বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস আজ
রাজবংশী রায়
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ১০:২৭ এএম
আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:২৫ পিএম
দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সি নারী-পুরুষ আক্রান্ত হচ্ছে এ রোগে। শহর থেকে গ্রাম- সর্বত্র প্রায় সমান হারে ডায়াবেটিস ছড়িয়ে পড়ছে। যে হারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এই নীরব ঘাতকের শিকার। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) পৃথক জরিপে এর প্রমাণ মিলেছে।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ওপর করা সর্বশেষ জরিপে দেখা যায়, ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আর ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ প্রি-ডায়াবেটিস অবস্থায় আছে। এর আগে ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটির আরেক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এ হিসাবে মোট জনগোষ্ঠীর এক-চতুর্থাংশেরও বেশি ডায়াবেটিসের শিকার। আক্রান্তদের অর্ধেকই জানে না যে তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
দেশের গ্রামাঞ্চলে কত সংখ্যক মানুষ নীরব ঘাতক এই ডায়াবেটিসের শিকার তা খুঁজে বের করতে জরিপ পরিচালনার উদ্যোগ নেয় বাডাসের সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ শাখা। এ লক্ষ্যে ঢাকা বিভাগের মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় ও সিঙ্গাইর উপজেলা, নরসিংদীর মনোহরদী ও রায়গঞ্জ উপজেলা, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা, ঢাকার কেরানীগঞ্জ এবং টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী ও সখীপুরÑ এই ৮ উপজেলায় ১০ হাজার ২২৩ জন মানুষের রক্তসহ শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত এক বছর ধরে করা এ জরিপে দেখা যায়, দেশের গ্রামাঞ্চলের ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
জরিপকাজে যুক্ত বাডাসের সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ডা. বিশ্বজিৎ ভৌমিক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, দেশের গ্রামাঞ্চলে কত সংখ্যক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তা খুঁজে দেখতে গিয়ে জরিপকাজের সঙ্গে যুক্ত যারা, সবাই বিস্মিত হয়েছেন। আটটি উপজেলায় ১৪ দশমিক ২ শতাংশ ডায়াবেটিস আক্রান্ত এবং ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ প্রি-ডায়াবেটিস অবস্থায় আছে। এর আগে ডায়াবেটিক সমিতির জরিপে ১৯৯৯ সালে ২ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০০৪ সালে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত পাওয়া যায়।
এরপর দীর্ঘদিন আর কোনো জরিপ হয়নি। ২০২০ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন-কমিউনিক্যাবল ডিজিস কন্ট্রোল কর্মসূচির (এনসিডি) সহায়তায় দেশব্যাপী জরিপ করে ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ ডায়াবেটিস আক্রান্ত পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, গত ৯ বছরের ব্যবধানে ডায়াবেটিস আক্রান্ত বেড়েছে ১৭ দশমিক ৯ ভাগ। এই হারে বাড়তে থাকলে আগামী ২০৩০ সালে পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে তা সহজেই অনুমেয়। শহরের পাশাপাশি গ্রামও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সুতরাং ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এ অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি জানুন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।’ আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩১ লাখ। প্রতিষ্ঠানটি ধারণা করছে, ২০৪৫ সালে রোগীর সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডির ২০২২-২৩ সালের স্টেপ সার্ভে বলছে, দেশে প্রতি ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আর ডায়াবেটিক সমিতি বলছে, এ সংখ্যা প্রতি পাঁচজনে একজন। একই সঙ্গে চারজন নারীর মধ্যে একজন গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী এক বছরের মধ্যেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে।
শুধু প্রাপ্তবয়স্করাই নয় শিশুদের মধ্যেও বাড়ছে ডায়াবেটিস। ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। আশঙ্কার কথা, আক্রান্তদের অর্ধেকের বেশি তাদের রোগ সম্পর্কে অবগত নয়। উপসর্গ না থাকায় বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করেন না।
ফলে দেরিতে শনাক্ত হওয়ায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ রোগী ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা নিয়ে আসে। গবেষণা বলছে, ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মধ্যে শুধু ২০ শতাংশের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যার ফলে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা বিশেষ করে চোখ, কিডনি, হার্ট ও স্নায়ু রোগ দ্রুত বাড়ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশের স্বাস্থ্য খাতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডায়াবেটিসের কারণে প্রতি বছর ৫ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এ রোগের কারণে অর্থনৈতিক চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডায়াবেটিসের ওষুধ, ইনসুলিন সবকিছুরই দাম দিন দিন বাড়ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, কেবল ডায়াবেটিসের হার কমাতে পারলে স্বাস্থ্য খাতেই ১১ শতাংশ ব্যয় কমানো সম্ভব হবে।
বাডাস সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। আক্রান্ত ব্যক্তিকে জীবনভর রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিতÑ শনাক্তের ১০-১২ বছর আগেই শরীরে মূলত টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগ সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় শনাক্ত করা গেলে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ফিনল্যান্ড, চীন, ভারত ও আমেরিকায় পরিচালিত গবেষণার মতো বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালিত ডায়াবেটিস প্রতিরোধবিষয়ক গবেষণায় প্রি-ডায়াবেটিস শনাক্ত মানুষের শুধুমাত্র জীবনযাপনে শৃঙ্খলা ও পরিবর্তনের মাধ্যমে ৬০ শতাংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। সুতরাং ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডি কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সরকারি হাসপাতালে এনসিডি কর্নার চালু করা হয়েছে। সেখান থেকে রোগীরা ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও পরামর্শ নিতে পারবেন। একই সঙ্গে সারা দেশে গ্রামপর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতেও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয়। ডায়াবেটিক সমিতির মাধ্যমেও আক্রান্তদের সেবা দেওয়া হয়। সেখানে প্রতিবছর সরকারিভাবে অর্থ বরাদ্দ থাকে। তবে এর পরিধি আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
ডায়াবেটিস কী, কেন মানুষ আক্রান্ত হয়
বারডেমের এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ডায়াবেটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত রোগ। মানবদেহে ইনসুলিন নামক হরমোনের ঘাটতি হলে কিংবা উৎপাদিত ইনসুলিন কার্যকরভাবে শরীরে ব্যবহার না হলে অথবা শরীরের ইনসুলিন নিষ্ক্রিয় থাকলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়।
এ গ্লুকোজ পরে প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। এ অবস্থার নামই ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস দুই প্রকার। টাইপ-১ বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস এবং টাইপ-২ বা ইনসুলিন অনির্ভর ডায়াবেটিস। জন্ম কিংবা পরিবেশগত কিছু কারণে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের প্রকোপ দেখা দেয়। ইনসুলিন নিয়েই এসব রোগীকে বেঁচে থাকতে হয়। অতিরিক্ত ওজন, মেদবাহুল্য, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, উচ্চ শর্করা ও কম আঁশযুক্ত খাদ্যাভ্যাস থাকলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হতে পারে। এ ছাড়া পারিবারিক ইতিহাস, জন্মের সময় ওজন কম থাকা, প্রবীণদের মধ্যেও টাইপ-২ ডায়াবেটিস দেখা যায়। ডায়াবেটিস রোগীরা হৃদযন্ত্র ও রক্তনালি, কিডনি, স্নায়ুতন্ত্রসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে বলে জানান তিনি।
প্রতিরোধের উপায়
বিএসএমএমইউর এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ডায়াবেটিস একবার হলে সারা জীবন বহন করতে হয়। এই রোগ কোনোভাবেই ওষুধ দিয়ে কমানো সম্ভব নয়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। বাড়াতে হবে শারীরিক পরিশ্রম।
দৈনিক কমপক্ষে আধাঘণ্টা হাঁটা প্রয়োজন। খাদ্যতালিকা থেকে মিষ্টিজাতীয় খাবার পুরোপুরি বাদ দিতে হবে। পরিমিতভাবে খেতে হবে শর্করা ও মাংসজাতীয় খাবার। খাদ্যতালিকায় বেশি পরিমাণে রাখতে হবে শাকসবজিসহ আঁশযুক্ত খাবার। সঠিক ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে টাইপ-২ ডায়াবেটিস শতকরা ৭০ ভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। সুষম খাবার গ্রহণ, অতিমাত্রায় কোমল পানীয় ও ফাস্ট ফুড পরিহার, নিয়মিত ব্যায়াম এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো চললে এ রোগ প্রতিরোধ সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
কর্মসূচি
দিবসটি উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার বাডাসের পক্ষ থেকে আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচিও পালিত হবে। একই সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি পালন করবে।