× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

৪২ হাজার কোটি টাকার ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রকল্প

এম আর মাসফি

প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:৫২ এএম

আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:২৩ পিএম

৪২ হাজার কোটি টাকার ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রকল্প

ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর ও কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়ক চার লেন করতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমি অধিগ্রহণের একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। জমি অধিগ্রহণ শেষ হলে সড়কটি ফোর লেন হবে। এতে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত যাতায়াত আরও সুগম হবে। এর পাশাপাশি পায়রা বন্দরের পণ্য পরিবহন ও দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সম্প্রতি প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকার একটি প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। সড়ক প্রকল্প নিয়ে কোনো দ্বিমত না থাকলেও রেলপথের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অর্থনীতির চলমান সংকটকালে প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি না, তা যাচাই করে দেখছে পরিকল্পনা কমিশন। দেশের অর্থনীতিবিদ ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, এই মুহূর্তে এমন একটি রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজন নেই।

ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ফোর লেন করতে সড়ক বিভাগের ৬ হাজার ৫০ কোটি টাকার একটি জমি অধিগ্রহণ প্রকল্প চলছে। প্রথমে এই ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে একটি সংকটের সময় চলছে। এ রকম সময়ে একই রুটে রেলপথের কতটা প্রয়োজন তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। পদ্মা সেতু হলেও এখনও ওই এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বরং এখন সড়কের ফোর লেন করার জমি অধিগ্রহণের যে প্রকল্প চলছে, সেটি দ্রুত শেষ করে মূল প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত। এমনিতেই মন্ত্রণালয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যাচ্ছে না। রেলের প্রকল্প প্রয়োজন হলে পরেও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া সড়ক ও রেলÑ দুটি প্রকল্প নিতে হলে তা সমন্বয় করেই নেওয়া উচিত। তাহলে একদিকে অর্থের অপচয় রোধ হবে। ফসলি জমিও নষ্ট হবে কম। 

সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোর লেন সড়ক বা রেলপথ দুটিই বৈদেশিক ঋণ নিয়ে করতে হবে। আগে দেখতে হবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পর তা কতটা কাজে লাগবে। পদ্মা সেতু হওয়ার পর ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়কটি চার লেন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ ওই রুটের যাত্রীরা এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা পাচ্ছে না। তবে এখনই সেখানে রেলপথের প্রয়োজন আছে কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ ঋণ নিলে তা পরিশোধের চাপও থাকবে। 

ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের একটি সূত্র জানায়, যেখানে ব্রিটিশরাই রেলপথ নির্মাণ করার সাহস দেখায়নি সেখানে আমাদের এই রুটে রেলপথ করা উচিত হবে কি না, সেটা খতিয়ে দেখার বিষয়। বরং এখানে নদীপথটাই সবচেয়ে ভালো। এরপর তো সেখানে সড়কপথও চার লেনে উন্নীত হচ্ছে। 

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) এমদাদ উল্লাহ মিয়ান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের একটি প্রাথমিক প্রস্তাব আমাদের কাছে এসেছে। আমরা সেটি যাচাই-বাছাই করছি। এই রুটে রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজন আছে কি না, সেটা পিইসি সভায় আলোচনা হবে। তারপর রেলপথ ও সড়কপথ একসঙ্গে হবে নাকি আলাদাভাবে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রেলের প্রকল্পটি একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) শেখ শাকিল উদ্দিন আহমদ গত শনিবার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্য আমরা একটি প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এখন পরিকল্পনা কমিশন ঠিক করবে সেটা কীভাবে হবে। কমিশন প্রাথমিক অনুমোদন দিলে প্রকল্পের জন্য ঋণ খুঁজবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।’

ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত রেলপথের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সেখানে সড়কের একটি ফোর লেন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ চলছে। পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে মহাসড়কটি দ্রুত ফোর লেন হওয়া দরকার। তবে সেখানে একই পথে একই সময়ে রেলপথের প্রয়োজন আছে কি না, সেটা করার আগে হিসাবনিকাশ করা দরকার। কারণ আমাদের তো ঋণ করেই করতে হবে। এই রেললাইন করে সেই টাকা উঠে আসবে কি না, সেটা দেখতে হবে। রেললাইন তো পরেও করা যাবে। কারণ একই এলাকায় বড় দুটি প্রকল্প করতে হলে বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এমনিতেই দেশে আবাদি জমি অনেক কম। দুটি আলাদা প্রকল্প বাস্তবায়নে যেমন আবাদি জমি বেশি নষ্ট হবে, তেমনি অর্থেরও অপচয় হবে।’ 

রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এমন বড় ধরনের কোনো প্রকল্প নেওয়াই উচিত হবে না। সরকারের তো টাকা নাই। যেটা জরুরি দরকার, যেমন জয়দেবপুর থেকে যমুনা পর্যন্ত রেলের ডাবল লাইনের কাজ হাতে নিতে পারছে না সরকার। সেখানে ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত রেললাইনের প্রয়োজনই নাই। এই রেললাইন করতে চাওয়া হচ্ছে পায়রার জন্য। সেখানে তো বিনিয়োগই নাই। সেখানে এখন কেন রেললাইন করতে হবে? তবে কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়ক ফোর লেন হওয়া দরকার।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, রেলপথ মন্ত্রণালয় ‘ভাঙ্গা জংশন (ফরিদপুর) থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর ও কুয়াকাটা পর্যন্ত ব্রডগেজ (বিজি) রেললাইন নির্মাণ’ প্রকল্পটির প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (পিডিপিপি) নীতিগত অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। কমিশন সেই প্রস্তাবনা যাচাইবাছাই করে দেখছে যে আদৌ এই মুহূর্তে প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তা আছে কি না। 

ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের প্রস্তাবনায় দেখা যায়, ভাঙ্গা জংশন (ফরিদপুর) থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর ও কুয়াকাটা পর্যন্ত ব্রডগেজ (বিজি) রেললাইন নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৭৯৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ৯ হাজার ৫৯৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৩২ হাজার ১৯৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা। সরকারি অর্থায়নের বড় অংশই ব্যয় হবে ৫ হাজার ৬৩৮ একর ভূমি অধিগ্রহণ খাতে। প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করা হয়েছে জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৯ পর্যন্ত। বৈদেশিক সহায়তার সম্ভাব্য উৎস হিসেবে চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের কথা ভাবা হয়েছে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য তুলে ধরে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভাঙ্গা থেকে পায়রা এবং বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ২১৪ দশমিক ৯১ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর ও পর্যটন স্পট কুয়াকাটার সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন হবে। 

রেললাইনের মোট দৈর্ঘ্য বা রুট লাইন হবে ২১৪ দশমিক ৯১ কিলোমিটার, এর মধ্যে মেইন লাইন ১৯০ দশমিক ১১ কিলোমিটার ও ব্রাঞ্চ লাইন ২৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার। তবে ট্র্যাকের মোট দৈর্ঘ্য হবে ৩৬৯ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। পুরো রেলপথটি নির্মাণে ৪৪০টি বক্স কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। যার মোট দৈর্ঘ্য হবে ৪ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। এই রেলপথে ১০টি মেজর ব্রিজ নির্মাণ করা হবে, এর মোট দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার। প্রধান সেতুগুলোর উভয় প্রান্তে ৩৬ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ নির্মাণ করা হবে। কুমার, কালীগঙ্গা, শিকারপুর, আমতলী, কীর্তনখোলা, পায়রা, পটুয়াখালী, আন্ধারমানিক, টিয়াখালী, খাপরা ভাঙা নদীর ওপর দিয়ে উড়াল রেলপথ নির্মিত হবে। পুরো রেললাইনে ১৯টি স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ করা হবে। স্থানগুলো হলোÑ ভাঙ্গা জংশন, বরইতলা, টেকেরহাট, মাদারীপুর, কালকিনি, গৌরনদী, উজিরপুর, বরিশাল এয়ারপোর্ট, বরিশাল, দপদপিয়া, বাকেরগঞ্জ, বদরপুর, পটুয়াখালী, কাকুয়া, আমতলী, পায়রা পোর্ট, পায়রা পোর্ট ইয়ার্ড, লেমুপাড়া ও কুয়াকাটা।

এদিকে পদ্মা সেতুর পরিপূর্ণ সুফল পেতে ভাঙ্গা থেকে বরিশালের কুয়াকাটা পর্যন্ত চার লেনের আধুনিক মহাসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৮ সালে শুরু হয় জমি অধিগ্রহণ প্রকল্প, যা দুই বছরের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। তবে পাঁচ বছর কেটে গেলেও জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করতে পারেনি সওজ। এ সময়ে প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ। দুবার সময় বাড়ানোর পর গত জুন মাসে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় নতুন করে সংশোধনীতে প্রকল্পের ব্যয় ৪ হাজার ১৮২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নের সময় আরও দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন প্রস্তাব পাস হলে ভূমি অধিগ্রহণের ব্যয় দাঁড়াবে ৬ হাজার ৫০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতাসহ বেশকিছু জটিলতার কারণে নির্ধারিত মেয়াদে ফোর লেন সড়কের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া মূল ডিপিপিতে প্রয়োজনের তুলনায় কম ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে অধিগ্রহণের আওতায় ভূমির পরিমাণ বাড়িয়ে প্রকল্প সংশোধন করা হচ্ছে। এ ছাড়া শুরুর দিকে সড়কটি বরিশাল শহরের মধ্যে দিয়ে করার কথা থাকলেও এখন বাইপাস সড়কের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা