প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:১৬ এএম
নিত্যপণ্যের দাম ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে রাখতে পাঁচটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার।
নিত্যপণ্যের দাম ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে রাখতে গত বৃহস্পতিবার আলু, ডিম ও পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বলা হয় পরদিন (গত শুক্রবার) থেকেই কার্যকর হবে এ ঘোষণা। কিন্তু নতুন নির্ধারিত মূল্য কার্যকরের দ্বিতীয় দিনেও বাজারে এর প্রতিফলন ঘটেনি। এমন পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন সাধারণ ভোক্তারা। আবার দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা বাস্তবায়নে বাজার মনিটরিং টিমকে রাজধানীসহ সারা দেশে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাজার মনিটরিংয়ের দুর্বলতার কারণে সরকার এর আগেও যতবার দাম নির্ধারণ করেছে, ততবারই ঘোষণা অনুযায়ী পণ্যের কেনাবেচা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এবারও সম্ভবত একই ঘটনা ঘটতে চলেছে।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি কেজি আলু ৩৫-৩৬ টাকা, পেঁয়াজ ৬৪-৬৫ এবং ফার্মের প্রতিটি ডিম ১২ টাকা (প্রতি হালি ৪৮ টাকা) নির্ধারণ করে দেয়। একই সঙ্গে কেজিপ্রতি খোলা চিনি ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত ১৩৫ টাকা, বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেল ১৬৯ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৪৯ টাকা, পাম অয়েল ১২৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সরকার এ পর্যন্ত আলু, পেঁয়াজ, ডিম, তিন প্রকারের তেল ও চিনিসহ ৫টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে।
গতকাল শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানী ঢাকার মিরপুরের কালশী কাঁচাবাজার, হাতিরপুল কাঁচাবাজার, সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজার ও রামপুরা কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, আলু, পেঁয়াজ, ডিম সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি হচ্ছে না।
হাতিরপুল কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, মুন্সীগঞ্জের আলু ৫০ টাকা, বগুড়ার ৫৫ টাকা এবং জাম আলু ৮০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা কেজি। ডিম বিক্রি হচ্ছে লাল ৫০ টাকা, সাদা ৪৮ ও হাঁসের ৮০ টাকা হালি। খোলা চিনি ১৩০ ও প্যাকেটজাত চিনি ১৩৫ টাকায়, এক লিটার সয়াবিন (বোতল) ১৭৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ বাজারে আসা আলমগীর হোসেন বললেন, ‘সরকার দাম নির্ধারণ করে জনগণের সঙ্গে তামাশা করছে। টিভিতে দেখলাম দাম বেঁধে দিয়েছে, কিন্তু দোকানে তো কম দামে কোনো কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানদাররা বলছেন, টিভি আর পেপারের আলাপ বাজারে করলে লাভ হবে না। আমরা যে দামে কিনেছি, তার চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে পারব না। টিভির খবর গিয়ে পাইকারকে বলেন।’
বাজারের দোকানি মেহেদী হাসান জানান, আলু প্রতি কেজি কেনা পড়েছে ৪৫ টাকা, পেঁয়াজ ৮০ ও ডিম প্রতিটি সাড়ে ১১ টাকায়। তিনি বলেন, ‘আমরা কম দামে বিক্রি করতে চাই। কিন্তু যেখান থেকে কিনি, তারা তো কম দামে বিক্রি করে না।’ জাভেদ হোসেন নামের আরেক ব্যবসায়ী জানান, তার দোকানে পেঁয়াজ (দেশি) ৮৫ টাকা ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৬৫ টাকা কেজি; মুন্সীগঞ্জের আলু ৫০ টাকা, বগুড়ার আলু ৫৫ টাকা এবং তেল ১৭৫ টাকা লিটারে বিক্রি হচ্ছে।
সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারে কথা হয় রাশেদ জামাল ও আরমান হোসেনের সঙ্গে। তারা জানান, বাজারটিতে ডিম ৫০ টাকা, হাঁসের ডিম ৭০ টাকা ও সাদা ডিম ৪০ টাকা হালিতে বিক্রি হচ্ছে।
মুদি দোকানি সজীবুর রহমান জানান, খোলা চিনি ১৩৫ টাকা, বোতলজাত তেল ১৭৫ টাকা, খোলা তেল ১৪৫ টাকা ও পেঁয়াজ ৮৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন।
মালিবাগ কাঁচাবাজারে সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা শোনালেন ডিম ব্যবসায়ী ইব্রাহিম খলিল। তিনি প্রায় ২২ বছর প্রবাসে ছিলেন। ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে চাইলে সরকার সেসব কোম্পানি বা পণ্য উৎপাদনকারীর সঙ্গে বৈঠক করে। তারপর একটি সময় নির্ধারণ করা হয়। সেই উল্লেখিত সময়ের মধ্যে আগের পণ্যগুলোর বিক্রি নিশ্চিত করা হয়। তারপর নতুন দাম বাস্তবায়ন হয়। আমাদের দেশে উল্টো। মন্ত্রীরা একটা নির্দেশনা দিয়ে দেন। সে হিসাবে বাজারে দাম বাড়ে বা কমে, কিন্তু মূল উৎপাদনকারীদের ধরা হয় না।’
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘সরকার ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু মুরগির খাদ্যের দাম তো কমাতে হবে। যদি তা না করে, তাহলে প্রান্তিক খামারিরা মুরগি তুলবে না। কেননা প্রান্তিক পর্যায়ে ডিমের উৎপাদন ব্যয় ১১ টাকার বেশি হয়। করপোরেট কোম্পানিগুলোর ব্যয় হয় সাড়ে ১০ টাকা। মুরগির খাদ্যের দাম না কমালে ছয়-আট মাসের মধ্যে বাজারে আবারও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
অদৃশ্য হাত আলুর বাজারকে অস্থির করেছে: ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক
আলুর বাজারকে একটি অদৃশ্য হাত নিয়ন্ত্রণ করছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। তিনি গতকাল দুপুরে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে রিভারভিউ কোল্ডস্টোরেজ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি বলেন, এ বছর যে পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়েছে, এতে দেশে আলুর কোনো ঘাটতি নেই। একটি অদৃশ্য হাত আলুর বাজারকে অস্থির করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী ভোক্তাপর্যায়ে আলুর দাম বাস্তবায়ন করতে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে ভোক্তা অধিদপ্তর।
এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, আলু বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার পাকা রসিদ ব্যবহার করতে হবে। পাকা রসিদ না থাকলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যারা মজুদ করছে, তাদের চিহ্নিত করা দরকার। বাণিজ্যমন্ত্রীও নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে জাতীয় সংসদে তোপের মুখে পড়েছেন। তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, কিছু প্রতিষ্ঠান বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তা খুবই শক্তিশালী। প্রকৃত কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নেই। জাতীয় স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি মো. গোলাম রহমান বলেন, বাজার মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে উৎপাদক, পাইকার, হিমাগার, তারপর খুচরা পর্যায়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থাৎ ওপর থেকে কার্যক্রম শুরু করতে হবে। আমাদের দেশে উল্টো খুচরা পর্যায়ে মনিটরিং করে জরিমানা করা হয়। এটি বাজার ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখতে পারে না।
১৪৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ ৬২ হাজার টাকা জরিমানা
গতকাল ঢাকা মহানগরসহ দেশের সকল বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং স্যালাইনের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে অভিযান চালিয়েছে ভোক্তা অধিদপ্তর। এদিন ঢাকা মহানগরীতে তিনটি টিমসহ সারা দেশের ৪৯টি জেলায় ৫১টি টিম ৭৪টি বাজারে অভিযান চালিয়ে ১৪৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ ৬২ হাজার টাকা জরিমানা করেছে