ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী
প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:৩১ এএম
আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:৩৩ এএম
ঢাকা-ভাঙ্গা রেললাইন। প্রবা ফাইল ফটো
পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত নতুন রেলপথ উদ্বোধন হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। পদ্মা সেতু চালুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের দ্বার খুলেছে। সহজ হয়েছে এই অঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের যাতায়াত। এবার স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে চলবে যাত্রীবাহী ট্রেন। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রেলপথ উদ্বোধনের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের আরেকটি স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।
জানা গেছে, আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ রেলপথের মুন্সীগঞ্জের মাওয়া স্টেশনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। পরে তিনি মাওয়া রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা স্টেশনে যাবেন। সেখানে তিনি একটি জনসভায় যোগদান করবেন।
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন, চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেবেন।
আজ উদ্বোধন হলেও আগামী মাসের শুরুর দিকে এ রেলপথে যাত্রী নিয়ে ট্রেনের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। আর নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত মোট ১০টি স্টেশনের মধ্যে ভাঙ্গা, শিবচর ও মাওয়া স্টেশনে ট্রেন থামবে।
ঢাকা-ভাঙ্গা-যশোর ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথের ঢাকা-ভাঙ্গা ৮২ কিলোমিটার পথে ট্রেন চলাচল শুরু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটি বড় বিপ্লব ঘটবে বলে মনে করেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণাকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ঢাকা-ভাঙ্গা রেললাইন মাত্র ৮২ কিলোমিটার পথ হলেও এ নবনির্মিত রেললাইন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে অনন্য মাত্রা যোগ করবে। কম সময়ে ও নিরাপদে মানুষ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে রাজধানীতে আসতে পারবে। এটি পণ্য পরিবহন ও শিল্পায়নেও ভূমিকা রাখতে পারে, যদি সরকার সঠিক ভূমি পরিকল্পনা নিতে পারে। এ রেলপথকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা যেতে পারে।
মো. হাদিউজ্জামান মনে করেন, নতুন রেলপথের সুবিধা শুধু মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুরের মানুষই সুবিধা পাবে না, খুলনা, রাজশাহী, যশোর এমনকি কলকাতার যাতায়াতও সহজ হবে।
পদ্মা সেতু দিয়ে চলবে যে ৫ ট্রেন
প্রাথমিকভাবে পদ্মা সেতু দিয়ে পাঁচটি যাত্রীবাহী ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, এই পাঁচটি ট্রেনের মধ্যে খুলনা-ঢাকা রুটের আন্তঃনগর ট্রেন চিত্রা অথবা সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও ঢাকা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল এক্সপ্রেস বর্তমান রুট পরিবর্তন করে পদ্মা সেতু হয়ে চলাচল করবে। এদিকে ঢাকা-কলকাতা রুটের আন্তর্জাতিক ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেসও রুট পরিবর্তন করে পদ্মা সেতু হয়ে চলাচল করবে।
প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, রাজশাহী থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত চলাচল করা আন্তঃনগর ট্রেন মধুমতি এক্সপ্রেসও রাজশাহী থেকে ভাঙ্গা হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এদিকে খুলনা থেকে গোয়ালন্দ রুটে চলাচলকারী মেইল ট্রেন নকশিকাঁথা এক্সপ্রেসকে ভাঙ্গা হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
ভাড়া কত হবে
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন পর্যন্ত বাণিজ্যিক দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার। প্রস্তাব অনুযায়ী, আন্তঃনগর ট্রেনের নন-এসি ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৫০ টাকা। আর এসি চেয়ারে ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে ৬৬৭ টাকা। অন্যদিকে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা যেতে বাসযাত্রীদের খরচ পড়ে ২৫০ টাকার মতো। এ ছাড়া আন্তঃনগর তূর্ণা এক্সপ্রেস ট্রেনের শোভন চেয়ারে বসে (নন-এসি) ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে ভাড়া লাগে ৩৪৫ টাকা। এসি চেয়ারে ভাড়া ৬৫৬ টাকা। এই পথের দূরত্ব ৩২১ কিলোমিটার। সে হিসাবে ঢাকা থেকে ভাঙ্গার ভাড়া চট্টগ্রামের চেয়েও বেশি।
রেল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রস্তাবনায় বলছে, ট্রেনের ভাড়া বাড়ার পেছনে প্রধান দুটি বিষয় উঠে এসেছে। একটি পদ্মা সেতু, অপরটি গেন্ডারিয়া-কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত উড়ালপথ। এই পথের জন্য অতিরিক্ত পথ যোগ করে ভাড়া বেশি ধরা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর প্রতি কিলোমিটারকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্ব ধরে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুকে ১৫৪ কিলোমিটার রেলপথ ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে গেন্ডারিয়া থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত উড়ালপথের প্রতি কিলোমিটারকে ধরা হয়েছে ৫ কিলোমিটার। প্রায় ২৩ কিলোমিটার উড়ালপথকে ১১৫ কিলোমিটার রেলপথ ধরা হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এজন্যই ঢাকা থেকে ভাঙ্গার দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার হলেও রেলওয়ে পদ্মা সেতু ও কেরানীগঞ্জের উড়ালসেতুর জন্য দূরত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫৩ কিলোমিটার।
বর্তমানে দেশে লোকাল, মেইল, কমিউটার ও আন্তঃনগরÑ এই চার ধরনের ট্রেন চলাচল করে। লোকাল ট্রেনের ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ৩৯ পয়সা আর আন্তঃনগর ট্রেনের ভাড়া নন-এসি শ্রেণির ভিত্তি ভাড়া ১ টাকা ১৭ পয়সা। আর কিলোমিটারপ্রতি এসি শ্রেণির ভিত্তি ভাড়া ১ টাকা ৯৫ পয়সা।
ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, পদ্মা সেতু ও কেরানীগঞ্জের উড়ালপথের জন্য ভাড়া একটু বেশি হবে। তবে যশোর পর্যন্ত পুরো রেলপথ চালু হয়ে গেলে ভাড়া কমে যাবে।
ভাঙ্গা পর্যন্ত যাত্রীদের জন্য কোনো ছাড় থাকবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনও ছাড় রাখেনি। তবে রাখার নিয়ম রয়েছে। যাত্রী চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ঠিক করা হবে। তবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বাসের চেয়ে যেন ট্রেনের ভাড়া বেশি না হয় সে চিন্তাও আমাদের রয়েছে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকার কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মিত হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ঢাকা-মাওয়া ৪০ কিলোমিটার ও মাওয়া-ভাঙ্গা ৪২ কিলোমিটার রেলপথ উদ্বোধন করা হবে। এদিকে প্রকল্পের তৃতীয় অংশ ভাঙ্গা-যশোর ৮৭ কিলোমিটার রেললাইনের নির্মাণকাজ ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে। এ অংশের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭৮ ভাগ।
মাওয়া-ভাঙ্গায় উৎসবের আমেজ
ঢাকা-ভাঙ্গা ট্রেন উদ্বোধন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও ফরিদপুরের ভাঙ্গায় উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। শেষ মুহূর্তের সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পদ্মা সেতুর রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাঈদ আহমেদ।
সরেজমিনে গতকাল সোমবার দেখা গেছে, রেললাইন প্রকল্পের উদ্বোধনকে ঘিরে মাওয়ায় সাজসাজ রব বিরাজ করছে। মাওয়া ও আশপাশের এলাকা সাজানো হয়েছে। মাওয়া রেলস্টেশনের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে সভামঞ্চ। এখানে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সুধী সমাবেশে অংশ নেবেন।
সুধী সমাবেশ শেষ করে প্রধানমন্ত্রী ট্রেনে করে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় যাবেন। ভাঙ্গার ডা. কাজী আবু ইউসুফ স্টেডিয়ামে জেলা আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে তিনি প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন। এ উপলক্ষে ভাঙ্গার সর্বত্র সাজসজ্জা করা হয়েছে। সাজসজ্জার অংশ হিসেবে সড়কজুড়ে টাঙানো হয়েছে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ব্যানার ও ফেস্টুন।
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক জানান, প্রধানমন্ত্রীর সফর নির্বিঘ্ন করতে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। নেতাকর্মীদের মধ্যেও ব্যাপক আনন্দ বিরাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর রেললাইন উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন, যা আমাদের জন্য গর্বের।
ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিম উদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে ভাঙ্গায় নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। সব প্রস্তুতিও ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা দফায় দফায় বৈঠক করেছে। ভাঙ্গা এলাকাজুড়ে নিরাপত্তায় জেলা পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম শুরু করেছে।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালুর পর এবার রেল নিয়ে নতুন স্বপ্ন বুনছে। দক্ষিণের মানুষ ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে রেলপথে ঘরে ফিরবে। রেল ভ্রমণ সব সময়ই নিরাপদ ও সাশ্রয়ী। শুধু যাত্রী নয়, পণ্য পরিবহনেও ব্যবসায়ীরা ঝুঁকবেন রেলপথে।
পারিবারিক সফরে টুঙ্গিপাড়া যাবেন প্রধানমন্ত্রী
ফরিদপুরের ভাঙ্গায় জেলা আওয়ামী লীগের সমাবেশ শেষ করে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টুঙ্গিপাড়া পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধের বেদিতে শ্রদ্ধা জানাবেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও শোভাবর্ধনের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আগমন নির্বিঘ্ন করতে টুঙ্গিপাড়াসহ জেলাজুড়ে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা।
জানা গেছে, জনসভা শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়কপথে টুঙ্গিপাড়া যাবেন। এদিন প্রধানমন্ত্রী টুঙ্গিপাড়ায় রাতযাপন করবেন এবং পরের দিন সকালে সড়কপথে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন। এ সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার ছোট বোন শেখ রেহানাসহ পরিবারের সদস্যরা থাকবেন বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকরা।