× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ক্ষমতার মোহে বেপরোয়া বহু জনপ্রতিনিধি

ফয়সাল খান

প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:৩৪ পিএম

আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:২৪ পিএম

ক্ষমতার মোহে বেপরোয়া বহু জনপ্রতিনিধি

নিরলস সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন জনপ্রতিনিধিরা। এলাকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, উন্নয়নসাধন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও নারীর অধিকার রক্ষা, শিক্ষাবিস্তারে সহযোগিতা, দুর্যোগকালে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোসহ বহু বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব অর্পিত হয় তাদের ওপর। কমবেশি অনেকেই সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করেন। কিন্তু জনগণের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে ‘গণশত্রু’ হয়ে ওঠার মতো জনপ্রতিনিধির সংখ্যাটাও কিছু কম নয়। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভোটের আগে যারা ‘বিড়াল’ সেজে ছিলেন তারাই ভোটে জেতার পর জনগণের কাছে মূর্তিমান ‘বাঘ’ হয়ে উঠেছেন।

এ রকম দৃষ্টান্ত রয়েছে অনেক। যেমন নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন আগেও সাধারণভাবে জীবনযাপন করতেন জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু। কিন্তু ২০২২ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েই তিনি আমূল বদলে যান। ক্রমেই হয়ে ওঠেন ভীষণ বেপরোয়া, গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। সেই বাহিনী দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। একাধিক বিয়ে ও অনৈতিক সম্পর্কসহ নানা অপকর্মের ভূরি ভূরি অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এসব অপকর্মের সংবাদ প্রকাশ করায় একজন সাংবাদিককে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন তিনি।

জামালপুরের সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যার ওই ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করার পর জেলা প্রশাসকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান বাবুকে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। 

অন্যদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় প্রতিপক্ষের কর্মী হত্যার অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা পান কুষ্টিয়ার আলমপুর ইউপি চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান বিশ্বাস। এ ঘটনায় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। 

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার লতা ইউপির চেয়ারম্যান কমল কান্তি বিশ্বাসের একটি আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০ জুন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে মন্ত্রণালয়। বরখাস্তের চিঠিতে বলা হয়, ‘লতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল কান্তি বিশ্বাসের একটি আপত্তিকর ভিডিও ক্লিপ প্রকাশিত হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের প্রতিবেদন ও পাইকগাছা থানার অফিসার ইনচার্জের পাঠানো বেতারবার্তায় দেখা যায়, কে বা কারা চেয়ারম্যানের একটি আপত্তিকর ভিডিও কল ডিজিটাল মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থেকে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া নৈতিকতা ও উক্ত পদের জন্য অবমাননাকর প্রতীয়মান হওয়ায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী জেলা প্রশাসক, খুলনা ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন।’

গত বছরের ১২ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার চান্দপুর ইউপির চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান ও ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার শহীদুল হক উজ্জ্বলকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দুজন মিলে কটিয়াদী উপজেলার চান্দপুর ইউনিয়নের মঞ্জিলেরকান্দা গ্রামের আনোয়ার আলী ভূঁইয়ার বাড়িঘর ভেঙে মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যান। ওই ঘটনায় আনোয়ার আলী চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান, মেম্বার উজ্জ্বলসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ১০ আগস্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দ্রুত বিচার আইনে মামলা করেছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর ওই চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ ৯ জনের জামিন আবেদন নাকচ করে সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়।

দেশজুড়ে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কেবল এই কয়েকজনই নন, আরও অনেক চেয়ারম্যান, মেম্বারের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি এ রকম নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। কখনও তা সামনে আসে আবার কিছু ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। নিগ্রহের ভয়ে ভুক্তভোগী অনেক অভিযোগ মুখেও আনেন না। 

নির্বাচিত হয়ে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার ও জুলমকারীদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। গত সাড়ে তিন বছরে নানা অপকর্মের দায়ে ইউনিয়ন পরিষদের ৫৫০ জন চেয়ারম্যান-মেম্বারকে বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। বরখাস্ত হওয়া জনপ্রতিনিধিদের ১১১ জন আবার উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্বপদে ফিরেছেন। সাময়িক বহিষ্কার হওয়া অনেকেই আবার রাজনৈতিক কারণে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলেও দাবি করা হয়। তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং জেলা প্রশাসকের সুপারিশের আলোকেই জনপ্রতিনিধিদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কেউ আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের অযোগ্য না হলে বরখাস্ত করা হয় না। 

গত সাড়ে তিন বছরে বরখাস্ত হওয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের তালিকা রয়েছে প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে। সেই তালিকার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাড়ে তিন বছরে ইউনিয়ন পরিষদের ৫৫০ জন জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তাদের মধ্যে ইউপি মেম্বার রয়েছেন ৩০১ জন এবং চেয়ারম্যান ২৩৮ জন। তা ছাড়া ১১ জনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। ১১০ জন আদালতের আদেশে দায়িত্বে ফিরেছেন। 

২০২২ সালে ইউনিয়ন পরিষদের ৩১ জন জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়। এর মধ্যে ১১ জন চেয়ারম্যান ও ১৭ জন মেম্বার। তাদের ৩ জন উচ্চ আদালতের নির্দেশে দায়িত্ব পালন করছেন। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ৯৩ জনকে বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে ২৬ জন চেয়ারম্যান ও ৪০ জন মেম্বারকে সাময়িক এবং ৬ জন চেয়ারম্যানকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত করা হয়। তাদের মধ্যে ১১ জন চেয়ারম্যান ও ১০ জন মেম্বার উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে দায়িত্ব পালন করছেন। 

২০২০ ও ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি চেয়ারম্যান-মেম্বার বরখাস্ত হয়েছেন। দুই বছরে ৪২৬ জন চেয়ারম্যান-মেম্বারকে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ২০২০ সালে ৭৪ জন চেয়ারম্যান ও ১৩১ জন মেম্বারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ২০২১ সালে ২২১ জনকে বরখাস্ত করা হয়। তাদের মধ্যে অবশ্য ৫৭ জন চেয়ারম্যান ও ২৯ জন মেম্বার উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্বপদে ফিরে আসেন। 

সাময়িক বরখাস্ত এই জনপ্রতিনিধিদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধে সরকারি ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম, ১০ টাকা কেজি দরের চাল অন্যত্র বিক্রি, ভিজিএফের চাল পরিমাণে কম দেওয়া, ত্রাণের চাল আত্মসাৎ এবং প্রধানমন্ত্রীর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহায়তা কর্মসূচির সুবিধাভোগীদের তালিকা তৈরিতে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া মাদ্রকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার কারণেও অনেককে বরখাস্ত করা হয়। 

স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব (ইউনিয়ন পরিষদ অধিশাখা) মোহাম্মদ ফজলে আজিম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আইন অনুযায়ী যারা দায়িত্ব পালনের অযোগ্য হচ্ছেন, তাদেরই বরখাস্ত করা হচ্ছে। নিয়মের বাইরে কাউকে বরখাস্ত করা হচ্ছে না। 

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক সচিব সিনিয়র আবু আলম মো. শহীদ খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, দোষী হলে তো বরখাস্ত হবেই। এখন তো বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধিই শাসক দলের। তাই রাজনৈতিক কারণে বরখাস্ত হওয়ার সংখ্যাটা খুবই কম। 

তিনি আরও বলেন, ‘এ সমস্যার প্রতিকারে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাটা ভালো করতে হবে। আরও ভালো মানুষ যাতে নির্বাচিত হতে পারে, সেই সুযোগ তৈরি করতে হবে। এটা করতে পারলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অপরাধ কমে আসবে।’ 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিআইপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা এমনিতেই ভঙ্গুর। স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেওয়ায় তা আরও নষ্ট হয়ে গেছে। প্রক্রিয়াটা ইলেকশনের পরিবর্তে অনেকাংশেই সিলেকশন হয়ে গেছে। অনেকেই টাকা দিয়ে দলীয় মনোনয়ন কিনে নিচ্ছেন। যার পুরো প্রক্রিয়াই অস্বচ্ছ এবং প্রশ্নবিদ্ধ। এই প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করা গেলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে জবাবদিহি তৈরি হতো। একজন জনপ্রতিনিধিও নৈতিক স্খলনের কারণে বরখাস্ত হলে তা মোটেও ভালো খবর না। সেখানে এই সংখ্যাটি (৫৫০) অনেক বড় উদ্বেগের কারণ। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা