ফসিহ উদ্দীন মাহতাব, নিউইয়র্ক থেকে
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:৪৯ এএম
আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:৫৭ এএম
কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, কূটনৈতিক ব্যস্ততা, কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য পুরস্কারপ্রাপ্তি, রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনা, বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রস্তাব এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেওয়া নৈশভোজে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে ব্যস্ত সময় কাটালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কর্মসূচি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বুধবারও ব্যস্ত সময় পার করবেন প্রধানমন্ত্রী।
চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনে বিশ্বনেতাদের বিবেচনার জন্য সুনির্দিষ্ট পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনের ফাঁকে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে স্পেন ও ইউরোপীয় কাউন্সিল আয়োজিত ‘টুওয়ার্ডস অ্যা ফেয়ার ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল আর্কিটেকচার’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
বিশ্বব্যাপী ক্রেডিট রেটিং সিস্টেম পর্যালোচনা করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে একমত যে, ক্রেডিট রেটিং সিস্টেম অবশ্যই পর্যালোচনা করা উচিত। বর্তমান রেটিং সিস্টেম অনেক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের জন্য তহবিলের সুবিধাকে আরও সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান ক্রেডিট রেটিং সিস্টেম নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ভোটাধিকার, কোটা এবং বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এমডিবিএস), আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (আইএফআইএস) প্রতিনিধিত্বের সীমা এবং দর-কষাকষির ক্ষমতাকেও ক্ষুণ্ন করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা প্রায়ই আন্তর্জাতিক পাবলিক ফাইন্যান্সগুলোকে ব্যয়বহুল এবং নাগালের বাইরে দেখতে পাই। ঋণের ঝামেলা এড়াতে আমরা উচ্চ সুদের ঋণ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। বাংলাদেশ কখনোই এসব প্রতিষ্ঠানে ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়নি এবং আমরা সেই রেকর্ড বজায় রাখব।
আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিয়াল আর্কিটেকচারের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গ্লোবাল সাউথের প্রতিনিধিত্ব করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশের উন্নয়ন বিবরণীতে দেখায় যে, আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার জন্য আমাদের প্রত্যাশার প্রতি সায় দেওয়ার সময় এসেছে। আমরা স্বীকার করি যে, আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিয়াল-আর্কিটেকচারের জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু সংস্কারের প্রকৃতি ও পরিধির বিষয়ে চুক্তি বা সমঝোতার ক্ষেত্রে এখনও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ মহাসচিবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ প্রস্তাব
বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্ট পাঁচটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়েছেÑ এমডিবি, আইএফআই ও বেসরকারি ঋণদাতা সংস্থাগুলোকে তাদের অগ্রাধিকারগুলো পুনরায় সাজাতে হবে এবং এসডিজি বাস্তবায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবিলার জন্য অতিরিক্ত তহবিল সংগ্রহ করতে হবে।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রস্তাব সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য স্বল্প ব্যয়ে, রেয়াতি হারে তহবিলের পর্যাপ্ততা প্রয়োজন এবং পছন্দসই উচ্চমানের বিপুল পরিমাণে অনুদান এবং সমস্ত ঋণদানের উপকরণগুলোতে দুর্যোগের ধারা থাকতে হবে, যাতে দুর্বল দেশগুলো সংকটকালের ধাক্কা সামলাতে পারে।
চতুর্থ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ঋণদাতাদের মধ্যে স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে ন্যায্য ও কার্যকর ঋণ হিসেবে ত্রাণব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পঞ্চম এবং শেষ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটার পরিবর্তে এসডিআর ঋণের সীমা প্রয়োজন এবং সীমাবদ্ধতার ভিত্তিতে সহজ ঋণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হওয়া উচিত।
কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য বিশেষ সম্মাননা পেলেন শেখ হাসিনা
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে জাতিসংঘ স্বীকৃত কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষ সম্মাননা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্রাউন ইউনিভার্সিটি মেডিকেল স্কুল’। স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের লোটে নিউইয়র্ক প্যালেস হোটেলে প্রধানমন্ত্রীকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া প্রশংসাপত্রে বলা হয়েছে, ‘কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার একটি সফল মডেল : প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন ও কমিউনিটি সম্পৃক্ততা উন্নয়নের মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিধির জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি।’
এর আগে কমিউনিটি ক্লিনিককে জাতিসংঘ ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় এই বিশ্বসংস্থাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের উদ্ভাবনকে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনুসরণ করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বে এই ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।
গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক মেডিকেল সার্ভিসেস বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, জাতিসংঘ কমিউনিটি ক্লিনিককে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনুকরণীয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই উদ্যোগকে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর কমিউনিটি ক্লিনিকের উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করি সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার আসার পর তারা এটা বাতিল করতে চেয়েছিল। ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর আইন করার উদ্যোগ নিই, যাতে কেউ এটা আর বাদ দিতে না পারে। কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের চাবিকাঠি বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। সবার কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর এ প্রচেষ্টায় সহায়তার জন্য উন্নয়ন অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সাইডলাইনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৮তম অধিবেশনের ফাঁকে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে, তিমুর-লেস্তের প্রেসিডেন্ট ড. হোসে রামোস হোর্তা ও ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে দ্বিপক্ষীয় সভাকক্ষে বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর দৈনন্দিন ব্যস্ততা নিয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, এতে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।