দাম বেঁধে দেওয়ার এক মাস
ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৩ ১১:১৭ এএম
আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:০৯ পিএম
পুরো এক মাস তদারকি করেও নির্ধারণ করে দেওয়া দামে বাজারে আলু বিক্রি নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। গত ১৪ সেপ্টেম্বর খুচরা বাজারে আলু ৩৫-৩৬ টাকা কেজি, দেশি পেঁয়াজ ৬৪-৬৫ টাকা কেজি ও ফার্মের মুরগির প্রতিটি ডিম ১২ টাকা করে ৪৮ টাকা হালি দর নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সে সময় আলুর কেজি ছিল ৪৮-৫০ টাকা ও পেঁয়াজ ৮০-৯০ টাকা এবং ডিমের হালি ৫০-৫৫ টাকা। গত এক মাসেও এই বাজারচিত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং এই সময়ের মধ্যে ডিম ও পেঁয়াজের দাম আরও বেড়েছে। আলুর বাড়তি দামও বহাল রয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজধানীসহ দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের বাজারগুলোতে অভিযান অব্যাহত রাখলেও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি।
গতকাল শনিবার রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার ভাই ভাই সুপার মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেক দোকানেই আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতে। সেখানে কথা হয় বিক্রেতা সোহানুর রহমান, আক্তার হোসেন ও আশিকুর রহমানের সঙ্গে। তারা জানান, অনেক দিন ধরেই আলু ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আক্তার হোসেন বলেন, সরকার দর নির্ধারণ করে দেওয়ার তিন দিনের মাথায় দাম আরও বেড়ে যায়। সেই দাম আর কমেনি। বাজারটিতে কথা হয় মালয়েশিয়ার এরিকান ইন্টারন্যাশনাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. জিয়াউল করিমের সঙ্গে। এ বাজার থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে আলু এবং ৫৫ টাকা হালিতে ডিম কেনার কথা জানান তিনি। রাজধানীর আদাবর এলাকার বাসিন্দা আবু বকর ও মুগদার মাহফুজ খানও ৫০ টাকা কেজিতে আলু কেনার কথা জানান।
দেশে ২০২০ সালে আলুর সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল কেজিপ্রতি ৫০/৫৫ টাকায়। তখন আলু, পেঁয়াজ ও চালের দাম বৃদ্ধির কারণ ও প্রতিকার খুঁজতে প্রায় ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি গবেষণা করেছিল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)। সেই গবেষণায় মূল্যবৃদ্ধির ১২টি কারণ তুলে ধরে ১০ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল। যদিও সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলু নিয়ে গবেষণার সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে হয়তো আজ বাজারের এই অবস্থা হতো না।
কী বলছে গবেষণা
‘অ্যাভেইলেবিলিটি অ্যান্ড প্রাইস ভোলাটিলিটি অব রাইস, পটেটো অ্যান্ড অনিয়ন ইন বাংলাদেশ : অ্যান ইন্টার ইনস্টিটিউশনাল স্টাডি ২০২০’ শীর্ষক ওই গবেষণাটি হয় ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২৪ ডিসেম্বর কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের উপস্থিতিতে তা প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭২ সাল থেকে আলুর জমির পরিমাণ ৪.৫৮%, উৎপাদন ৬.৬১% এবং ফলন ১.৯৫% বেড়েছে। তবে স্থানীয় জাতের চেয়ে উন্নত জাতের উৎপাদন বেড়েছে বেশি। বিশেষ করে ১৯৭৯-৮০ সালে উৎপাদনে উন্নত জাতের আলুর অংশ ছিল ৪৬% এবং ২০১৯-২০ সালে বেড়েছে হয় ৯১ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, আলুর সর্বনিম্ন দাম থাকে মার্চে এবং সবচেয়ে বেশি হয় ডিসেম্বরে। ২৭ অক্টোবর ২০২০ সালে আলুর দর সরকার পুনর্নির্ধারণ করলে দাম বৃদ্ধির প্রবণতা কমে যায়। তখন কেজিপ্রতি আলুর উৎপাদন খরচ ছিল ৮.২৫ টাকা। সেই আলু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বিক্রি হয়েছিল ৫০/৫৫ টাকায়। মার্চে সবচেয়ে বেশি আলু হিমাগারে রাখা হয় বলে গবেষণায় উঠে আসে। তাতে বলা হয়, মার্চে ৬৫%, এপ্রিলে ২৫%, মে’তে ৬% এবং জুনে ৪ শতাংশ আলু হিমাগারে রাখা হয়। আর হিমাগার থেকে বের করার ক্ষেত্রে জুনে ৮%, জুলাই ও আগস্টে ১০%, সেপ্টেম্বরে ২০%, অক্টোবরে ৩০%, নভেম্বরে ২০% ও ডিসেম্বরে ২ শতাংশ।
ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলমকে গবেষণার প্রধান সমন্বয়ক ও বিএআরসির কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক ড. মো. মোশাররফ উদ্দিন মোল্লাকে সদস্য সচিব করা হয়। গবেষণাটি ‘দ্য বাংলাদেশ জার্নাল অব এগ্রিকালচার ইকোনমিক্সে’ ২০২১ সালের ৩০ জুন প্রকাশিত হয়। তা ছাড়া তিনটি পণ্যের আলাদা আলাদা গবেষণা করে পরে একক প্রতিবেদন তৈরি করে বিএআরসির ওয়েবসাইটেও দেওয়া হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে আলুর দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হয়, ভবিষ্যতে মূল্য বৃদ্ধির আশায় কৃষক ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আলুর মজুদ এবং হিমাগার থেকে আলুর কম সরবরাহ; হিমাগারে মজুদকৃত আলুর রসিদ পুনঃহস্তান্তর; মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বিপুল মজুদ এবং কৃত্রিম সংকট তৈরি; বাজারে সরকারের সীমিত নিয়ন্ত্রণ এবং প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তথ্যের অভাব ও অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি অন্যতম। গবেষকরা বলছেন, বর্তমানে আলুর বাজারে অস্থিরতার পেছনে ২০২০ সালের কারণগুলোই বিদ্যমান রয়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর দেশে আলু উৎপাদনের পরিমাণ, উৎপাদন খরচ ও বিপণনব্যবস্থা সম্পর্কে আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে জানায়, এ বছর আলুর উৎপাদন ও রপ্তানি অন্য বছরের চেয়ে কমেছে। ২০২২ সালে হিমাগারে আলুর মজুদ ছিল ২৭ লাখ ৯ হাজার টন, যা ধারণক্ষমতার ৯২ শতাংশ। এবার তা নেমে এসেছে ২৪ লাখ ৪২ হাজার টনে।
এ সম্পর্কে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, দেশে ৪ শতাধিক হিমাগার রয়েছে। তার মধ্যে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ১৫৫টি। চলতি বছরের মার্চে ১৫৫টি হিমাগারে আলু মজুদ ছিল ১৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৯৯ মেট্রিক টন। ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মজুদের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৭৯২ টন। গত বছরের শুরুতে মজুদ ছিল ১৩ লাখ ৩০ হাজার ১২৬ টন এবং সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ লাখ ২৮ হাজার ৬৬৯ টন।
এদিকে ১৯ সেপ্টেম্বর রংপুর, জয়পুরহাট, মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া ও রাজশাহীসহ ৫ জেলার ২৭০টি হিমাগারে ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৯৬ টন আলু মজুদ আছে। তার মধ্যে খাবারের আলু ৭ লাখ ৪ হাজার ৫৫৮ টন এবং বীজের ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৬০০ টন।
আলুর মূল্য স্থিতিশীল রাখতে ১০ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল বিএআরসির গবেষণা প্রতিবেদনে। এক. কৃষি মূল্য কমিশন গঠন করে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সহায়ক মূল্য ঘোষণা করা। দুই. উৎপাদন, চাহিদা, সরবরাহ এবং বাজার মূল্যের তথ্যাবলিতে অস্পষ্টতা দূর করা। তিন. হিমাগারে আলু সংরক্ষণ ও অবমুক্তকরণ সরকারের নিয়ন্ত্রণে ও নজরদারির মধ্যে রাখা। চার. আলুর বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। পাঁচ. সরকারের আলুর উৎপাদন, চাহিদা, সরবরাহ ও মূল্য সংক্রান্ত তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করা এবং হালনাগাদ রাখা। ছয়. আলুর উৎপাদন, চাহিদা, সরবরাহ ও মূল্য সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে গুজব সৃষ্টিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। সাত. আলু ও আলুর তৈরি বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা। আট. প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শিল্পে ব্যবহারের উপযোগী আলুর জাত উদ্ভাবন এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করা। নয়. সংকটকালে ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) মাধ্যমে আলুর বিক্রয় কার্যক্রম বাড়ানো এবং দশ. সরকারিভাবে আলুর মজুদ গড়ে তোলা।
গবেষক দলের সদস্য সচিব ড. মো. মোশাররফ উদ্দিন মোল্লা বলেন, ২০২০ সালে আলুর দাম ৫০/৫৫ টাকা উঠে গেলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে বেশকিছু সুপারিশও করা হয়েছিল। সেসব সুপারিশ আমলে নেওয়া না নেওয়া তো সরকারের বিষয়।
বিএআরসির গবেষণা দলের সদস্য ও বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, গবেষণার মূল্যায়ন না হলে সেটির কোনো অর্থ হয় না। দেশে প্রায় প্রতি ২/৩ বছরের মধ্যে আলুর দাম কমে বা বেড়ে যায়। কৃষক লোকসান খায়। তারা আবাদ কমিয়ে দেয়। এসব কারণ চিহ্নিত করে সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণে আলু কিনে নিতে পারে, পরে চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ছাড়বে। তিনি বলেন, কোন জেলার হিমাগার থেকে কত টাকা দামে আলু বিক্রি হলো প্রতিদিন যদি এই হিসাবটা অনলাইনে দেওয়া যায় তাহলেও বাজার ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখা যাবে। মাঝখানের হাত বদলে তেমন কোনো সমস্যা তৈরি হবে না।
গবেষণার প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সরকার টাকা খরচ করে গবেষণা করিয়েছে কিন্তু সেটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি। তাহলে গবেষণা করে কার কী উপকার হলো? গবেষণার ভালো দিকগুলো মূল্যায়ন করা দরকার।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। গবেষকরা অনেক কষ্ট করে একটি কাজ করে থাকেন। সমস্যা সমাধানে এগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা অনেক সময় তা আমলে নেন না।