প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:৪৩ পিএম
আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:২২ পিএম
২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলস (বর্তমান রাজা তৃতীয়) চার্লসের সঙ্গে বাকিংহাম প্যালেসে মোহাম্মদ রেজোয়ান।
সুইডেনের মারিয়ফ্রেড শহরের গ্রিপশোম ক্যাসেলে আজ বুধবার ওয়ার্ল্ড চিলড্রেনস প্রাইজ (ডব্লিউসিপি) বিতরণ অনুষ্ঠিত হবে। চলতি বছর বাংলাদেশের ‘নৌকাস্কুল’ ধারণার প্রবর্তক মোহাম্মদ রেজোয়ানসহ তিনজন সম্মানজনক পুরস্কারটি পাচ্ছেন।
বুধবার (৪ অক্টোবর) সুইডেনের স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি চলবে। বাংলাদেশ সময় রাত ৮ থেকে অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখা যাবে। অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখতে ভিজিট করুন : worldschildrensprize.org/2023
স্থপতি মোহাম্মদ রেজোয়ানকে বাংলাদেশে নৌকাস্কুল বা ভাসমান স্কুল ধারণার প্রবর্তক ধরা হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছোট ছোট দ্বীপের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ২০০২ সালে নৌকাস্কুলের যাত্রা শুরু করেন তিনি। এতে শিশুদের যেতে হয় না, বরং নৌকাস্কুল ছুটে যায় তাদের কাছে। বর্ষা ছাড়াও বছরজুড়েই এই সুবিধা পায় শিশুরা।
মোহাম্মদ রেজোয়ানের জন্ম নাটোরের চলনবিল এলাকায়, সিধুলাই গ্রামে। ছোট বেলায়ই দেখেছেন, নৌকার অভাবে কত রকম সংকটের মধ্য দিয়ে স্কুলে যেতে হয় শিশুদের, বিশেষ করে মেয়েশিশুদের। সেখান থেকেই শুরু স্বপ্ন বুনন।
স্বাপ্নিক এই উদ্যোক্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের ওই সময়টায় বাচ্চাদের স্কুলে যাওটা খুব কঠিন ছিল। সবার নৌকা ছিল না। গ্রামে একটি নৌকা থাকা ঢাকা শহরের গাড়ি থাকার মতো। আমার সব সময় মনে হয়েছে, এলাকার জন্য কিছু একটা করা উচিত। যখন আমি আর্কিটেকচার পড়লাম, তখন মনে হয়েছে এই জ্ঞানটা আমি কীভাবে এলাকার মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারি। যেহেতু বন্যাকবলিত এলাকা, এখানে যদি কিছু তৈরি করি তা পানিতে চলে যাবে। এখানে স্টেশনারি বা বিল্ডিংয়ের মতো কিছুই করা যাবে না। তাহলে এখানে আসলে কী করা যেতে পারে। তখন আমার মনে হয়েছে, যেহেতু নৌকা ট্রান্সপোর্ট হিসেবে কাজ হয়, তাই এই অঞ্চলের মানুষের জন্য যেটা দরকার স্থানীয়ভাবে ইনোভেটিভ আইডিয়া। আমাদের যে ট্রাডিশনাল নলেজটা আছে, সেটার ওপর ভিত্তি করেই যদি তৈরি করতে পারি, সে ক্ষেত্রে আমরা একটা সাসটেইনেবল সলিউশন (টেকসই সমাধান) আমরা আনতে পারব। আসলে সেভাবেই নৌকা স্কুলের যাত্রা শুরু।’
শুরুতে একটা নৌকা দিয়ে নৌকাস্কুলের যাত্রা শুরু হয়। এখন সেখানে রয়েছে ২৬টি নৌকা। বিশেষভাবে ডিজাইন করা ভাসমান এই স্কুলটিতে রয়েছে সৌরচালিত বিদ্যুৎ। রয়েছে পাঠাগার, ল্যাপটপ, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণব্যবস্থা। স্কুলটি চালু আছে নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে। নৌকাগুলোর ছাদ একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় বানানো হয়েছে, যাতে মানুষ সহজেই এর মধ্য দিয়ে চলাচল করতে পারে। দুই পাশে জানালা রয়েছে। প্রবল বর্ষার কথা চিন্তা করে এখানে মাল্টি লেয়ার ওয়াটার প্রুফ ছাদ ব্যবহার করা হয়েছে। দেশি নৌকার থেকে এই নৌকা অনেক বেশি প্রশস্ত। একসঙ্গে ৩০ জন শিক্ষার্থী এখানে অংশ নিতে পারে।
তবে শুরুটা খুব সহজ ছিল না। নৌকাস্কুল উদ্ভাবনের আগে ১৯৯৮ সালে রেজোয়ান গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থা’। মূলত এই সংস্থার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় নৌকাস্কুলের যাত্রা। শুরুতে মানুষের কাছে এই স্কুলের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। প্রথম মাসে একজন, একজন করে ৩০ জন শিক্ষার্থী আসে। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩ শর বেশি। যখন নৌকাস্কুলের সুবিধাটা অভিভাবক ও শিশুরা বুঝতে পারল তখন থেকেই বাড়তে শুরু করে। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে শিক্ষা দেওয়া হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মুখে থাকা ভারত, চীন, কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়াসহ বিশ্বের আটটি দেশ রেজোয়ানের এই মডেল গ্রহণ করেছে।
গত মে মাসে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে রেজোয়ান ডব্লিউসিপি সম্পর্কে বলেছিলে, সুইডেনভিত্তিক বিশ্ব শিশু পুরস্কার ফাউন্ডেশন ‘বিশ্ব শিশু পুরস্কার’ দিয়ে থাকে। এটা প্রতিবছরই দিয়ে থাকে। এবার ১২টি দেশের শিশুদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে চাইল্ড জুরি করা হয়, তাদের কাছে নমিনেশনগুলো দেওয়া হয়েছিল। তারা তিনজন ব্যক্তিকে ‘শিশু অধিকার নায়ক’ হিসেবে নির্বাচন করেছে।’
মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে তিনি ছাড়াও রয়েছেন একজন কানাডার নাগরিক, অন্যজন ভিয়েতনামের নাগরিক।
কানাডার সিন্ডি ব্ল্যাকস্টক ও ভিয়েতনামের সিন্ডি ব্ল্যাকস্টকও এবার ডব্লিউসিপি পুরস্কার পাচ্ছেন। ব্ল্যাকস্টক নিজ দেশের আদিবাসী শিশুদের অধিকার নিয়ে প্রায় ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন। আর ভিয়েতনামের ব্ল্যাকস্টক ৪০ বছর ধরে তার দেশের এতিম ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাচ করছেন।
মোহাম্মদ রেজোয়ান তার উদ্যোগের মাধ্যমে হাজারো মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে ইতোমধ্যে পেয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অন্তত ১৬টি পুরস্কার। নৌকা স্কুলের ধারণা জাতিসংঘের ফান্ডস অ্যান্ড প্রোগ্রামস (ইউনিসেফ, ইউএনইপি এবং ইউএনডিপি) থেকে ইনোভেশন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের এক্সেস টু লার্নিং অ্যাওয়ার্ড, শাইনিং ওয়ার্ল্ড কম্প্যাশন অ্যাওয়ার্ডসহ (SHINING World Compassion Award.) অনেক স্বীকৃতি।