× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

চুক্তির কারসাজিতে ক্ষতি রেলের যাত্রীদের

রাশেদুল হাসান

প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:২৭ পিএম

ট্রেন। ফাইল ফটো

ট্রেন। ফাইল ফটো

একজন যাত্রীর জন্য একটি টিকিট ইস্যু করতে যে সময় ও অর্থ ব্যয় হয়, চারজন যাত্রীর জন্যও একই পরিমাণ অর্থ ও সময় ব্যয় হয়। তাই উভয় ক্ষেত্রে টিকিট বিক্রয়কারীর কমিশন ও সার্ভিজ চার্জ সমান হওয়ার কথা। তবে টিকিট বিক্রির কমিশন চুক্তির কারসাজিতে এমনটা হচ্ছে। চারজনের জন্য একটি টিকিট কাটলে চারগুণ চার্জ বা অর্থ গুনতে হচ্ছে। এতে যাত্রী ও রেলসেবা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা একটি বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে টিকিটপ্রতি কমিশন দেওয়ার চুক্তি না করে যাত্রীপ্রতি চুক্তি করেছেন। ফলে কেউ অনলাইন থেকে একজন যাত্রীর একটি টিকিট ক্রয় করলে ২০ টাকা সার্ভিস চার্জ নেওয়া হয়। আবার চারজনের একটি টিকিট সংগ্রহ করলে চারগুণ বা ৮০ টাকা সার্ভিস চার্জ নেওয়া হয়। আর কাউন্টার থেকে এক আসনের এক টিকিটে সার্ভিস চার্জ ২৫ পয়সা আর চারজনের একটি টিকিটের সার্ভিস চার্জ ১ টাকা। 

জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভি নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে পাঁচ বছরের টিকিট বিক্রির চুক্তি করে রেলওয়ে। চুক্তিপত্র অনুযায়ী অনলাইনে একজন যাত্রীর টিকিটের জন্য দেওয়া বাড়তি ২০ টাকার সাড়ে ৬ টাকা পায় অপারেটর। সাড়ে ৬ টাকা পায় যে ব্যাংকিং গেটওয়ের মাধ্যমে দাম পরিশোধ করা হয়, সেই প্রতিষ্ঠান। ৩ টাকা ভ্যাট পায় সরকার। বাকি ৪ টাকা রেলওয়ে কল্যাণ ট্রাস্টের। আর কাউন্টারে বিক্রি করলে টিকিটপ্রতি ২৫ পয়সা পাবে বেসরকারি যৌথ কোম্পানিটি। কিন্তু গত ঈদে কাউন্টারে ৫০ শতাংশ টিকিট বিক্রির কোটা তুলে দিলে বিপাকে পড়েন যাত্রীরা। 

আজিজুর রহমান নামের সিলেটের একজন যাত্রী জানান, অনলাইন থেকে একজন চার আসনবিশিষ্ট একটি টিকিট নিলে প্রতি সিটে ২০ টাকা হিসেবে ৮০ টাকা চার্জ নেওয়া হচ্ছে। আবার একজনের একটি টিকিটে চার্জ নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা। 

তিনি বলেন, ‘এখন অনলাইনের যুগ। তাই অনলাইন থেকে টিকিট না কাটলে কাউন্টারে পাওয়া যায় না। কিন্তু খরচ বেশি অনলাইনে। আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিলেট যাব। চারজনের জন্য একটি টিকিট নিলাম, দেখলাম সার্ভিস চার্জ ৮০ টাকা। কিন্তু টিকিট নিতে কিন্তু একই সময় লাগল। এটা বেশি মনে হলো, ৪০ টাকা হলেও হতো। এত লাভ করা দরকার ওদের!’ 

এ বিষয়ে সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এটা চুক্তি অনুযায়ী নেওয়া হচ্ছে। চুক্তিতেই সেই শর্ত আছে। শুধু আমরা ব্যাংক ও যাত্রী হিসেবেই সেবামূল্য নিচ্ছি।

জানতে চাইলে সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ দেবনাথ গত রবিবার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আগের প্রতিষ্ঠান সিনেসিসের সঙ্গে যে চুক্তি ছিল, আমাদের সঙ্গেও একই চুক্তি, কোনো পার্থক্য নেই। তারাও ২০ টাকা নিত, আমরাও ২০ টাকা নিই।’ 

এর আগে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে রেলওয়ের চুক্তিতেও একাধিক যাত্রীর একটি টিকিটে চার্জের পরিমাণ বেশি ছিল। তবে তা যাত্রীর সংখ্যার ভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন ছিল।

জানতে চাইলে রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এক টিকিটে একাধিক সিট দিতে হলে খরচ বেড়ে যায়। 

তবে রেলওয়ের পুরোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমের (সিএনএস) একজন কর্মকর্তা জানান, অনলাইনে যত শতাংশ টিকিট বিক্রি হোক না কেন, অপারেটরের খরচ একই। এখন অনলাইনে টিকিট সংখ্যা বাড়ায় প্রতি টিকিটে ১০ টাকার কম সেবা খরচ হওয়া উচিত।

জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, ‘টিকিট অনলাইনে দেওয়ায় যাত্রীদের কাউন্টারে এসে টিকিট কাটার যাতায়াত ভাড়া সাশ্রয় হয়েছে। আমরা যদি এর চেয়ে কম সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করতাম, তাহলে হয়তো আর কোনো অপারেটর সেবা দিতে রাজি হতো না।’ 

যাত্রী হিসেবে কমিশন নেওয়ায় আপত্তি আছে নিরীক্ষা দপ্তরেরও

বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে টিকিটপ্রতি কমিশন দেওয়ার চুক্তি না করে যাত্রীপ্রতি কমিশন দেওয়ার চুক্তি করলে ক্ষতি হয় যাত্রী ও রেলের।

২০১৪ সালের ৯ এপ্রিলে ট্রেনের সেন্ট্রাল কম্পিউটারাইজড সিট রিজারভেশন অ্যান্ড টিকেটিং সিস্টেমের (সিএসআরটিএস) জন্য প্রয়োজনীয় সব হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার এবং অ্যাকসেসরিজ সরবরাহের জন্য রেলওয়ে চুক্তি করে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেডের সঙ্গে। রেলওয়ের পক্ষে তৎকালীন যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন) মিহির কান্তি গুহ এবং কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনির-উজ-জামান চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন।

চুক্তি অনুযায়ী একজন যাত্রী কাউন্টার থেকে একটি টিকিট নিলে কোম্পানি কমিশন পাবে ২.৯৯ টাকা আর চারজন যাত্রীর জন্য একটি দিলেও তারা কমিশন পাবে তার চারগুণ।

এ চুক্তি করায় শুধু বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুধু ১২ মাসেই ৩ কোটি ২৩ লাখ ৯২ হাজার ৮৫৮ টাকা গচ্চা যাওয়ার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি)। সম্প্রতি এ প্রতিবেদনটি তারা সংসদে পাঠিয়েছে। এ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কমিশন দেওয়ার ক্ষেত্রে টিকিটপ্রতি কমিশন দেওয়ার চুক্তি না করে যাত্রীপ্রতি দেওয়ার চুক্তি করায় রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের ২০১৮ সালের মে জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত অতিরিক্ত যাত্রীর কমিশন বাবদ ১ কোটি ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১১২ টাকা এবং পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত যাত্রী কমিশন বাবদ ২ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ৭৪৫ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। ২০১৪ সালে আবার পাঁচ বছরের জন্য তাদেরকে নিয়োগ করা হলেও তারা ২০২১ সাল পর্যন্ত রেলের টিকিট বিক্রির দায়িত্বে ছিল। 

নিরীক্ষা দপ্তরের প্রশ্নের জবাবে রেলের পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, মহাপরিচালকের কার্যালয় কর্তৃক যথাযথ নিয়ম মোতাবেক এ চুক্তি করেছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সিএনএস শুধু টিকিট ইস্যু করে থাকে। বাস্তবে আসন সংরক্ষণ, অনলাইন, রক্ষণাবেক্ষণ, ই-টিকেটিংসহ প্রচুর দক্ষ জনবলের মাধ্যমে ওই কার্যক্রমটি সম্পন্ন হচ্ছে। যাত্রীপ্রতি কমিশনের বিষয়টি সব প্রকল্পের ব্যয়ের সার্ভিস চার্জ হিসেবে গণ্য। ওই কার্যক্রমে ব্যবহৃত প্রচুর কম্পিউটার, অ্যাকসেসরিজ, দক্ষ জনবল ইত্যাদি বিবেচনায় উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে সর্বনিম্ন দরদাতা সিএনএস লিমিটেড হওয়ায় বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক সিএনএসকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ফলে আর্থিক ক্ষতি হয়নি, বরং যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে।

আর পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপকের পক্ষ থেকেও একই জবাব দেওয়া হয়। 

নিরীক্ষা মন্তব্য বলেছে, চুক্তিটি যে-ই করুক না কেন, কমিশনের অতিরিক্ত টাকা রেলওয়ে হতে বহন করা হয়। তাছাড়া সিস্টেমটি যত জটিলই হোক না কেন, একজন যাত্রীর জন্য ১টি টিকিট ইস্যু করতে যে সময় ও কাগজ-কালি ব্যয় হয়, ৪ জন যাত্রীর জন্যও একটি টিকিট ইস্যু করতে সে সময় ও কাগজ-কালি ব্যয় হয়।

বিভিন্ন স্টেশনে বাস্তব যাচাইয়ে সিএনএস থেকে পদায়নকৃত অপারেটরদের কর্মরত অবস্থায় পাওয়া যায় না। রেলের বুকিং সহকারীরা রেলওয়ের কম্পিউটারাইজড সিট রিজারভেশন অ্যান্ড টিকেটিং সিস্টেম (সিএসআরটিএস) অপারেট করে থাকে।

২০০৭ সালে পাঁচ বছরের জন্য সিএনএসকে অপারেটর নিয়োগ করে রেল। ২০১৪ সালে আবার পাঁচ বছরের জন্য কাজটি পায় সিএনএস। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভি নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে পাঁচ বছরের টিকিট বিক্রির চুক্তি করে রেলওয়ে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা