বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩ ২১:০৩ পিএম
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৩ ২২:৩৫ পিএম
ড. সাইদুল ইসলাম। সংগৃহীত ছবি
প্রথমবারের মতো মানুষের শ্বাসনালীতে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত করেছেন অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) সাবেক শিক্ষার্থী ড. সাইদুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা।
সম্প্রতি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স পাবলিকেশনের ফিজিক্স অব ফ্লুইডস জার্নালে তাদের গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনির মেকানিক্যাল অ্যান্ড মেকাট্রনিক্সের প্রভাষক ড. সাইদুল ইসলামের নেতৃত্বে গবেষকরা মানুষের শ্বাসনালীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবহন এবং জমা বিশ্লেষণ করে একটি কম্পিউটেশনাল ফ্লুইড ডাইনামিক মডেল তৈরি করেন।
গবেষণাটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ফিজিক্স অর্গ, এআইপি নিউজ, মাইক্রোসফট নিউজ এবং সাইন্স ডেইলির মতো প্রায় দুই শতাধিক আন্তর্জাতিক মিডিয়া এ জার্নালটি নিউজ, প্রবন্ধ হিসেবে কাভার করেছে।
গবেষণাটি বলছে, মানুষ প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৬.২ বিট সমপরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারে। এই মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো মানুষের দেহে আসে মনুষ্য সৃষ্ট প্লাস্টিক পণ্যগুলোর ক্ষুদ্র ধ্বংসাবশেষ থেকে। এছাড়া মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো কতটা গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিকগুলো কীভাবে শ্বাসযন্ত্রে কী পরিমাণ ক্ষতি করে তা এই গবেষণাটির মূল বিষয়।
গবেষক দলের অন্য বিজ্ঞানীরা হলেন- ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির মো. মিজানুর রহমান, কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির এমিলি সাউরেট এবং ইয়ান টং গু, ইরানের উর্মিয়া ইউনিভার্সিটির আকবর আরসালানলু, ইসলামিক আজাদ ইউনিভার্সিটির হামিদরেজা মুর্তজাভী বেনী এবং দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার শরিফুল ইসলাম।
মানুষের শরীরে কীভাবে দূষিত কণা পরিবহন করে এবং তার প্রভাব কী এটা নিয়ে সাইদুল গবেষণা শুরু করেন ২০১৪ সালে। এটা মূলত তার পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল। এছাড়া তিনি ২০২২ সালে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
ড. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপাদন বাড়ছে এবং বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথমবারের মতো ২০২২ সালে গবেষণায় মানুষের শ্বাসনালীর গভীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যা আমাদের শ্বাসনালীর স্বাস্থ্যঝুঁকি গুরুতরভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।’
গবেষক দলটি বিভিন্ন আকৃতির এবং আকারের (১.৬, ২.৫৬ এবং ৫.৫৬ মাইক্রন) মাইক্রোপ্লাস্টিক ধীর এবং দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে কীভাবে ফুসফুসে পরিবহন করে তার গতিবিধি লক্ষ্য করেছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের শরীরে কীভাবে ক্ষতি করে এমন প্রশ্নের জবাবে সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে নানাভাবে ক্ষতি করতে পারে এবং এটা নির্ভর করবে আমরা কীভাবে এটা আমাদের শরীরে গ্রহণ করছি তার উপর। নিঃশ্বাসের মাধ্যমে যখন মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে প্রবেশ করে তখন এটা ফুসফুসের টিস্যুগুলোতে ঝালা ও প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ফুসফুসের টিস্যুকে ক্ষতি করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে শরীরে থাকার কারণে এটি অ্যাজমা, সিওপিডি, ফুসফুস ক্যান্সারসহ ফুসফুসে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে পারে।’
সাইদুল জানান, আমরা যে বাতাসে শ্বাস নিই, যে খাবার খাই এবং যে পানি পান করি এর মাধ্যমে আমাদের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করে। এই কণাগুলো আমাদের আহার, নিঃশ্বাস এমনকি ত্বকের শোষণের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন ধরনের সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। এগুলো ক্ষতিকারক রাসায়নিক নির্গত করতে পারে, প্যাথোজেনের বাহক হিসাবে কাজ করতে পারে এবং টিস্যুতে প্রদাহ এবং অক্সিডেটিভ চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এগুলো মানবদেহে প্রবেশ করে সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য প্রভাব যেমন প্রজনন সমস্যা, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ব্যাঘাত, শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং শরীরে বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতির দিকে ধাবিত করে।
গবেষণার বিষয়ে তিনি আরও জানান, আমরা এখন একটা পরীক্ষা করার জন্য করেছি। আমাদের বর্তমান মডেলে সিটি স্ক্যান থেকে জ্যামিতি তৈরি করে তারপর মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবাহ বিশ্লেষণ করেছি। এখন আমরা এটার পরীক্ষামূলক মডেল তৈরি করতে চাচ্ছি। একইসঙ্গে পুরোপুরি শ্বাসনালী ব্যবস্থা নিয়ে আমরা এই কাজটা করব।
তিনি জানান, বড় আকৃতির মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো অধিকাংশ আমাদের নাকের ভেতরে যে চুল আছে সেখানে আটকে যায়। ছোট মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো আকার এবং আকৃতির উপর ভিত্তি করে ফুসফুসের নিচের অংশে প্রবেশ করে। মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো ফুসফুসের ভেতরে বাতাসের গতি ও নানা শারীরবৃত্তিও কারণে ফুসফুসের আঠালো মিউকাস অংশে জমা হয়।
কিছু মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা প্রশ্বাসের মাধ্যমে বের হয়ে আসতে পারে। ফুসফুসের আঠালো মিউকাস অংশে জমা হওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বিষাক্ত হতে পারে এবং অবশেষে ক্যানসারসহও নানান ধরনের ফুসফুসের রোগ ঘটাতে পারে। অতি ক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো ফুসফুসের আল্ভেওলি থেকে অন্যান্য লেয়ার অতিক্রম করে শরীরের রক্তের মধ্যেও প্রবেশ করতে পারে।
গবেষক দল উল্লেখ করেন, মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো তাদের স্থির প্রকৃতি, ফুসফুসে জমা হওয়ার ক্ষমতা এবং বন্যপ্রাণীর ক্ষতি করার এবং পরিবেশগত ভারসাম্যকে ব্যহত করার সম্ভাবনার কারণে একটি গুরুতর হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
এই গবেষণায় আমরা যে বাতাসে শ্বাস নিই সেখানে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি এবং সম্ভাব্য স্বাস্থ্যগত প্রভাব সম্পর্কে বৃহত্তর সচেতনতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিতে বলেছেন গবেষক দল। ভবিষ্যতে, এ গবেষক দল একটি বড় আকারে আমাদের পুরো শ্বাসনালীর মডেলে মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবহন বিশ্লেষণ করার পরিকল্পনা করেছেন যা পৃথিবীতে বাতাসের আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রার মতো পরিবেশগত বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে।
ড. সাইদুল ইসলাম সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ থানার নলতা ইউনিয়নের সেহারা গ্রামের সন্তান। তিনি বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত ঘেঁষা খানজিয়া হাই-স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি ও নলতা আহছানিয়া মিশন রেসিডেন্সিয়াল কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। পরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ডিসিপ্লিন থেকে ২০০৯ সালে স্নাতক ও ২০১২ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। ২০১৪ সালে পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনির মেকানিক্যাল অ্যান্ড মেকাট্রনিক্সের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।