ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১১:৪১ এএম
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:৩৯ পিএম
পানি উন্নয়ন বোর্ড
ঢাকা শহর সমন্বিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় সাড়ে ১৮ কিলোমিটার এলাকার দুদিকের জমি দখল হয়ে গেছে। এসব জমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। সারা দেশেই পাউবোর বহু জমি চলে গেছে প্রভাবশালীদের দখলে। জেলা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়ে অভিযান চালালেও সেসব জমি উদ্ধারে অগ্রগতি কম। তার ওপর রয়েছে আইনের নানা ফাঁকফোকর। মামলার কারণে অনেক ক্ষেত্রে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। দখল হওয়া জমির বেশিরভাগ বেড়িবাঁধ, ছোট ছোট নদী ও জলাশয়। দখলদাররা এসব জমিতে আবাসন প্রকল্প, বিপণিবিতান, স্কুল-কলেজ, ডেইরি ফার্ম, গাড়ির গ্যারেজ, মাছের ঘের ইত্যাদি তৈরি করে রেখেছেন।
এমন চিত্র দেখা যাবে ঢাকা, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাতেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় সাত হাজার একর জমি বেদখল হয়ে গেছে। যার মূল্য প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। পাউবো অধিগৃহীত এসব জমি ভুয়া অবমুক্ত দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেকর্ড করা হয়েছে। মোটা অর্থের বিনিময়ে পাউবো ও স্থানীয় ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এসব জমি বেদখল হয়েছে। এমনকি স্থানীয় ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দখলকারীরা নিজেদের নামে রেজিস্ট্রিও করে নিয়েছেন। পাউবো থেকে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো অবৈধ স্থাপনার তালিকা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন পাউবোর ১০টি জোনের অধিগ্রহণ করা সরকারি জমির পরিমাণ ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩৫ একর। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে ব্যবহার হচ্ছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৩৫ একর। প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণে সংরক্ষিত জমি ১৮ হাজার ৮৯৯ একর। পাউবো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের বেদখল হওয়া জমির একটি তালিকা চূড়ান্ত করেছে। তাতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলের নেতা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পাউবোর জমি দখল করে সেখানে বহুতল ভবন, মার্কেট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। অনেকেই ভূমি অফিস থেকে ভুয়া কাগজ তৈরি করে নিজেদের নামে জমির দলিল করে নিয়েছেন। কোথাও কোথাও অন্যদের কাছে জমি বিক্রির ঘটনা ঘটেছে। কেউ কেউ আদালতে মামলা করায় পাউবোর উদ্ধার কার্যক্রম স্থগিত রাখতে হচ্ছে। তবে এবার জোরেশোরে অভিযান চালানো হবে বলে পাউবোর সূত্রে জানা গেছে। এর জন্য ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছে পাউবো। যার পরিপ্রেক্ষিতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকদের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বলেন, অবৈধ দখলে থাকা পাউবোর জমি উদ্ধারে তৎপরতা চলছে। সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসিদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অবৈধ স্থাপনা উদ্ধারে সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় জমি উদ্ধারও হয়েছে। আরও উদ্ধার তৎপরতা চলছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ষাটের দশকে নির্মাণ করা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৯ হাজার ২২৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৮ হাজার ৪২৯ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, ৪ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার উপকূলীয় বাঁধ, ২ হাজার ৪৩৬ কিলোমিটার ডুবন্ত বাঁধ এবং সেচ খালের ডাইক বাঁধ রয়েছে ৩ হাজার ৬১২ কিলোমিটার। সারা দেশের প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ওপর ৫ হাজার ৩৩১ কিলোমিটার সরকারি বিভিন্ন সংস্থা রাস্তা নির্মাণ করেছে। এলজিইডি ৪ হাজার ১৩৮ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করেছে বেড়িবাঁধের ওপর। সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং সিটি করপোরেশন ১ হাজার ৩২৩ কিলোমিটার ও বিভিন্ন পৌরসভা বেড়িবাঁধের ওপর রাস্তা নির্মাণ করে দখল করেছে ৮৭০ কিলোমিটার। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভাঙার শঙ্কা দেখা দেয়। অথচ বাঁধ উদ্ধারে তেমন তৎপরতা নেই। বন্যায় উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী জেলার কয়েক কিলোমিটার বাঁধ বিলীন হয়ে গেছে।
এদিকে রাজধানীতে একটি মহল ঢাকা শহর সমন্বিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের শাহ আলী, দারুস সালাম, জহুরাবাদ, হরিরামপুর এলাকার সাড়ে তিন কিলোমিটারের উভয় পাশে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছে। পাউবোর তালিকা অনুযায়ী দখলকারীরা হলেন- শাহ আলী থানার গোড়ানচট বাড়ির আজগর আলী, লোকমান হোসেন, ডা. একেএম আব্দুস সালাম, নবাবের বাগ উত্তরপাড়ার আজগর আলী, আলকাস মিয়া, রেজাউল হক ভূইয়া বাহার, ফারুক আহমেদ, ফজলুল হক, কাওসার হোসেনসহ ২১ জন। নবাবের বাগ মৌজায় আব্দুল আলিম, নাহিদ, আব্দুল আজিজ, মিসেস আসমা বেগম আবু কালাম দেলোয়ার হোসেনসহ ২১ জন। বিশিলি মৌজায় হাজী ওসমান গণি, খোকন মিয়া, বাদশা মিয়া, কাজীপুর কাঁচাবাজার মসজিদ, রুহুল আমিন, মানিক মিয়াসহ ২৮ জন। একই থানাধীন ছোট দিয়াবাড়ি মৌজায় মিনারা বেগম, আজিজ সিকদারসহ ৩৯ জন। এছাড়া দারুস সালাম থানাধীন জহুরাবাদ মৌজায় আমজাদ মোল্লাহ, রূপবান, জাহিদ হোসেন, বাবুল মিয়া, ফারুক খান, আবদুর রশিদ, আবু তাহের মিয়া এবং হরিরামপুর মৌজায় দিলু মাহাজন, আবুল কাশেম গং, আলী আকবর, হুমায়ুন কবির গং ও ছায়েম মন্ডল। সব মিলিয়ে ১৭১ জন এসব জমি অবৈধ দখলে রেখেছেন। তারা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। বেশিরভাগই সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক প্রকৌশলী এসএম শহিদুল ইসলাম বলেন, পাউবোর ৭ হাজার একর জমি বিভিন্ন ব্যক্তি অবৈধভাবে দখল করেছেন। এসব জমির বেশিরভাগ বেড়িবাঁধ এবং ছোট ছোট নদী ও জলাশয়। এগুলো উচ্ছেদের জন্য বিভিন্ন জেলায় প্রশাসনের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি।