ফারুক আহমাদ আরিফ, ফারহানা বহ্নি, সাজ্জাদুল ইসলাম
প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৩ ১০:০৬ এএম
আপডেট : ০৩ জুন ২০২৩ ১৪:২১ পিএম
ফাইল ফটো
জাতীয় বাজেটকে দেশের অর্থনৈতিক দলিল হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। তবে এই দলিলের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম। আশাবাদী হওয়ার চেয়ে তাদের মধ্যে নিরাশার মেঘ ঘুরে বেড়ায়। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বাজেট নিয়ে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয় প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদকদের। এই মানুষদের অনেকেই বাজেটের খবর টেলিভিশনে দেখেছেন। পত্রিকায় পড়েছেন। আবার কেউ কেউ শুধুই লোকমুখে শুনেছেন। তবে তাদের অধিকাংশই বাজেট পড়েননি বা শোনার আগ্রহ দেখাননি। দুপুর আড়াইটায় কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে মোটরসাইকেলে বসে ছিলেন শরিফুল হাসান ও মনিহার রহমান। তারা মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। দুজনই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করেছেন। বেশ কয়েক বছর চাকরির পেছনে ঘুরে অবশেষে এ পেশা বেছে নিয়েছেন।
শরিফুল হাসান বলেন, ‘বাজেটে আমাদের কথা নেই। আমাদের হাসি-দুঃখের কথা নেই। কেন বাজেট নিয়ে চিন্তা করব? এক মাস আগে মোবিল কিনতাম সাড়ে ৬০০ টাকায়। গতকাল সেটি কিনতে হয়েছে ১ হাজার টাকায়। সামনের ব্রেকটি কিনেছি ২ হাজার ৬০০ টাকায়। দাম ছিল ১ হাজার ৭০০ টাকা। আমি সেই অনুযায়ী টাকা জমিয়ে যখন কিনতে গেছি তখন দেখি দাম ২ হাজার ৬০০ টাকা।’
তেলের আগুনে জ্বলছি উল্লেখ করে মনিহার রহমান বলেন, ‘তেলে সবকিছু হলেও আমাদের জীবন চলে না। এখন ১৪০ টাকা লিটার পেট্রোল কিনতে হয়। মোবিল আছে, আনুষঙ্গিক খরচ আছে। দৈনিক ১ হাজার টাকা রোজগার করতে পারলে তিন-চার শ টাকা থাকে।’
মহাখালীর আমতলীতে টেইলার্সের ব্যবসা করেন মুকুল হায়দার। তিনি এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। বাড়ি কুমিল্লায়। বিকাল ৫টায় তাকে বাজেট সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমরা বাজেট দিয়ে কী করব? ঘরের বাইরে বের হলেই টাকা উধাও। সবকিছুর দাম বেশি। বাজার করতে গিয়ে যখন পকেট ফাঁকা হয়ে যায় তখন নিজের সততা ধরে রাখা কঠিন। মানুষের শরীরের মাপ নিয়ে কাপড় তৈরি করি কিন্তু সংসারের মাপ ধরে রাখতে পারি না। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় বাজারদরের কাছে।’
বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে কথা হয় মোয়াজ্জেম হোসেনের (৬৫) সঙ্গে। সরকারি চাকরি করতেন। অবসর জীবনযাপন করছেন এখন। কাকলি থেকে কুড়িল বিশ্বরোড আসার পথে বাসে তার সঙ্গে কথা হয়। বাজেট নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? কীভাবে মূল্যায়ন করবেন প্রস্তাবিত বাজেটকে? মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘বাজেট পড়িনি। দেখিওনি। বাজেটে সত্য-মিথ্যার তথ্য ভরপুর থাকে।’ কীভাবে? প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘যখন আপনি নিজ থেকে মিথ্যা বলেন সেটি অন্যায়, কিন্তু যখন মিথ্যা তথ্য দিতে বাধ্য করেন তখন তো কিছু করার নেই। বাজেটের তথ্য নিয়ে আমি সন্দিহান। জাতি হিসেবে সত্যের ওপর দাঁড়াতে পারছি না। যে বাজেট প্রতিবছর ঘোষিত হয়, তা যদি সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন হতো তবে ঘাটতি থাকত না। কর্মসংস্থানের অভাব থাকত না।’
বাসের মধ্যেই কথা হয় জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক যুবকের সঙ্গে। তিনি উত্তরার বাসিন্দা বলে জানান। এই বাজেটকে তিনি রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে মূল্যায়ন করেন। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘২০১৮-১৯ সালের বাজেটের চেয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক ১ হাজার কোটি টাকা বেশি রাখা হয়েছে। যুবকদের কর্মসংস্থানের বিষয় নিয়ে ততটা গুরুত্ব নেই। বাজেট নিয়ে যতটা আগ্রহ মানুষের মধ্যে থাকার কথা সেটি দুদিন যাবৎ দেখছি না।’
ছাইদুল হক (৫৫) নামের একজন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয় কুড়িল ব্রিজের নিচে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার বাসিন্দা তিনি। ঢাকায় এসেছেন অল্প কিছুদিন হলো। গ্রামে গৃহস্থালির কাজ করলেও এখন ঢাকায় এসে রিকশা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘বড় বাজেট হলেও আমাদের কোনো লাভ নেই। কাজ করেই খেতে হবে। বাজেটের টাকা বড়লোকদের পকেটেই যাবে।’
যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে কথা হয় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মীমের সঙ্গে। প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘ভাই বাজেট নিয়ে কোনো সংবাদ পড়িনি। টেলিভিশনেও দেখিনি। এটি নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। শুধু আমার না। বাজেটের আগেও বান্ধবীদের আড্ডায় কোনো কথা হয়নি।’ কেন এমন অনীহা—প্রশ্ন করলে তিনি হেসে বলেন, ‘কী হবে আমাদের বাজেট দিয়ে?’
মিরপুরের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী জুবায়ের আহমেদ। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বাজেট সম্পর্কে বলেন, ‘প্রতিবছর বাজেট ঘোষণা হয়। বাজেট কতটা বাস্তবায়ন হয় তার খোঁজ রাখা হয় না। তবে এবারের বাজেটে আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য তেমন কোনো সুখবর শুনি নাই। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাব, সব সময় যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে। আর বাজারে গেলে আপনি বুঝতে পারবেন অর্থমন্ত্রী কাদের জন্য বাজেট করেছেন।’ বাজেটে নতুন কর আরোপ বিষয়ে জুবায়ের বলেন, ‘এবার তো সরকার দেখছি বিয়ের ওপর কর নির্ধারণ করেছে। আমি মনে করি এতে আমাদের দেশের মানুষ বিয়ের ব্যাপারে অনাগ্রহী হতে পারে।’
বাড্ডায় বসবাস করেন বেসরকারি চাকরিজীবী রাশেদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাজেট নিয়ে কোনো চিন্তা নেই আমার। দেখলাম সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। কিন্তু আমরা যারা বেসরকারি চাকরি করি, তাদের জন্য কখনও তেমন কোনো সুখবর শুনি নাই। এমনকি এবার দেখলাম টিন নাম্বার থাকলেই ২ হাজার টাকা কর ধার্য করা হয়েছে। এবারের বাজেট আমার কাছে গণমুখী ঠিক মনে হয়নি।’
রামপুরার মুদি দোকানি শাহ আলমের কাছে বাজেট নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখেন ভাই, আমরা গরিব মানুষ। আমাদের বাজেট বুঝে কোনো লাভ নেই। আমাদের কথা সরকারের কাছে পৌঁছায় না।’ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তিনি কাদের জন্য বাজেট করেছেন সেটা বাজেট পাস হলেই বোঝা যাবে-- গরিবের জন্য নাকি বড়লোকদের জন্য। তবে ভাই জিনিসপত্রের দাম হু-হু করে বাড়ছে। আমাদের আয় বাড়ছে না। সরকারের উচিত সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা।’
মহাখালীতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন হাসনা বানু। তার সঙ্গে বাজেট নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, ‘বাবা আমি তো এই সব বুঝি না। আমার কাজ করে খেতে হবে। সরকার থাকলেও কাজ করতে হবে, না থাকলেও করতে হবে। আমাদের মতো গরিবের জন্য যেন সরকার আরও বেশি সুযোগ দেয় তা-ই চাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রোহান ইসলাম বাজেট মতামতে বলেন, “সরকার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। পাশাপাশি তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে শতকোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। এগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন হলে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে বলে মনে করি। পাশাপাশি শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে যে টাকা বরাদ্দ করার প্রস্তাব করা হয়েছে, তার সঠিক বাস্তবায়ন সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে দুর্নীতির ব্যাপারে সর্বোচ্চ কঠোর হতে হবে। তাহলে সরকার ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা সম্ভব।”