে ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা দরকার তা নজরে পড়েনি।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অবদান শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময় নয়, পুরো পাকিস্তান আমলেই তারা স্বাধীন বাংলাদেশের, বাংলা ভাষার ন্যায়বিচারে প্রস্তাব ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। তাদের এ অবদানের স্বীকৃতির প্রথম ধাপ হোক তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা, তারপর সেসব শহীদ বুদ্ধিজীবীর জীবনী ও সৃষ্টিকর্ম সংরক্ষণ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার রায় কার্যকর।

লেখক : সভাপতি, প্রজন্ম ৭১, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা