× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আইএমইডি প্রতিবেদন

মডেল মসজিদে ‘মডেল অনিয়ম’

এম আর মাসফি

প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৩ ০৯:৪৫ এএম

আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২৩ ১৫:৩১ পিএম

মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্রবা ফাইল ফটো

মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্রবা ফাইল ফটো

রাজশাহীর গোদাগাড়ী। ২০২১ সালের জুনে মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষ হয় এখানে। কিন্তু পরিদর্শনে দেখা গেছে, মডেল মসজিদটির কাঠের দরজা ত্রুটিপূর্ণ। চারটি প্লাস্টিকের দরজাও নিম্নমানের। ঝড়বৃষ্টি হলে রয়েছে জানালার গ্লাস খুলে পড়ার আশঙ্কা। মসজিদ ভবনের বৈদ্যুতিক কাজের মানও ভালো না। বৃষ্টি হলে বিদ্যুৎ লাইনে পানি চলে আসে। ফ্যানের সুইচবোর্ড একেবারেই নিম্নমানের। সেপটিক ট্যাংকের সম্মুখে প্লাস্টার নেই। পিলার, দেয়াল ও মিনারে ফাটল ধরেছে। মার্বেল পাথর ভাঙা। মসজিদের গেটের সামনে পানি জমে যায়। সার্বিক কাজের মানও ভালো না।

শুধু এই মসজিদ নয়, দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি হিসেবে মোট ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এই প্রকল্পের অধিকাংশ মসজিদ নির্মাণেই এমন চিত্র দেখা গেছে। সম্প্রতি প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষার জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ডেভেলপমেন্ট টেকনিক্যাল কনসালট্যান্টস (প্রা.) লিমিটেডকে (ডিটিসিএল) পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি ৫৬০টি মডেল মসজিদ থেকে সম্পন্ন এবং কাজ চলমান রয়েছে এরকম ১৭৫টি নমুনা মডেল মসজিদ পরিদর্শন করে নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে মডেল মসজিদ নির্মাণে অনিয়মের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। অনিয়মকারীরা সরকারের এই মডেল প্রকল্পটিকে যেন ‘অনিয়মের মডেল’ হিসেবেই বেছে নিয়েছে।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ নির্মাণেও অনিয়ম-দুর্নীতি হতে পারে এটা শুনে ইসলামি চিন্তাবিদরা বিস্মিত হয়েছেন। তাদের মতে, যারা সরকারের এই মহত উদ্যোগকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালিয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

কিছু সরেজমিন তথ্য

আইএমইডির সরেজমিন প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, কুমিল্লার চান্দিনায় নির্মিত মডেল মসজিদের অবস্থান উপজেলা প্রশাসন থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মাধইয়া বাজার সংলগ্ন এলাকায়। এটির কাছাকাছি রয়েছে আরও তিনটি মসজিদ। তবে আশপাশে জনবসতি কম। তাই মডেল মসজিদে নামাজ পড়ার মুসল্লি সংখ্যা কম। স্থানীয়দের অভিমত, মডেল মসজিদের স্থান উপজেলা প্রশাসন সংলগ্ন এলাকায় নির্ধারণ হলে ভালো হতো; মাধইয়া বাজারের কাছে মসজিদ স্থাপন করা যথাযথ হয়নি।

উল্লাপাড়া মডেল মসজিদের পরিদর্শন কালে দেখা যায়, প্রায় ৭০টি পিলার কাজ হয়েছে যার মধ্যে ৪৯টি পিলারের কাজ ভয়াবহ ত্রুটি রয়েছে। পিলারের এলাইমেন্ট ঠিক নাই। এ সব পিলারের কাজ ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সঙ্গে সঙ্গে মাটি ভরাটের কাজ চলছিল। পিলারের জায়গা থেকে শুরু করে রডের ব্যবহার স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়নি। পিলারের রড বের হয়ে আছে। 

এদিকে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় নির্মিত মডেল মসজিদ পরিদর্শনে দেখা গেছে, ৭০টি পিলারের কাজ হলেও সেগুলোর ৪৯টিই ভয়াবহ ত্রুটিপূর্ণ। পিলারের অ্যালাইনমেন্ট ঠিক নেই, রডও বেরিয়ে আছে। মাটি ভরাট করে পিলার নির্মাণের এই ত্রুটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পিলারের জায়গা থেকে শুরু করে রডের ব্যবহারও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী হয়নি। মডেল মসজিদটি এমন নিম্নমানের হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে নির্মাণকাজে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পালিয়ে গেছে। বর্তমানে এর নির্মাণকাজ বন্ধ আছে।

চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার মডেল মসজিদ পরিদর্শনে দেখা যায়, মসজিদের ছাদ ঢালাইয়ের পুরুত্ব ৬ ইঞ্চি হওয়ার কথা থাকলেও ৫.৫ ইঞ্চি করা হয়েছে। সাইটে মজুদ পাথরের কিছু অংশে মাটির মিশ্রণ দেখা গেছে। জানালার গ্রিল ১২ মিমি ব্যবহার করার কথা থাকলেও ব্যবহৃত হয়েছে ১০ মিমি গ্রিল। কলাম ঢালাই যথাযথ হয়নি, হানিকম্ব দেখা গেছে। নির্মাণের জন্য আনা ইটের গুণগত মানও খারাপ।

প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে

সমীক্ষার আওতায় পরিদর্শনকৃত মডেল মসজিদগুলোতে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের কোরআন হেফজ ও হজযাত্রীদের ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে না। স্থানীয় পর্যায়ে দ্বীনি দাওয়াত কার্যক্রমও পরিচালনা করানো হয় না। প্রকল্পে উল্লেখ থাকলেও নির্মিত মসজিদগুলোতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা আলাদাভাবে নামাজ আদায় করে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের শুরুতে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। যা এটির একটি দুর্বল দিক। প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে সমস্যা ছিল। মডেল মসজিদের নির্মাণকাজে ধীরগতি একটি বড় সমস্যা। অনেক মসজিদের সঙ্গে সংযোগ সড়ক নেই। প্রকল্পে পর্যাপ্ত জনবল এবং মনিটরিংয়ের অভাব দেখা গেছে। মডেল মসজিদের সামনে সিঁড়ি অনেক উঁচু হওয়ায় বয়স্ক মুসল্লিদের মসজিদে প্রবেশ ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিটিসিএলের এ সমীক্ষায় ১ হাজার ৭৫০ জন অংশ নিয়েছেন। ৭২ শতাংশ অংশগ্রহণকারীই বলেছেন, মডেল মসজিদ নির্মাণে স্থান নির্বাচন সঠিক হয়নি। তারা মনে করেন, মসজিদ মূল সড়কের পাশে হলে ভালো হতো। ৩৭ শতাংশ বলেছেন, কাজের মান তেমন ভালো হয়নি। 

প্রকল্পে সংশোধন এসেছে দুবার

২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশে ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা বিকাশের অবকাঠামোগত সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীবিশিষ্ট, ইসলামিক কার্যক্রমের সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরই আলোকে ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল একনেক সভায় প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প (২য় সংশোধিত) অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটি এপ্রিল ২০১৭ থেকে ডিসেম্বর ২০১৯ মেয়াদে এবং ৯ হাজার ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। 

শুরুতে প্রকল্পটি সৌদি সরকারের সহায়তায় বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর পেরিয়ে গেলেও বৈদেশিক সাহায্য না পাওয়ায় ২০১৮ সালের ২৬ জুন এতে প্রথম সংশোধন করা হয়। সংশোধনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়Ñ এটি সরকারের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হবে এবং প্রকল্পের এ-টাইপ মসজিদের ক্ষেত্রে ৫-তলা ভিতের বদলে ৪-তলা ভিতবিশিষ্ট ৪-তলা মসজিদ, বি-টাইপ মসজিদের ক্ষেত্রে ৪-তলা ভিতের বদলে ৩-তলা ভিতবিশিষ্ট ৩-তলা মসজিদ এবং সি-টাইপ মসজিদের ক্ষেত্রে ৫-তলা ভিতের বদলে ৪-তলা ভিতবিশিষ্ট ৪-তলা মসজিদ নির্মাণ করা হবে। তখন প্রকল্পের মেয়াদ এপ্রিল ২০১৭ থেকে জুন ২০২২ এবং ব্যয় ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা নির্ধারণ করে প্রথম সংশোধন করা হয়। কিন্তু কাজ শেষ করতে না পারায় ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর এর মেয়াদ ও ব্যয় উভয়ই বাড়ানো হয়। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে জুন ২০২৪ করা হয়। ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এভাবে একনেক সভার মাধ্যমে প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধন আসে।

প্রকল্পটি দেশের ৮টি বিভাগের ৬৪টি জেলার ৪৯৫টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের শুরু থেকে এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৫৫ দশমিক ১৬ শতাংশ ও বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৬০ শতাংশ। এ পর্যন্ত মোট ২০০টি মডেল মসজিদের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং সেগুলোর উদ্বোধনও হয়েছে। প্রকল্পটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হলেও পূর্ত কাজ করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের মেয়াদ আছে আর মাত্র এক অর্থবছর। এত অল্প সময়ের মধ্যে প্রকল্পের বাকি কাজ সম্পূর্ণ করা কষ্টসাধ্য বলে মনে করছে আইএমইডি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মন্তব্য

প্রকল্পটিতে অনিয়ম ও নিম্নমানের কাজে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রতিবেদনের আলোকে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এই খারাপ কাজের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলব। এবার শুধু তাদের কাছে প্রতিবেদনই দেব না, প্রতিবেদনের আলোকে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তারও তদারকি করব।’

মডেল মসজিদ প্রকল্পে অনিয়মের বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক মো. নজিবুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রকল্পে বড় ধরনের কোনো অনিয়ম হয়নি। ছোটখাটো কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে। সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। উল্লাপাড়ায় পিলারগুলো ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। বিদ্যুতের কাজে আমরা ভালো মানের পণ্য ব্যবহার করেছি। আইএমইডি যে তথ্য সংগ্রহ করেছে, সেটাই সঠিকভাবে হয়নি। তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা কয়েকজন স্টুডেন্ট পাঠিয়েছে, তারা কী বোঝে? দুই-একটা সুইচ নষ্ট পেয়েছে, বলে দিয়েছে ফিটিংস খারাপ।’

প্রকল্পটিতে অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান বলেন, ‘আমরা আইএমইডির প্রতিবেদনটি হাতে পেলে পড়ে সেখানে কোনো অনিয়ম পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। আমরা সব সময় আপ্রাণ চেষ্টা করছি প্রকল্পকে দুর্নীতি-অনিয়মের বাইরে রাখতে।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা