× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ই-অরেঞ্জের টাকা আত্মসাৎ

পুলিশ পরিদর্শক সোহেলের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২২ ১৯:৩৫ পিএম

সোহেল রানা

সোহেল রানা

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের গ্রাহকের প্রায় সাড়ে ২৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষক সোহেল রানার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুনীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল বৃহস্পতিবার দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ সংস্থাটির উপপরিচালক মো. মোনায়েম হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এর আগে গত ৪ জুলাই কমিশন থেকে মামলাটি অনুমোদন দেয়া হয়। সোহেল রানা বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ছিলেন। তাকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বরখাস্ত করা হয়। দুদকের জনসংযোগ শাখা মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে। 

দুদকের তথ্যমতে, রাজধানীর বনানী থানার পুলিশ পরিদর্শক (বরখাস্ত) সোহেল রানার বিরুদ্ধে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ১ লাখ গ্রাহকের ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, বিদেশে পাচার সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর গত ১৩ মার্চ সংস্থাটির উপপরিচালক মো. মোনায়েম হোসেনকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে তদারক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। অনুসন্ধান কর্মকর্তা তার প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে ৩১টি ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে ২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকার বেশি আত্মসাতের তথ্য-প্রমাণ পেয়ে মামলা দায়ের করার অনুমোদন দিতে কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেন। কমিশন প্রতিবেদন যাচাই শেষে গত ৪ জুলাই মামলা দায়ের করার অনুমোদন দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. মোনায়েম হোসেন বাদী হয়ে অর্থ আত্মসাৎ ও মানিলংন্ডারিং আইনে সোহেল রানার বিরুদ্ধে মামলা দায়ে করেন।  

দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, সোহেল রানা নিজের পদ পদবি আড়াল করে দুর্নীতি সম্পৃক্ত অপরাধে ই-অরেঞ্জ নামীয় এমএলএম কোম্পানি খোলেন। এরপর প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি লাভের প্রলোভন দেখিয়ে তার নিজ নামে ও তার সংশ্লিষ্টদের নামে পরিচালিত ছয়টি ব্যাংকের ৩১ হিসাবে মোট ২৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৭ হাজার ৬৫০ টাকা জমা করেন। যার মধ্যে ২৮ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার ৯১৩ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ কনেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারা, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় মামলা অনুমোদন দেয় কমিশন।

দুদকের তথ্যমতে, সোহেল রানার বিরুদ্ধে সাড়ে ২৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হলেও  তার বিরুদ্ধে এক লাখ গ্রাহকের ১১০০ কোটি আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারে অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক মো. মোনায়েম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন,  দুদকের অনুসন্ধানে ২৮ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার ৯১৩ টাকা আত্মসাতের তথ্য-প্রমাণ পেয়ে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর বাইরেও সোহেল রানার বিরুদ্ধে আরও অনুসন্ধান চলমান আছে। 

দুদকের টেবিলে থাকা অভিযোগে বলা হয়, সোহেল রানা ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গুলশান থানার এসআই হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখন বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি বিভিন্ন দেশে চুক্তিতে লোক পাঠাতেন। গুলশানের পর দুই বছর মালিবাগে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কর্মরত ছিলেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হওয়ার পর ২০২০ সালের ২৮ মে থেকে বনানী থানায় পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে যোগ দেন। তিনি বনানী দায়িত্ব পালনকালে ২০২০ সালে সেপ্টেম্বরে ই-অরেঞ্জ যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানের মালিক সোহেল রানার বোন-ভগ্নিপতি। প্রতিষ্ঠানটি ডাবল ভাউচার অফার দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেয়। অফারের ভাষ্য ছিল, কেউ এক লাখ টাকা জমা দিলে দুই লাখ টাকার ভাউচার পাবেন। ওই ভাউচার দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে পণ্য কিনতে পারবেন।  

তথ্য বলছে, ই-অরেঞ্জ অগ্রিম টাকা দিয়ে মোবাইলফোন, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্য গ্রাহকের কাছে বিক্রি করতো। প্রতিষ্ঠানটি গত বছরের ১৫ মে থেকে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। 

এর আগেই প্রতিষ্ঠানটি এক লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। অনেক গ্রাহক টাকা দিয়ে কোনো পণ্যই বুঝে পায়নি। এরপরই গত বছরের ১৭ আগস্ট ই-অরেঞ্জের মালিকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে গ্রাহকের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করে তাহেরুল ইসলাম নামে ভুক্তভোগী। মামলায় সোহেল রানার বোন প্রতিষ্ঠানের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, চিফ অপারেটিং অফিসার আমানউল্লাহ, বীথি আক্তার ও কাউসার আহমেদকে আসামি করা হয়। এরপর ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আরও কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়। 

জানা গেছে, মামলায় গ্রাহকের এক হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হলেও ৫০০ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। অবশিষ্ট টাকার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। নানা কৌশলে ই-অরেঞ্জের ব্যাংক হিসাব থেকে গ্রাহকদের টাকা তুলে নিয়েছেন সোহেল রানা। এছাড়া অদিতি নামে তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে প্রায় শতকোটি টাকা তুলে নিয়েছেন তিনি। এসব টাকার একটি বড় অংশ দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। তিনি ইউরোপের পর্তুগালে এক বন্ধুর মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে খুলে তাতে বিনিয়োগ করেছেন। এছাড়া থাইল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যেও অর্থ বিনিয়োগ রয়েছে তার।

অভিযোগে বলা হয়, ই-অরেঞ্জের মাধ্যমে শত কোটি টাকা আত্মসাতের পর নেপাল হয়ে পালিয়ে ইউরোপ যেতে চেয়েছিলেন আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা। নিয়মানুযায়ী সোহেল রানার অফিসিয়াল পাসপোর্ট ব্যবহারের কথা থাকলেও তার পাসপোর্ট ছিল ব্যক্তিগত। এই পাসপোর্টে ইউরোপের শেনজেন, আমেরিকা ও থাইল্যান্ডের ভিসা লাগানো ছিল। সোহেল রানা নেপাল থেকে ইউরোপে ঢুকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অবৈধভাবে ভারত প্রবেশ কাছে বিএসএফ’র হাতে ধরা পড়েন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোহেল রানার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে সরকারের একাধিক সংস্থা। তদন্তে তার দেশে-বিদেশে পাহাড় সমান সম্পদের তথ্য মিলেছে। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, সোহেল রানা দেশে-বিদেশে সমানতালে বিনিয়োগ করেছেন। দেশে শুধুমাত্র ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় তার একডজন ফ্ল্যাট রয়েছে। সবক’টি ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য অর্ধশত কোটি টাকা। এসব ফ্ল্যাটের মধ্যে অভিজাত এলাকা গুলশানের শাহজাদপুরের সুবাস্তু নজরভ্যালির তিন নম্বর টাওয়ারে তার একটি, গুলশান মডেল টাউনে একটি, নিকেতনে একটি ফ্ল্যাট ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই-ব্লকে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। বাকিগুলো বনানী ও উত্তরা এলাকায় রয়েছে। গুলশানের একটি বাণিজ্যিক ভবনে নয় কোটি টাকা দিয়ে জায়গা কিনেছেন। পূর্বাচলে তিন নম্বর সেক্টরে একটি প্লট, কুড়িল বিশ্বরোড সংলগ্ন একটি আবাসিক এলাকার ই এবং আই ব্লকে দুটি প্লট। গুলশান, উত্তরা ও বনানীতে অন্তত ডজনখানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সোহেল রানার। কয়েকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ডিলারশিপ নিয়ে ব্যবসা করছেন এমন তথ্যও পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। গুলশান দুই নম্বরের ডিসিসি মার্কেটের কাঁচাবাজারের পেছনে তার একটি অফিস রয়েছে। সেখানে নিয়মিত বসতেন। গুলশান এলাকায় ব্যবসা করছে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ডিলারশিপ রয়েছে। 

টিঅ্যান্ডজি নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে যার একটি শাখা গুলশানের ডিসিসি মার্কেটে ও অন্যটি উত্তরার গরীব-ই-নেওয়াজ অ্যাভিনিউয়ে। নিজ এলাকা গোপালগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৫০০ বিঘা জমি কিনেছেন এই কর্মকর্তা। পর্যটন এলাকা খাগড়াছড়িতে একটি উন্নতমানের রিসোর্ট তৈরির জন্য জমি কিনেছেন। এছাড়া দেশের বাইরে বিদেশেও রয়েছে সোহেল রানার শতশত কোটি টাকার বিনিয়োগ। এরমধ্যে পর্তুগাল, ফ্রান্স, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, নেপালসহ আরও কয়েকটি দেশে বিভিন্ন সময়ে বিনিয়োগ করেছেন। পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে তার একটি বড় সুপারশপ, একটি বার ও একটি রেস্টুরেন্ট আছে। ফ্রান্সের প্যারিসে একটি রেস্টুরেন্ট ও বার আছে। থাইল্যান্ডের পাতায়ায় কিনেছেন জমি। সেখানে তার একটি ফ্ল্যাট ও একটি সুপারশপ আছে। সেখানে হিলটন হোটেলের পাশে আরেকটি পাঁচতারকা হোটেলে শতকোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। সেখানে একটি বড় প্রতিষ্ঠানেও প্রায় ১০ কোটি টাকা ও ফিলিপাইনের ম্যানিলায় রয়েছে স্ট্রিট বার। নেপালেও তার বিভিন্ন ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা আছে। নেপালে তার একটি বার ও একটি ক্যাসিনো রয়েছে। তবে দেশের বাইরে বিনিয়োগের মধ্যে থাইল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ।

জানা গেছে, গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ মাথায় নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্দায় ওই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে ধরা পড়েন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলেছে, সম্ভবত গা ঢাকা দেওয়ার লক্ষ্যে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন সোহেল রানা। ভারতে আটক হওয়ার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সোহেল রানা অপরাধমূলক একাধিক কাজে নিজের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছেন বিএসএফের কর্মকর্তারা। 


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা