হারুনকাণ্ড
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২৩:৪২ পিএম
আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:২১ এএম
এডিসি সানজিদা আফরিন। ফাইল ছবি
অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগের দুই নেতাকে মারধরের ঘটনা নিয়ে মুখ খুলেছেন আলোচিত নারী পুলিশ কর্মকর্তা সানজিদা আফরিন। ৩১তম বিসিএস পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেছেন, তার স্বামী রাষ্ট্রপতির একান্ত সহকারী সচিব (এপিএস) আজিজুল হক এডিসি হারুনকে প্রথম মারধর করেছেন। সানজিদার মতো কথা বলেছেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশীদও। তবে এ বিষয়ে এপিএস আজিজুলের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দিনভর এসব ঘটনার মধ্যেই সাময়িক বরখাস্ত থাকা হারুনকে রংপুর ডিআইজি রেঞ্জ কার্যালয়ে সংযুক্ত করার আদেশ হয়েছে।
এদিকে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে থানায় নিয়ে বেধড়ক মারধরের সঙ্গে শাহবাগ থানার অন্তত ১০ জন পুলিশ সদস্যের অংশ নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। তাদের মধ্যে হারুনের অন্যতম সহযোগী শাহবাগ থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) গোলাম মোস্তফাকে কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকজনকে প্রত্যাহার করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দুই নেতাকে থানায় ধরে নিয়ে মারধরের ঘটনায় ডিএমপি কমিশনার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে ডিএমপির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সানজিদা বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকদিন ধরে সিভিয়ার চেস্ট পেইনে (তীব্র ব্যথায়) ভুগছিলাম। সেদিন (ঘটনার দিন) পেইনটা একটু বেশিই অনুভূত হচ্ছিল। তাই তখন আমার একজন ডাক্তার দরকার ছিল। যেহেতু ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল স্যারের (হারুন অর রশীদ) জুরিসডিকশনের মধ্যে পড়ে, তাই ডাক্তারের সিরিয়াল পাওয়ার জন্য আমি স্যারের হেল্প চেয়েছিলাম। স্যারকে জানালে তিনি আমাকে বলেছিলেন ঠিক আছে, আমি আশপাশে আছি। আমি এসে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে দিচ্ছি। এরপর স্যার আসলেন। আসার পর একজন ডাক্তার ম্যানেজ হলো। এরপর তিনি কিছু টেস্ট দিলেন। আমি ব্লাড টেস্টের জন্য স্যাম্পল দিলাম। ইকো আর ইসিজিও করানো হলো।’
এডিসি সানজিদা বলেন, ‘এই ঘটনার সময় যে রুমে ইটিটি করানো হয় সেই রুমে ছিলাম আমি। ইটিটি করানোর ১৫/২০ মিনিট পর আমি বাইরে একটা গন্ডগোলের শব্দ শুনি। আমার কানে প্রথম এসেছিল হারুন স্যারের কণ্ঠÑ ‘ভাইয়া, আপনি আমার গায়ে হাত দিলেন কেন? আপনি তো আমাকে মারতে পারেন না। আমাকে মারছেন কেন? এরপর হট্টগোলের মধ্যে দেখলাম আমার হাজবেন্ডসহ বেশ কয়েকজন স্যারকে (হারুন অর রশীদ) মারতে মারতে ইটিটি রুমের ভেতরে নিয়ে আসলেন। ওই সময় স্যার নিজের সেফটির জন্য আমি যেখানে দাঁড়ানো ছিলাম সেই রুমের কোনার দিকে দৌড়ে এসে দাঁড়ালেন। ইটিটি রুমে এত লোক ঢোকার কারণে তখন সেখানে একটা বিশ্রী পরিবেশ তৈরি হয়। তখন আমি চিৎকার করছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘এরপর আমার হাজবেন্ড তার সঙ্গে থাকা লোকজনকে বললেনÑ এই, ভিডিও কর। এরপর সবাই ফোন বের করে ভিডিও করা শুরু করে। যখন তারা ভিডিও শুরু করে, তখন আমি আমার হাজবেন্ড এবং তার সঙ্গে থাকা লোকজনের সঙ্গে চিল্লাচিল্লি শুরু করছিলাম। যারা ভিডিও করছে আমি তাদের মোবাইল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। এ সময় তাদের হাতের সঙ্গে লেগে আমার হাতেও সামান্য ব্যথা পাই। কারণ আমি চাচ্ছিলাম না ওই অবস্থায় কেউ আমার ভিডিও করুক। আর আমার হাজবেন্ডের সঙ্গে যেসব ছেলে ছিল আমি তাদের কাউকে চিনতামও না। ‘ওই অবস্থায় আমার হাজবেন্ড আমার গায়ে হাত তোলে এবং স্যারকে বের করার চেষ্টা করে। তখন স্যারের কাছে বিষয়টি সেফ মনে হয়নি। এরপর স্যার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। তখন হাসপাতালের সিকিউরিটির লোকজনও এলেন। এর ১০/১৫ মিনিট পর থানা থেকে ফোর্স এলে তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়।’ এসব ঘটনার স্থান কোথায় এবং কয়টার দিকের ঘটনাটি ঘটে? জানতে চাইলে সানজিদা আফরিন বলেন, ‘আমার ডাক্তার দেখানোর সিরিয়াল ছিল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে স্যার (হারুন অর রশীদ) এসেছিলেন; পরে ডাক্তারও এসেছিলেন। এরপর আমি ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকি। ঘটনা ঘটেছে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের চারতলার কার্ডিওলজি বিভাগে।’
আরও পড়ুন: এবার হারুনকে রংপুরে বদলি
আপনি অসুস্থ, সেটা আপনার হাজবেন্ড (আজিজুল হক) জানতেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে সানজিদা বলেন, ‘আমি অসুস্থ সেটা আমার হাজবেন্ড জানত। কিন্তু আমি যে সেদিনই ডাক্তার দেখাতে যাব, সেটা সে জানত না। এর আগেও বিভিন্ন সময় ডাক্তার দেখানোর কথা ছিল। কিন্তু সামহাউ সে মিস করে গিয়েছিল অথবা বিজি ছিল। যেহেতু ৬/৭ দিন ধরে আমার সিভিয়ার চেস্ট পেইন হচ্ছিল… যাই হোক, সব সময় তো পরিস্থিতি একরকম থাকে না যে আমি তার সঙ্গে শেয়ার করব। যেহেতু আমার সিভিয়ার পেইন হচ্ছিল, তাই আমি নিজেই ডাক্তারের কাছে গিয়েছি।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ‘পরকীয়া’র অভিযোগের বিষয়ে সানজিদা আফরিন বলেন, ‘উনি (হারুন অর রশীদ) আমার সিনিয়র কলিগ। এর বাইরে আর কোনো বিষয় নেই।’
তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনার পর আমার স্বামীর সঙ্গে আমার আর কোনো কথা হয়নি। আমি আমার অফিসেই আছি।’
ডিবি পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, এডিসি হারুন অর রশীদের ওপর প্রথমে হামলা হয়েছে। এ হামলার নেতৃত্বে ছিলেন রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক। গতকাল মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের হারুন এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, যে কারণে এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে, যিনি সূত্রপাত করেছেন, তিনিও (রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক) একজন সরকারি কর্মকর্তা। উনি আমাদের পুলিশের ওপর হামলা করেছেন। তিনি তো ইচ্ছা করলে আমাদের (পুলিশ) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাতে পারতেন, অবহিত করতে পারতেন। অথবা তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন। সেটি না করে হাসপাতালের ভেতরে অসংখ্য মানুষের সামনে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ধাওয়া করেন। তার চশমা ভেঙে ফেলেন, তার ওপর আঘাত করেন। এটা তিনি সঠিক করেছেন কি না, আমি জানি না। তবে এটারও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।’
পুলিশ বাহিনী কখনও কোনো কর্মকর্তার ব্যক্তিগত দায় নেয় না উল্লেখ করে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ‘পুলিশ বাংলাদেশে একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে যারা যে অপরাধ করছেন, সেই অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আমি মনে করি, এ ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে তদন্ত করছেন এবং করবেন। তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা যখন প্রতিবেদন দেবেন, তখনই বুঝতে পারবেন প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে।’
হারুন, সানজিদা ও আজিজের মধ্যকার বিরোধকে ঘিরে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে মারধরের ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় চলছে। হারুনকে দুই দফা বদলির পর সাময়িক রবখাস্ত ও পরে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়েছে। চলছে তদন্ত কমিটির কার্যক্রম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে নানা কথা হচ্ছে। ঘটনার সূত্রপাত যাকে নিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক মামুন। প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য দেননি।
শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগের দুই নেতাকে ধরে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেনকে দেখতে যান। এসময় কমিশনার বলেন, ‘সেদিন থানায় যা ঘটেছে, সে জন্য আমি গভীরভাবে দুঃখপ্রকাশ করছি। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা নাঈম (আনোয়ার হোসেন) আহত হয়েছেন। তার শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসার খবর নিতে সহকর্মীদের নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। এখনও তিনি (আনোয়ার) বেশ অসুস্থ। সুস্থ হতে আরও একটু সময় লাগবে।’
গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর যারা জড়িত তাদের বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ বিধি অনুযায়ী অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তদন্ত কমিটি পুরো ঘটনা তদন্ত করে দেখবে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘কমিটি সার্বিক ঘটনার তদন্ত করবে। কার কতটুকু দোষ, কারা গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, কারা মারপিটে অংশ নিয়েছেÑ এমনিতে তো আর সেটা বোঝা যায় না। আমরা আপাতদৃষ্টে দেখেছি, একজন ছাত্রকে থানার ভেতরে মারধর করা হয়েছেÑ যেটা বেআইনি। এ কারণে আমরা অ্যাকশন (ব্যবস্থা) নিয়েছি। ঘটনাটি কেন ঘটল, ঘটনায় কে কে দোষী, কতটুকু দোষী সবই নিরূপণ করবে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুসারে আমরা ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের বলব।’
ডিএমপি কমিশনারের গঠিত তদন্ত কমিটির তিন সদস্য হলেনÑ ডিএমপির উপকমিশনার (অপারেশনস) আবু ইউসুফ, রমনা বিভাগের এডিসি শাহেন শাহ্ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগের এডিসি রফিকুল ইসলাম।
ডিএমপি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান আবু ইউসুফ বলেন, আমরা কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। সিসি ক্যামেরার একাধিক ফুটেজও নিয়েছি। নির্যাতনের শিকার ছাত্রলীগ নেতা ও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক ও তার স্ত্রী ডিএমপির আরেক এডিসিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করব। তাদের ঘিরেই ঘটনার সূত্রপাত। আমাদের আরও কিছু সময় প্রয়োজন হতে পারে।
রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হকের সঙ্গে বরখাস্ত এডিসি হারুন অর রশীদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে গত শনিবার ছাত্রলীগের তিন নেতাকে মারধর করা হয়।