× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শুভ জন্মদিন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

আমাদের প্রাসাদ হচ্ছে কিন্তু রাজহৃদয় দূর অস্ত

মিলা মাহফুজা

প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৩ ১৩:২৯ পিএম

আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২৩ ১৭:৪৩ পিএম

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একজন শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যিক। দেশের আলোচিত সংগঠন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বাঙালির সংগঠন টেকে না এমন অনুযোগ উড়িয়ে দিয়ে যে প্রতিষ্ঠান সগৌরবে ৪৩ বছর পার করে দিয়েছে। আরও অনেক পরিচয় রয়েছে তাঁর। এ দেশে তুমুল জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তিনি। তাঁর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল অনির্ণেয় আলোকশিখার মতো। এই মানুষটির কর্ম-চিন্তা-যাপন ইত্যাদি ঘিরে নানা প্রশ্নে এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন কথাসাহিত্যিক মিলা মাহফুজা।

কোভিড মহামারি সংক্রমণের কারণে তিনি প্রায় দুই বছর স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে ঘরে ছিলেন। তাঁর মতো কর্মযোগীর পক্ষে এই কর্মহীন বন্দিত্ব কেমন ছিল? এই দীর্ঘ সময় তিনি কীভাবে কাটালেন? তাঁর কৌতূহলী অনুরাগীদের জন্য এ প্রশ্নের উত্তর জানতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। সময়টা ছিল ২০২২ সালের এপ্রিল। ভেবেছিলাম রাজি হবেন না। কোভিডের প্রতাপ কমে গেলেও তিনি তখনও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। আমার সৌভাগ্য তিনি সময় দিতে রাজি হলেন। নির্দিষ্ট দিনে চলে গেলাম তাঁর সেন্ট্রাল রোডের বাসায়। দরজা খুললেন নিজেই। আজ ২৫ জুলাই, ২০২৩-এ তিনি ৮৩ পার করে ৮৪ বছরে প্রবেশ করলেন। তাঁকে দেখে বলাই যায়, বয়স পরাভব মেনেছে তাঁর কাছে। হাসিটি তেমনি প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল ও প্রত্যয়দীপ্ত।

তিনি বললেন, করোনার অতটা দাপট নেই এখন, আমরা মাস্ক ছাড়াই কথা বলতে পারি বোধহয়। সময় বেশি দিতে পারব না। ১২টায় আমার অন্য কাজ আছে। বাড়ির বাইরে যাই না, তবে কাজ পিছু ছাড়েনি। লেখালেখি করছি।

আমরা বসার একটু পরই ভেতর থেকে তাঁর স্ত্রী রওশন আরা, যাঁকে ‘ভাবি’ সম্বোধন করি বরাবরই, এলেন। অতি সজ্জন মানুষ। আমরা যারা কোনো না কোনো সময় কেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম, তাদের সবার সঙ্গেই তাঁর হার্দ্য সম্পর্ক। আমরা কুশল বিনিময় ও অন্যান্য কথায় মেতে উঠলে ‘আসছি’ বলে স্যার উঠে ভেতরে গেলেন। ভাবি বরাবরই আমার পেন নেম পুরোটা ধরে ডাকেন। তিনি বললেন, মিলা মাহফুজা, আপনার বয়স বেড়েছে তবে খুব বেশি বদলাননি। ভালো লাগল আপনাকে দেখে।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, এটা স্যারের প্রভাব। মনে তারুণ্য ধরে রাখা।

এ সময় স্যার ফিরে এলেন। আমি আবারও লক্ষ করি সম্ভবত দীর্ঘদিন ঘরে খানিকটা সুস্থির জীবন কাটানোয় স্যারের চেহারায় বেশ একটা উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে। আগের পরিশ্রমক্লান্ত ভাবটা নেই। চা-বিস্কুট, ফল এলো। চায়ে চুমুক দিয়ে স্যার বললেন, আমরা শুরু করতে পারি।

আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম, নির্দিষ্ট সময়ের ২০ মিনিট পার হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। স্যারের আগের কথার রেশ ধরে জানতে চাইলাম-

আপনি বলেছেন, করোনায় অবরুদ্ধ সময়টায় আপনার খারাপ কাটেনি। আপনার একটা কষ্ট ছিল, আপনি একজন লেখক কিন্তু লেখার সময় পেয়েছেন কম। করোনায় বাইরে যাওয়া সম্ভব হয়নি, তাই কি এ সময়টা লেখার কাজে ব্যয় করলেন?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : করোনায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় সব কর্মসূচি বন্ধ রাখতে হয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছু উপকার হয়েছে। লেখালেখি করেছি। প্রচুর লিখেছি তা নয়, নতুন চারটে বই লিখেছি। তবে ৩৮টি বই পরিমার্জন ও সংশোধন করেছি, দুবার করে। প্রথম লেখার পর ওই লেখাগুলো আর দেখার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। কিন্তু বইগুলো ওই অবস্থায় বাজারে থাকুক, পাঠকের হাতে যাক, সেটা ঠিক না। বইয়ের পরিশীলিত চেহারা দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম, এবার সেটা করতে পেরেছি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব লেখাই বহুবার সংশোধন করতেন।

এ বইগুলো কি কেন্দ্রসম্পর্কিত?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : না, সব কেন্দ্র নিয়ে নয়। গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ, আত্মজীবনী আছে। আত্মজীবনীই ২২০০ পৃষ্ঠা। ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক, আমার উপস্থাপক জীবন’- এ ধরনের গোটা দশেক বই এর মধ্যে পড়ে। এখন একটা লিখছি, নাম ‘আলোর ইস্কুল’। এটা কত বড় হবে জানি না। আমি বইয়ের ওপর লিখে দেব ‘পড়িবার জন্য নহে। নাড়াচাড়া করিবার জন্য’। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আমি- এ বইটি হচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আইডিয়া। আর আলোর ইস্কুল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সুখদুঃখময় যাত্রা ও সংগ্রামের গল্প।

আলোর ইস্কুল বই শুরু করেছেন কোথা থেকে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : কেন্দ্র গড়ার একেবারে প্রথম দিকে একদিন সাংবাদিক আবেদ খানের বাসায় আড্ডা দিতে দিতে আমি কেন্দ্রের স্বপ্নের কথা বলি। সেই স্বপ্নের পথ ধরে একদিন আমরা ১০ জন সভ্য জোগাড় করে নায়েম অডিটরিয়ামে জড়ো হই। ঠিক হলো পরের সপ্তাহে প্রত্যেকে পড়ে আসবে একটা বই। বইটি হলো জসীমউদদীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, প্রতিটি বইয়ের দাম সাড়ে তিন টাকা। অর্থাৎ ১০ জনের জন্য ১০টি বই কিনতে হলে আমাদের লাগবে ৩৫ টাকা। কিন্তু এত টাকা আমাদের নেই। অনুষ্ঠানে ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান। সেকালের ঢাকার খুব বিখ্যাত মানুষ। তিনি কিনে দিলেন বইগুলো। উনি ছাড়া আরও কয়েকজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা উপস্থিত ছিলেন সে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তারপর কত কষ্ট, কত দুঃখ, কত আনন্দের মধ্য দিয়ে চলছে আমাদের যাত্রাপথ।

৪২ বছর হয়ে গেল কেন্দ্রের বয়স...

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : হ্যাঁ, তা হলো। এ সময়ে আমরা ২ কোটি ছেলেমেয়েকে বই পড়িয়েছি। আমার মনে হয় এর ১ ভাগও যদি অল্প কিছু অবদান রাখে তা হলেও তো একটা সফলতা।

এই ২ কোটির কত পার্সেন্ট ভালো মানের কিছু করবে বলে আপনার মনে হয়?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : সেটা এভাবে বলা যাবে না। পৃথিবীর সব জায়গায় দেখা যায় ৫ থেকে ৭ ভাগ লোক হচ্ছে সক্রিয়, সৃজনশীল ও ক্ষিপ্র। যারা তাদের চারপাশে একটা ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করতে পারে। পৃথিবীতে এরাই মানবসমাজের মূলকেন্দ্র। বাকিরা ঘোরে এদের উঞ্ছবৃত্তি করে। আমেরিকায় প্রত্যেকের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, আরও অনেক কিছু আছে। তারা নিজেরা কিন্তু এসব করেনি। ওই ৫-৭ ভাগ লোক, যাদের আমরা বলি সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে, তারাই করেছে। তাদের কাজের উচ্ছিষ্ট দিয়েই বাকিদের জৌলুস।

এজন্যই কি সমাজতন্ত্র টেকসই হয়নি?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : সমাজতন্ত্র প্রাকৃতিক নয়। মানুষ সমষ্টির জন্য জীবন দেয়, কিন্তু ব্যক্তিমানুষ তার কাছে আরও বেশি প্রিয়। এ দুইয়ে সমন্বয় দরকার। তার ওপর সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রকাঠামো হয়ে পড়ল কর্তৃত্ববাদী। যদি ওটার নতুন কাঠামো বের করা যেত তবে হয়তো এটা টিকত। পুঁজিবাদ থাকবে। কিন্তু বড়কে অত বড় হতে দেওয়া যাবে না। ছোটকে অত ছোট রাখা যাবে না। এখানেও কাঠামোর একটা নতুন বিন্যাস দরকার। আসলে সম্পদ যদি বেড়ে যায় তাহলে ছোটর ছোট হওয়ার একটা সীমা থাকে। আমেরিকায় ছোট অত ছোট নয়।

আমরা কথা বলছিলাম সক্রিয় লোক নিয়ে...

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : এই যে কোভিড হলো, সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো সচেতনতা নেই। কথা বলছে দুজন, দুজনারই মাস্ক আছে, কিন্তু দুজনারই মাস্ক নাকের নিচে। কিন্তু সবাই তা নয়। দেখা যাবে ৫-৭ শতাংশ ঠিকই সচেতন। তারা ঠিকমতোই মাস্ক পরছে। তাই ৫-৭ শতাংশ লোককেও যদি ঠিকমতো শক্তিমন্ত করে তোলা যায় তা হলেই হয়। আমরা একটা বড় ঝাঁকি জাল ফেলি, তাতে টেংরা-পুটির সঙ্গে দুয়েকটা বড় মাছও ওঠে। যদি বাঘা বাঘা দু-তিনটা মাছ ধরা যায় তাহলে বাকিগুলো ফেলে দিলেও অসুবিধা নেই।

এই ২ কোটি ছেলেমেয়েকে আমরা বড় কিছুর স্পর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছি তাদের শৈশবে-কৈশোরে। যখন তাদের মন স্পর্শকাতর, তারা অনুভূতিশীল, তারা কচি, তারা গ্রহণক্ষমতাসম্পন্ন তখন। যখন তারা স্বপ্নে ভরা, যা দেখে তাই নিয়ে কৌতূহলী। যা দেখে তাই নিয়ে উৎসাহী। উৎসাহ যদি একবার রক্তের ভেতর কল্লোলিত হয়ে ওঠে তবে তার মত্ততা জীবন থেকে আর মরে না। মানুষের শৈশব কিন্তু তার মধ্যে চিরদিনই বেঁচে থাকে। যদি অল্প বয়সে তাদের একবার উৎকর্ষময় বা স্বপ্নময় করে তোলা যায়, তবে তাদের ঝংকার তার মধ্যে চিরদিন থেকে যাবে। একটা সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে আমাদের মধ্যে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে। আমরা ওই সমুদ্রে ঝাঁপ দিই আর না দিই নীল নোনা জলের বিশালতা আমাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন আনে। আমার লক্ষ্য আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সমুদ্রের এই স্পর্শ দেওয়া। হয়তো তার মধ্যে অনেকেই ঝরে যাবে। মহাভারতের কুরু-পাণ্ডবদের যুদ্ধে কত অক্ষৌহিণী যুদ্ধ করেছিল কিন্তু জয়ের পর হস্তিনা নগরে প্রবেশ করেছিল পাণ্ডবদের কজন!

তবু শেষ পর্যন্ত যদি এক শতাংশও থাকে, তবে হয়তো তারা এ সমাজের কিছুটা পরিবর্তন ঘটাবে। কারণ, সবকিছু ঝেড়ে মুছে এই যে এক শতাংশ- এ অন্তহীন সম্ভাবনাময়। এ এক শতাংশ থেকে প্রধানমন্ত্রী হতে পারে, সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী মানুষও হতে পারে। যদি এমন ২০০ লোকও বের হয়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই স্বপ্নের পেছনে আমি আছি। প্রত্যেকেই মহান হবে, আলোকিত হবে তা নয়। চর্যাপদের হরিণীকে যেমন পাওয়া যায় না। তাকে শুধু খোঁজা যায়; আর এ খোঁজাটাই যেমন তাকে পাওয়া। তেমনি আমাদেরও চেষ্টা আলোকিত মানুষ জন্মের জন্য।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ে কি সবাই আলোকিত মানুষ হবে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : সবাই আলোকিত মানুষ হবে না, কিন্তু পৃথিবীর কোনো কাজই তো পুরো ব্যর্থ নয়। ব্রাউনিং লিখেছিলেন-

Fail I alone in words and deeds 

Well each one strives and who succeeds

Look at the end of work, contrast 

The petty done, the undone vast. 

তবে প্রত্যেকেই নিজের থেকে একটু এগোবে। যে পাঁচ ছিল সে সাত হবে। যে সাত ছিল দশ হবে। আবার যে বিশ ছিল সে হয়তো পঁচাত্তর হয়ে যেতে পারে। অঙ্ক দিয়ে এর হিসাব মেলে না। কে অনুপ্রাণিত হবে, কে কতটুকু জ্বলে উঠবে- আমরা এসবের কতটুকু জানি! সে কারণে এটাকে সম্ভাবনার হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। গজ-ফিতা দিয়ে এ মাপা সম্ভব না।

মোবাইল লাইব্রেরিতে সাড়া কেমন?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : মোবাইল লাইব্রেরির অবদান অনেক। এটা হচ্ছে সবচেয়ে ভালো পাঠক তৈরির কার্যক্রম। আমরা স্কুল-কলেজে পাঁচ বছরে ১০০ নির্বাচিত বই পড়াই। কিন্তু মোবাইল লাইব্রেরিতে গাড়ি ভর্তি বই পাঠকের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর ওই বয়সে বইভর্তি এরকম একটা গাড়ি পাওয়া! গাড়ি থেকে আলো আমার আলো গানটা কানে এসে বাজে। চারপাশের ঘরবাড়ি থেকে ছেলেমেয়েরা দৌড়ে আসে। বই নেয়, এভাবে বছরের পর বছর পড়ে। এতে ভালো ছেলেমেয়ের ছোট ছোট সংঘ গড়ে ওঠে, একসঙ্গে তারা অসম্ভবেরর স্বপ্ন দেখে। ওই ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে পড়াশোনা ঋদ্ধ এক ধরনের ছেলেমেয়ে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া যাদের প্রতিভা আছে, তারা যদি এ সুবিধা পায় তাহলে তো কথাই নেই। প্রতিভাবানদের অনেক সময় অত পড়তেও হয় না। তবে আরও বড় ট্যালেন্ট হতে গেলে, রবীন্দ্রনাথ হতে গেলে পড়তে হবে। মাইকেল, বঙ্কিম, রামমোহন হতে গেলে পড়তে হবে। বড় প্রতিভাবানদের এগুলো না পড়ে উপায় নেই।

বর্তমানের তরুণ লেখকদের লেখা পড়েন?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : তরুণদের লেখা কিছু কিছু পড়ি। মাশরুর আরেফিনের আগস্ট আবছায়া পড়লাম। কিছুদিন আগে এটার জন্য সে আইএফআইসি ব্যাংক পুরস্কার পেয়েছে। ওর অনুবাদ করা জার্মান লেখক ফ্রানৎস কাফকার গল্পসমগ্র পড়েছি। খুব ভালো লেগেছে।

অনুবাদটা মূলের কাছাকাছি মনে হয়েছে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : সেটা বলতে পারি না। কারণ, জার্মান জানি না।। তা ছাড়া ও জার্মান থেকে অনুবাদ করেছে কি না তা-ও জানি না। তবে ওর বাংলাটা ভালো। আহমাদ মোস্তাফা কামালও সুন্দর বাংলা লেখে। খুব ঝরঝরে। ওর চাউনি বেশ নতুন। কি গল্পে কি প্রবন্ধে। জাকির তালুকদারের গল্প আমার খুব প্রিয়। বেশ কয়েকজন তরুণ কবিও আশাজাগানিয়া। এখনকার অনেক তরুণই ভালো বাংলা লিখতে পারছে না। হয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা নয়তো ভালোমানের সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগের অভাব, যেকোনো কারণেই হতে পারে।

এখনকার কোনো কোনো লেখক মনে করেন তিনি লেখার ফর্ম ভেঙে নতুন ফর্ম তৈরি করছেন। এ বিষয়ে আপনার মত কী?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : ফর্ম যে ভাঙতে পারেনি, সে তো লেখকই হয়নি। ওটাই তো লেখক জীবনের হাতেখড়ি। তবে ভাঙাচোরা যা-ই হোক লেখার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। ফুটবল খেলতে গেলে উন্মুক্ত জায়গায় খেলা যায় না। সুতরাং চারদিকে দাগ দিয়ে একটা আয়তক্ষেত্র বানিয়ে নিতে হয়। যত কালোয়াতি আর কারুকাজ এ ক্ষেত্রের ভেতরে। পৃথিবীময় তো ছবি আঁকা যায় না, তার জন্য আলাদা করে ইজেল লাগে, একটা ক্যানভাস লাগে, এই যে আটকে দেওয়া হলো চারদিক, এতে ইমাজিনেশনের চূড়ান্ত প্রয়োগের সুযোগ করে দেওয়া হলো। তা না হলে সব প্রতিভা তরল পদার্থের মতো ছড়িয়ে যাবে। ভাষাও তাই। নদীর যেমন দুটো পাড় থাকে এ-ও তেমনি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বিলের পানিকে গ্রামের কেউ মূল্য দেয় না। বলে বোবাজল। কিন্তু নদীর পানিকে মূল্য দেয়, কারণ ওর পাড় আছে বলে ওর স্রোত আছে, স্রোত আছে বলে ওর প্রাণপ্রবাহ আছে। প্রাণপ্রবাহ আছে বলে ওর উচ্ছিত ঝংকার আছে, এবং তার একটা অর্থ হয়। লিখতে গেলে ফর্ম ভাঙতেই হবে। না হলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল বা জীবনানন্দের পার্থক্য হবে কী করে! না হলে সাহিত্য তো স্থাণুর মতো একখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। যেখানে চারপাশের সমাজ আর পৃথিবীর মধ্যে অহর্নিশ ভাঙচুর চলছে সেখানে কি সাহিত্য একঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?

পশ্চিমবঙ্গে কি সাহিত্যের মান পড়ে যাচ্ছে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : পশ্চিমবঙ্গ এখন পেরিফেরিতে চলে গেছে, প্রান্তিক একটা প্রদেশ। যেমনটা পাকিস্তান আমলে ছিলাম আমরা। ভারতে ব্যাপারটা আরও প্রচণ্ড। এত বিশাল দেশ, সেখানে এক প্রান্তে কে কী করছে কে তার খোঁজ রাখে। সেখানে জীবনের গতি নেই, মানুষের স্বপ্ন নেই, একদম প্রায় আকরিক জীবন। বড় শক্তি, বড় আন্দোলন কিছুই নেই। তবু দীর্ঘদিনের বৈভব আর অস্তিত্বের কারণে কলকাতার চোখে আজও একটা স্বপ্ন বেঁচে আছে, সৃজনশীলতায় কলকাতা আজও কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই। কিন্তু উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর তুলনায় আজকের কলকাতা কোথায়? এদিকে বাংলাদেশ একটা রাষ্ট্র। এখানে কত উত্থান হবে, পতন হবে, কত রাজদ্রোহ হবে, কত দমন কত বিজয়স্তম্ভ হবে। কত মহানুভব মানুষ আসবে একদিন এখানে। ন্যায়ের জন্য কত মানুষ আত্মোৎসর্গ করবে। না, এ মুহূর্তে এসব হবে না। এখনই হবে না, একেবারে প্রথম অবস্থা তো, এখন আমাদের ছলেবলে কৌশলে দুই পকেট ভরার সময়। এখন আমরা বিশ্ববাণিজ্যায়নের দিকে এগোচ্ছি। পৃথিবীজুড়ে আজকে বিত্তসম্পদের জোয়ার এসেছে। তবে আজকের বিশ্ববাণিজ্যায়নের এ উন্মাদনা একশ বছরের বেশি টিকবে বলে মনে হয় না। হয়তো একটা সময় আসবে যখন আজ যারা বিত্ত সঞ্চয় করছে, তাদের উত্তরপুরুষরা এ টাকা জনগণকে ফিরিয়ে দেবে। টাকার জন্য আজকের যে ক্রেজ তা হয়তো তখন থাকবে না। এ ব্যাপারে একটা গান আছে- মানি মানি মানি মাস্ট বি ফানি ইন এ রিচম্যানস ওয়ার্ল্ড। টাকা বেশি হলে টাকা হাস্যকর হয়ে যায়। সামনের পৃথিবীতে এমন একটা ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে বলে আমার আশঙ্কা হয়।

এ মুহূর্তে সব মূল্যবোধ পিষ্ট হয়ে একেবারে বিনষ্ট হয়ে আছে, একমাত্র কাঙ্ক্ষিত এখন অর্থ। তবু এ অবস্থাটা এরকম থাকবে না। অর্থ আরও একটু বাড়লে দেখা যাবে নতুন কালের গৌতম বুদ্ধরা রাজপ্রাসাদ থেকে নেমে আসবে। এ সর্বস্বত্যাগীদের জন্মের জন্য রাজপ্রসাদ লাগে। রাজপ্রাসাদ ধ্বংস করার জন্যও রাজপ্রাসাদ লাগে।

সুতরাং আমরা হতাশ না হয়ে অপেক্ষায় থাকি?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : শুধু এ অপেক্ষায় নয়, সক্রিয়ও থাকতে হবে। সংস্কৃতে একটা প্রবাদ আছে- চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখাংনিচ দুখানিচ। সুখ দুঃখ চাকার মতো ঘুরছে। কখনও সুখ ওপরে, কখনও দুঃখ ওপরে থাকে। আমাদের এখন দুঃখ ওপরে উঠে গেছে। তবু চাকা কিন্তু ঘুরছে। এখন আমি যদি শুধু তাকিয়ে ওই ঘোরাটাই দেখতে থাকি তাহলে তো ওর ঘোরাটা জোরাল হবে না। যদি আমরা দুই হাতের ধাক্কায় চাকাটাকে আরও জোরে ঘুরিয়ে দিতে পারি তাহলে সুখের দিন অনেক আগে পাব।

এককথায় আপনি আপনার কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে পছন্দ করেন?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : আমার পরিচয় নিয়ে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন। কেউ ভাবেন আমি মাস্টার, কেউ ভাবেন সাহিত্য আন্দোলন নিয়ে কাজ করা লোক, কেউ ভাবেন টিভির লোক, কেউ ভাবেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র করি। কেউ দেখেন পরিবেশ আন্দোলনকারী হিসেবে, কেউ জানেন আমি বক্তৃতা করে বেড়াই। একটা মানুষ এতখানি বহুরূপী হলে লোকে কিছুটা বিভ্রান্ত হবেই। যার কাছে যে চেহারাটা সামনে আসে সেটাকেই সে ধরে নেয়। যার চোখে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পড়ে সে ভাবে আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লোক। যে ছাত্র পড়াতে দেখে সে ভাবে শিক্ষক। এই তো। তবে এসবের সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায় প্রতিটি ব্যাপারই কিছুটা মূল্যহীন হয়ে গেছে বলে আমার ধারণা।

আপনি কি নিয়তিতাড়িত মানুষ?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : আমি মনে করি নিয়তি আছে এবং নিয়তি নেই। ধরুন, আপনি একজন নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ। এ অবস্থায় একটা ১০ টাকার লটারিতে ১০ কোটি টাকা পেয়ে গেলেন, আপনি বলবেন, এটা আপনার ভাগ্য। কিন্তু যার হাজার কোটি টাকা আছে, সে এটাকে কি এত গুরুত্ব দেবে? কাজেই কোনটা ভাগ্য আর কোনটা ভাগ্য নয় তা নির্ভর করে মানুষের অবস্থানের ওপর। আমাদের জীবনটা অ্যাক্সিডেন্টাল। আমি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ডান পা আগে ফেলেছি, হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে গাড়ির নিচে চাপা পড়লাম। কিন্তু বাঁ পা আগে ফেললে হয়তো একটা গাড়ির মালিক হয়ে যেতাম। জীবন অ্যাক্সিডেন্টাল তবু তার মধ্যেও একটা প্রচ্ছন্ন নিয়ম আছে।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য কি আপনি লেখকসত্তাকে বিসর্জন দিয়েছেন?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : আমার বাবা সাহিত্যের লোক। আমার পরিবারে সাহিত্য। ছোটবেলা থেকে সাহিত্যের মধ্যে বড় হয়েছি। আমার মনটাও সাহিত্যমুখী। সুতরাং লেখক হওয়াই আমার পক্ষে ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু একসময় আমার ভেতরে দ্বন্দ্ব শুরু হলো- আমি বড় না আমরা বড়? যেদিন এ দ্বন্দ্ব শুরু হলো সেদিন আমার মনে হলো আমিই শুধু লেখক হব? তাহলে আমি স্বার্থপর হয়ে গেলাম না! আমি কি একাই পড়ব, একাই আলোকিত হব? সব মানুষকে আলোকিত হতে হবে না? এমনি করে ‘আমি’ ছেড়ে ‘আমরা’র দিকে যাত্রা হলো।

তাহলে এ দ্বন্দ্বই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বীজমন্ত্র?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : এ দ্বন্দ্বে পড়ে আমার লেখকসত্তা দ্বিতীয় হয়ে গেল। এতদিনে আমি মাত্র ৪০টি বই লিখতে পেরেছি। তবে এটা নিয়তিতাড়িত হয়ে নয়, সজ্ঞানে। আমার জন্মগত প্রবৃত্তির তাড়না আমাকে ও পথে হাঁটতে বাধ্য করেছে। তবে ‘আমি’র দিকেও আমি হাঁটতে পারতাম। কারণ দুই দিকেই আমার সমান প্রবণতা ছিল। কিন্তু সামনে তখন নতুন দেশ। একটা বড় জাতি নির্মাণ করার পর্ব। তাই ‘আমরা’র কাছে ‘আমি’ হেরে গেল।

আপনি সব সময় বলেছেন নতুন বাংলাদেশ গড়তে লাখ লাখ নির্মাতা প্রয়োজন। তারা কি তৈরি হয়েছে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : তৈরি কখন কীভাবে হয় তা কী করে বলব! তৈরি হতেও পারে, না-ও পারে। কিন্তু যদি হয়ও কীভাবে, কোন দৈবস্পর্শে কে বলতে পারে, তার জবাব কে দিতে পারে? রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে- এক খ্যাপা পরশপাথর খুঁজে বেড়াচ্ছিল। পরশপাথর সেই পাথর যার স্পর্শে লোহা সোনা হয়ে যায়। সমুদ্রপাড়ে দিনের পর দিন পাগলের মতো খোঁজার পর একদিন সে আবিষ্কার করল তার হাতের বালাটা সোনা হয়ে আছে। সে বুঝল পরশপাথর খোঁজার কোনো একসময় সে এর স্পর্শ পেয়ে গিয়েছিল কিন্তু সে তাকে চিনতে পারেনি। আমরাই কি এই পরশপাথরদের সব সময় চিনতে পারি?

বাংলাদেশ কি উন্নতির দিকে এগোচ্ছে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : বাংলাদেশ বস্তুগত উন্নতির দিকে যাচ্ছে। কিন্তু নৈতিক দিকে অগ্রসর হয়নি। বরং পিছিয়েছে। এ ঢাকা শহরে একদিন বাঘ ছিল, চিতাবাঘ ছিল বিস্তর। আমার স্কুলজীবনেই বিজয় সরণির ওদিকে গেলে গা ছমছম করত। এ শহরে এখন সারা দেশের সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়েছে। ১০ বছর পরে এখানে যানজটের বেশ উন্নতি হবে। ফুটপাত দখল কমবে। গণপরিবহনে রাস্তা ভরে উঠবে। ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকার চেহারা অনেকটাই বদলে যাবে। দৃষ্টিনন্দন হবে কিন্তু ব্যাপারটা হলো যে, টাকা থাকলে আমরা প্রাসাদ বানাতে পারি, কিন্তু প্রাসাদে থাকার জন্য রাজহৃদয় দরকার, সেই রাজহৃদয় এক দিনে কোথায় পাব? আমাদের প্রাসাদ হচ্ছে, কিন্তু রাজহৃদয় যে দূর অস্ত। তবে তা-ও হবে। আমি আশাবাদী মানুষ।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা