× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ গেল নিরীহ ভুবনের

মেয়েকে আর ভিডিও কলে দেখা হলো না…

প্রবা প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০০:১০ এএম

আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:৪৫ এএম

সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত নিরীহ ভুবনের স্ত্রী ও মেয়ে। প্রবা ফটো

সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত নিরীহ ভুবনের স্ত্রী ও মেয়ে। প্রবা ফটো

‘তুমি না ভিডিও কলে মেয়েকে দেখতে চেয়েছিলা! এই যে দেখো তোমার মেয়ে, আমার পাশেই বসে আছে। কথা বলো, ভিডিও কল দিয়ে তাকে দেখো, তুমি কোথায় গেলা আমাকে আর মেয়েকে না নিয়ে…।’

রাজধানীর ধানমন্ডি পপুলার হাসপাতালের মেঝেতে বসে এসব বলতে বলতে মাতম করছিলেন অ্যাডভোকেট ভুবন চন্দ্র শীলের স্ত্রী রত্না রানী শীল। গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে তেজগাঁওয়ে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে আহত হন অ্যাডভোকেট ভুবন। টানা সাত দিন চিকিৎসাধীন থেকে গতকাল সোমবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে মাথায় গুলিবিদ্ধ ভুবনের মৃত্যু ঘটে। প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা হাসপাতালের বিল পরিশোধ করার পর সন্ধ্যায় ভুবনের মরদেহ নিয়ে ফেনী জেলার ফুলগাজীর উদ্দেশে রওনা হন তার আত্মীয়স্বজন। 

সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাতেই ভুবনের গ্রামের বাড়িতে মরদেহ সৎকার করা হবে বলে জানিয়েছেন ‍ভুবনের শ্যালক পলাশ। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা বিল হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছু কনসিডার করেছে। বাকি টাকা ধারদেনা ও জোগাড় করে মরদেহ বের করতে কিছুটা সময় লেগেছে। তাই বিকাল ৫টার দিকে মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি ফেনীর উদ্দেশে রওনা হয়েছি।’ 

এর আগে হাসপাতালের বারান্দায় ভুবনের স্ত্রী রত্না রানী শীল ও মেয়ে ভূমিকা চন্দ্র শীলসহ স্বজনদের আহাজারিতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। ভুবনের স্ত্রী মাতম করতে করতে বলেন, ‘আমার স্বামীর কী অপরাধ ছিল? কেন তাকে এভাবে চলে যেত হলো? কত ডাক্তার এলেন, দেখলেন, কত টেস্ট করলেন, অপারেশন করলেন, কিন্তু কেউ একটিও আশার কথা শোনালেন না! শেষ পর্যন্ত আমার স্বামী চলে গেল না ফেরার দেশে!’ 

শোকাহত রত্না শীল বলেন, ‘কে গুলি করেছে, জানি না। আমার স্বামী তো চলেই গেল। যারা গুলি করেছে, তাদের বিচারটা যেন হয়। একটাই চাওয়া, এভাবে আর কোনো সন্তানের বাবাকে যেন এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে যেতে না হয়। আমার মেয়েটা বাবাকে ছাড়া কিছু বুঝত না। আজ তার বাবা চলে গেল। আমার মেয়েটা এত অভাগা, তার ছোট ছোট স্বপ্নও আর পূরণ হলো না।’

১৮ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ১০টার দিকে তেজগাঁওয়ের বিজি প্রেসসংলগ্ন এলাকায় হঠাৎ একটি প্রাইভেটকারকে ঘেরাও করে ফেলে চারটি মোটরসাইকেলে থাকা সাত-আটজন অস্ত্রধারী। এরপর তারা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। ওই গাড়িতে আরোহী ছিলেন ঢাকার অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুন এবং তার দুই সহযোগী খোকন ও মিঠু। এ সময় মামুন গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। হামলাকারীরা তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি গুলি গিয়ে লাগে রাস্তার উল্টো পাশ দিয়ে বাইকে রাইড নেওয়া যাত্রী ভুবন চন্দ্র শীলের মাথায়। প্রথমে তাকে শমরিতা হাসপাতালে ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় ভর্তি করা হয় ধানমন্ডির পপুলার হাপসাতালে। 

তবে চিকিৎসা অব্যাহত থাকলেও ভুবনের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। গত শুক্রবার রাতে অস্ত্রোপচার করে তার মাথা থেকে দুটি গুলির স্প্লিন্টার বের করা হয়। কিন্তু জ্ঞান ফেরেনি তার। তাকে হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। এ অবস্থাতেই চিরবিদায় নিলেন নিরীহ এই পথচারী। ভুবনের ওপর হামলার ঘটনায় ভুবনের স্ত্রী রত্না রানী শীল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা করেছেন। তবে গত রাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) আরিফ রাইয়ান বলেন, গুলির ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

রত্না বলেন, ‘অফিসে থাকতেই উনি (ভুবন) আমাকে ভিডিও কল দিয়ে বলেÑ আমার মেয়েকে দেখাও। আমি বলি, তোমার মেয়ে ঘুমাচ্ছে। এখন কীভাবে দেখাব। মেয়ে সারা দিন কোচিং করে টায়ার্ড; তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন উনি বলেন, রাত ১০টার পরে কল দিবো। তখন কিন্তু আমি আমার মেয়ের সাথেই কথা বলব। তোমার সাথে কথা বলব না। তার সর্বশেষ কথা ছিল, কিছুক্ষণ পরেই অফিস থেকে বের হব।’ 

ভুবনের স্ত্রী বলেন, ‘আহা, শেষবারের মতো মেয়েকে ভিডিও কলে দেখতে চেয়েছিল... সেদিন যদি একটু দেখাতাম তাহলে হয়তো তার শেষ ইচ্ছাটা পূর্ণ হতো। মেয়েও বাবার সঙ্গে শেষবার কথা বলতে পারত।’

পপুলার হাসপাতালে রত্না বলেন, ‘বাবার সঙ্গে তীর্থস্থান ঘুরতে যাওয়া হলো না মেয়েটার।’ ভূমিকা তখন মাকে বারবার বলছিল, ‘আমরা ঘুরতে যাব, বাবার আত্মা সব সময় আমাদের সঙ্গে থাকবে।’ রত্না জানান, তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর ভারতের চেন্নাইয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এক সপ্তাহ চিকিৎসার পর চেন্নাই থেকে বিভিন্ন তীর্থস্থানে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। বাবা হাত ধরে তীর্থস্থানে মেয়েকে নিয়ে ঘুরবে, এ নিয়ে কত যে পরিকল্পনা ছিল ভুবনের! প্রতিদিন ফোনে মেয়ের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতেন তিনি। মেয়ে বাবার হাত ধরে ঘুরতে পারবে না, এটা যে কত কষ্টের, বোঝানো সম্ভব নয়।

গত মে মাসেও চিকিৎসার জন্য রত্নাকে নিয়ে ভারতের চেন্নাই গিয়েছিলেন ভুবন। তবে তখন ভূমিকার এসএসসি পরীক্ষা থাকায় সঙ্গে যেতে পারেনি। এবার মেয়েকে নিয়ে যাবেন বলে ভুবন অনেক বেশি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, মেয়ে এসএসসি পাস করার পর মোবাইল ফোন কিনে দিলেন ভুবন। ফোন কিনে দেওয়ার পর সারাক্ষণই মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। দুজনে মিলে কতশত পরিকল্পনা যে করতেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। মায়াপুর, দক্ষিণেশ্বর ও দার্জিলিং গিয়ে কখন কোথায় থাকবেন, কী করবেন—সবকিছুই দুজনে মিলে ঠিক করে রেখেছিলেন। 

এদিকে বাবা নেই, এটি যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না ভুবন চন্দ্র শীলের মেয়ে ভূমিকা চন্দ্র শীল। পপুলার হাসপাতালে তার সঙ্গে কথা বলার সময় সে শুধু বাবার স্মৃতিচারণ করছিল। স্মৃতিচারণ করতে করতে ভূমিকা জানায়, ‘বাবার স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তার হব। কিন্তু আমি ডাক্তার হতে চাই না। ব্যবসায়ী হতে চাই। বাবাও সে ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে বলেছিলেন তোমার যেটা ভালো লাগে সেটাই করো।’ ভূমিকা বলে, ‘আমি ব্যবসা করব, এ নিয়ে বাবার সঙ্গে অনেক পরিকল্পনা হতো। শাড়ির ব্যবসা করা যায় কি না, এ নিয়ে যে কত গল্প হতো বাবার সঙ্গে।’

ভূমিকা বলে, ‘আমি খাসির মাংস খেতে পছন্দ করি। তাই বাবা যখনই খাসির মাংস খেতেন, আমাকে ফোন করে বলতেন, মা তোকে রেখেই আজ মাটন খেয়েছি। তখন আমি বলতাম, তুমি আমাকে রেখে কেন মাটন খেলে? আমি এখন বাবাকে রেখে কীভাবে মাটন খাব?’

ভুবন চন্দ্র গোমতী টেক্সটাইলের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করতেন। মতিঝিলের আরামবাগ এলাকার একটি মেসে ভাড়া থাকতেন। একমাত্র মেয়ে ভূমিকাকে নিয়ে তার স্ত্রী থাকেন নোয়াখালী জেলার মাইজদীতে। ভূমিকা এ বছর এসএসসি পাস করে নোয়াখালী মহিলা কলেজে ভর্তি হয়েছে। সন্ত্রাসীদের রক্তপাতময় দ্বন্দ্বে বিদায় নিলেন নিরীহ এই পথচারী। একটি পরিবার হারাল উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা