× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ঢাকা ওয়াসা

তাকসিমে মধু না জাদু

ফয়সাল খান

প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৩ ০০:৪৬ এএম

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। সংগৃহীত ছবি

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। সংগৃহীত ছবি

ঢাকায় ‘বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে ব্যর্থ’ হওয়ার পরও বারবার ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে তাকসিম এ খানকে নিয়োগ দিচ্ছে সরকার। এবার নিয়ে টানা সপ্তমবারের মতো সংস্থাটির এমডি হয়েছেন তিনি। তার এ নিয়োগের ফলে নাগরিক সমাজ ও বিশিষ্টজনরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেও তাকসিম এ খানের ঘনিষ্ঠজনদের দাবি সফল হওয়ায় সরকার বারবার তাকে এ পদে বসাচ্ছে।

নাগরিক সমাজ বলছে, ওয়াসার বর্তমান প্রশাসন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে ব্যর্থ। স্যুয়ারেজ নেটওয়ার্ক তৈরিতেও তাদের সফলতা নেই। অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিস্তর অভিযোগ তদন্ত না করে বারবার তাকসিম এ খানকে নিয়োগ দেওয়ায় তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছে।

তাকসিমের বিরুদ্ধে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো, ঠিকাদার নিয়োগে সিন্ডিকেট, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ২০২১ সালে ঢাকা ওয়াসার ১১টি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল দুদক। সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক দুই সদস্যের দলও গঠন করেছে। তা ছাড়া ওয়াসার অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা বলায় অনেককেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সবশেষ মন্ত্রণালয়ে এমডির অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ করার পর চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে সরকারি বিধি ভঙ্গ করে নিজের এখতিয়ারবহির্ভূত অডিট ফার্ম নিয়োগ দেন তাকসিম। একইভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কথা বলায় ছয়জন ইঞ্জিনিয়ার এবং এক ডজন কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া ১০ থেকে ১২ জনকে বরখাস্ত করার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা জানান, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ওয়াসা সম্পর্কে নেতিবাচক খবরকে পাত্তা দিতে চান না এমডি। অডিট ফার্ম নিয়োগে স্পষ্ট অনিয়ম হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, একজন ব্যক্তিকে একই পদে বারবার পদায়ন করা কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো নয়। এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য তার চেয়ে যোগ্য লোক আছেন। এমডির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ এসেছে, এমনকি সংস্থার চেয়ারম্যানও তার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এসব অভিযোগ নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের উদ্যোগ কখনও দেখা যায়নি।

তিনি আরও বলেন, ওয়াসা এমডি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে অফিস করেন, তিনি এমন কিছু সংস্কৃতি তৈরি করেছেন যেটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যায় না। তবুও বিস্ময়করভাবে তিনি বারবার পুনরায় নিয়োগ পাচ্ছেন।

সপ্তমবার ওয়াসার এমডি

১৩ বছর ধরে ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে আছেন তাকসিম এ খান। তিনিসহ তার স্ত্রী ও সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। ওয়াসার এমডি হওয়ার আগে তিনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেছেন। ওয়াসার এমডি পদে ২০০৯ সালে নিয়োগ পান তাকসিম। ওই সময় নিয়োগের জন্য দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে অথবা সিনিয়র পর্যায়ে সাধারণ প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ২০ বছরের আবশ্যিক অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা না থাকার পরও তিনি নিয়োগ পান। ওই সময় তার বেতন ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ধাপে ধাপে বেড়ে বর্তমানে সর্বসাকুল্যে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেতন নিচ্ছেন। করোনা মহামারির মধ্যেও প্রায় ২ লাখ টাকা বেতন বেড়েছে তার। 

এদিকে বৃহস্পতিবার স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ অনুবিভাগ থেকে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে তাকসিম এ খানকে এমডি পদে পুনর্নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ২০০৯ সালে প্রথমবার নিয়োগ পান তিনি। প্রথম মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বোর্ড তিন বছরের প্রস্তাব দিলে সরকার ২০১২ সালে এক বছরের জন্য মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। ২০১২ সালে বোর্ডের করা তিন বছরের প্রস্তাবের অবশিষ্ট দুই বছরের মেয়াদ ২০১৩ সালে বৃদ্ধি করা হয়। ২০১৫ সালের পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিজের দেওয়া শর্তমতো তিন বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। ২০১৮ সালে তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নির্দেশমতো বোর্ড তিন বছরের জন্য প্রস্তাব দেয় বলে অভিযোগ আছে। ২০২০ সালে বোর্ড আবারও তাকসিমের মেয়াদ তিন বছরের জন্য বৃদ্ধির প্রস্তাব দিলে সরকার তা অনুমোদন করে। এবারও ৩ বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন।

যা বলছেন ঘনিষ্ঠজনরা

তাকসিম এ খানের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে প্রধানমন্ত্রী তাকে বারবার এ পদে দায়িত্ব দিচ্ছেন বলে দাবি করছেন ওয়াসার কর্মকর্তাদের একটি অংশ। তারা বলছেন, তাকসিম এমডির দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজধানীজুড়ে পানির আধুনিক সংযোগসহ আমূল পরিবর্তন এসেছে। তা ছাড়া একসময় রাজধানীতে পানির জন্য বিক্ষোভ মিছিল হতো। এখন নাগরিক ক্ষোভ কমেছে।

ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শহিদ উদ্দিন বলেন, একসময়ে ঢাকা ওয়াসার উৎপাদিত পানির শতকরা ৪০ শতাংশ সিস্টেম লস হিসেবে ধরা হলেও সেটি কমে মাত্র ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। এর মূল কারণ ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (ডিডব্লিএসএনআইপি)। এই প্রকল্পের ফলে পানির গতি প্রবাহ ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। রাজধানীর কয়েক কোটি মানুষের প্রতিদিনের পানির চাহিদা ২৬০ কোটি লিটার। এই চাহিদা মেটাতে ঢাকা ওয়াসা সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার ও পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগার স্থাপন করেছে। মোট চাহিদার বিপরীতে ঢাকা ওয়াসা এখন ২৭০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করছে।

দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। প্রতিদিন ৫০ মিলিয়ন লিটার পয়ঃশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম একক পয়ঃশোধন কেন্দ্র (এসটিপি) এটি। এসব কাজের পুরস্কার হিসেবে তাকসিম এ খানকে বারবার এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

ক্ষুব্ধ সাধারণ নাগরিক

২০১৯ সালে ঢাকা ওয়াসার ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে পান করেন বলে জানায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)। এ-সংক্রান্ত তাদের এক গবেষণার বরাত দিয়ে জানানো হয়, এই পানি ফোটাতেই বছরে জ্বালানি বাবদ ব্যয় হচ্ছে ৩৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ বাসাবাড়িতে ৩৬ কোটি ৫৭ লাখ ৩৭ হাজার ঘনমিটার গ্যাস পুড়ছে পানি বিশুদ্ধকরণে।

বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে চার বছর আগে তাকসিম এ খানকে ওয়াসার পানি দিয়ে শরবত খাওয়াতে এসেছিলেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। ওই সময় এমডিকে শরবত খাওয়াতে না পারলেও ওয়াসা প্রশাসন তাদের বিশুদ্ধ পানি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু চার বছর পরও এই আশ্বাসের কোনো ফল পাননি তারা। পূর্ব জুরাইন এলাকার দেড় লাখ মানুষ ওয়াসার পানি পান করেন না। ঢাকার অন্যান্য এলাকায়ও একই অবস্থা। আন্দোলকারীদের একজন জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে ওয়াসা পানি দেয়। আমি একজন নাগরিক হিসেবে কল ছেড়ে সরাসরি সেই পানি পান করতে চাই। কিন্তু ঢাকার কোনো এলাকায় কি ওয়াসার পানি না ফুটিয়ে পান করা যাবে?’

ওয়াসার দাবি করা সফলতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি যদি পানির বদলে মানুষকে বিষ দেন, তাহলে আমরা কীভাবে বলব ঢাকায় পানির সংকট নেই। আপনি বিশুদ্ধ পানি দিলে সফল বলতে পারতেন। বিষ দিয়ে তো আর পানির অভাব পূরণ করা যায় না। শুধু পানি না এখন কোনো বিষয়েই মানুষ রাস্তায় নামতে চায় না। রাস্তায় নামলে নানা ধরনের বিপদ-আপদ আসে, তাই কষ্ট হলেও মানুষ সহ্য করছে। এখন অনেকেরই টাইফয়েড জ্বর হচ্ছে। দুই দিনে আমার এলাকার অন্তত ৬ জন টাইফয়েডে আক্তান্ত হওয়ার খবর পেয়েছি।’ 

মিজানুর আরও বলেন, এসব বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতেও লজ্জা লাগে। অনিয়ম-দুর্নীতি করে পদ্মা-মেঘনা থেকে পানি নিয়ে আসছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর বোঝা তো আমাদেরকেই বইতে হচ্ছে। 

রামপুরা এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন,  ফোটানো ছাড়া ওয়াসার পানি পান করার চিন্তাও করা যায় না। আমার এক বছরের বাচ্চাকে পানি কিনে গোসল করাই। এরপরও ওয়াসাকে বিল দিতে হচ্ছে। পচা পানি দিয়ে গোসলসহ অন্যান্য সব কাজ সারতে হচ্ছে। 

শুধু অনুন্নত এলাকা নয়, গুলশান-বনানী, উত্তরা ও বারিধারায়ও পানির সংকটে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। বিশুদ্ধ পানি তো দূরের কথা একটানা ৫/৬ দিন গোসলসহ দৈনন্দিন ব্যবহার্য পানিও পান না অনেকে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা