মেঘনা গুহঠাকুরতা
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৩৯ পিএম
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৫১ পিএম
রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। ছবি : ফারহান ফয়সাল
জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- আমাদের প্রথম সংবিধান এ চার স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। এ সংবিধানই ছিল স্বাধীন যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল তার প্রতিফলন।
দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পাঁচ বছর যেতে না যেতেই সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা হারিয়ে গেল সংবিধান থেকে। থেকে গেল জাতীয়তাবাদ আর গণতন্ত্র।
জাতীয়তাবাদও বিভাজিত হয়েছে নানাভাবে। আর গণতন্ত্র যে রূপ নিয়েছে বর্তমানে বাংলাদেশে, তা থেকেও না থাকার মতো। গণতন্ত্র ছাড়া বাংলাদেশ বাঁচতে পারে না। কারণ ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে কোনো একক শক্তি কখনও তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে বলে আমি মনে করি না। তাই গণতন্ত্র খুব প্রয়োজন। আর এটা অবশ্যই হবে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র।
অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের চর্চা কমে গেছে। এটা হতে পারে বাকস্বাধীনতা, নিরাপদে ভোট দেওয়া, ব্যক্তিগত ও নিজ সম্পদের সুরক্ষাসহ নানা মাধ্যমে। বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি, নিরাপত্তার বিষয়গুলো বেশ নড়বড়ে। এসব ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া যে স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা আমরা বলছি, তা গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।
এটা অবশ্যই বলতে হবে যে, অবকাঠামোগত দিক থেকে আমরা উন্নত হয়েছি। উড়ালসড়ক, বড় সেতু, নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল, রাস্তাÑ এসব আমরা দেখছি। কিন্তু জীবনের যে মৌলিক চাহিদাÑ শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেসবের দিক থেকে কতটা উন্নতি করতে পেরেছি, প্রশ্ন থেকে যায়। শিক্ষার ক্ষেত্রে চেষ্টাটা হয়তো আছে। কোভিড মহামারি পার করেছি আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোয়। এ মহামারি আমাদের বিপন্ন করেছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। এখনও এ আঘাত থেকে আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারিনি।
মানুষের কল্যাণে আসবে এমন কর্মকাণ্ডে আমাদের নজর দিতে হবে। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, সেই সঙ্গে প্রয়োজন রূপান্তর। এ রূপান্তর নানাভাবে হতে পারে। মানুষের মনের রূপান্তর ঘটাতে হবে, মানুষের বিভিন্ন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বাকস্বাধীনতায় নজর দিতে হবে। অন্য ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের অনেক কিছুই পাওয়ার আছে। এ বিষয়গুলো নির্ভর করবে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা টিকিয়ে রাখতে পারি, মানুষের অংশগ্রহণ কতটা নিশ্চিত করতে পারি তার ওপর।
উন্নয়ন প্রসঙ্গে যদি আবারও বলি, উন্নয়ন হয়েছে প্রবৃদ্ধিগত দিক থেকে। অমর্ত্য সেনের মতো অর্থনীতিবিদ পর্যন্ত বলেছেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন হয়েছে বেশি। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে যে জীবনমানের উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তার অনেকটাই সম্ভব হয়েছে বেসরকারি মাধ্যমে। সরকার যেখানে আগ বাড়িয়ে যেতে পারেনি, সেখানে পৌঁছে গেছে বেসরকারি সংস্থাগুলো। দুই পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমেই এটা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন আমরা দেখছি, সিভিল সোসাইটির এ কাজগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এ সংকোচন খুব একটা মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। কারণ এ সংস্থাগুলো দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্যই কাজ করছে। সরকারেরও উদ্দেশ্য একই বলে মনে করি। যেখানে দুই পক্ষেরই লক্ষ্য এক, তখন সেখানে কেন প্রতিযোগিতার কথা বলা হচ্ছে? এ বৈরীভাব সার্বিকভাবে জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
নারীমুক্তি বা নারীস্বাধীনতা প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গেলে বলতে হয়, নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে রাষ্ট্রেরই বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি পরিবর্তন আনতে হবে সমাজেও। রূপান্তরের যে কথা বলেছি লেখার শুরুতে, নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে হবে। এ কাঠামোর মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়ই পরিবার ও সমাজে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় রত হয়। এ পদ্ধতির রূপান্তর ঘটাতে হবে, পরিবর্তন করতে হবে। শুধু আইন করেই নারীমুক্তি আসবে না। যৌতুকবিরোধী আইনের কথা যদি বলি, এ আইন তৈরি হয়েছে অনেক আগে। কিন্তু যৌতুক কি বন্ধ হয়েছে? হয়নি। কোনো না কোনো ভাবে যৌতুকের প্রচলন রয়েই গেছে। ফলে এটা যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এ বোধ আর কাজ করছে না। তাই আবারও বলছি, এসব বদলাতে হলে নারীর উন্নয়নে সর্বোপরি সবার মঙ্গলের জন্য প্রয়োজন সামাজিক পরিবর্তন।
প্রথম সংবিধান থেকে যে দুটি স্তম্ভ বাদ দেওয়া হয়েছেÑ ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্র; অর্থাৎ আমি যে ধর্মেরই হই না কেন, রাষ্ট্র সবাইকে সমান চোখে দেখবে। সেটা শুধু ধর্মীয় গ্রন্থপাঠের মাধ্যমে হয় না। মানুষের আচার-আচরণের মধ্যে থাকতে হবে। সমাজের পরিবর্তনেই এটা সম্ভব। অন্যদিকে সমাজতন্ত্র, যা মূলধারা থেকে রূপান্তরিত আকারে ধারণ করেছিলাম আমরা সংবিধানে; এর মূল কথা ছিল, সমতা বা সবার সমান অধিকার। এ সমতারও বড় অভাব। আমাদের শ্রেণিসংগ্রাম আছে কিন্তু সমাজে শ্রেণিগত যে পরিবর্তনের প্রয়োজন তা হয়নি। এ পরিবর্তন পেশা, ধর্ম, লিঙ্গ সর্বোপরি সকল পর্যায়ে হওয়ার কথা ছিল। হয়নি বলেই বৈষম্য দেখা যাচ্ছে সমাজের প্রতিটি স্তরে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের যে বুদ্ধিজীবীরা শহীদ হয়েছেন, তারা কিন্তু রাষ্ট্রের উন্নতির চেয়ে সামাজিক উন্নয়ন বা রূপান্তরের স্বপ্নই দেখেছিলেন। এ রূপান্তর কবে ঘটবে, কীভাবে ঘটবে জানা নেই। আগামী প্রজন্ম হয়তো হাল ধরবে, তবেই যদি বৈষম্যহীন, ধর্মীয় সম্প্রীতির, সামাজিকভাবে উন্নত স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে ওঠে; যার মাধ্যমে মানবিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, রিসার্চ ইনেশিয়েটিভস বাংলাদেশ, শহীদ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কন্যা