প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৩ ১৭:১১ পিএম
আপডেট : ২৩ মে ২০২৩ ১৭:৫২ পিএম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয়ের আবদুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে ‘বাংলাদেশ জেনোসাইড ১৯৭১’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। প্রবা ফটো
একাত্তরে নিরীহ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞকে জেনোসাইড বা গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে দেশের বাইরে জনমত তৈরি করে জাতিসংঘের কাছে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য একটি পরিকল্পিত রূপরেখা তৈরির তাগিদ দিয়েছেন দেশি-বিদেশি গবেষক ও বিশিষ্টজনরা।
তারা বলেছেন, গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য পরিকল্পিতভাবে এগুলোর কোনো বিকল্প নেই। একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের লড়াই মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব। কোনো গণহত্যার স্বীকৃতি না দিলে সেটির পুনরাবৃত্তি হয়। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। এই ন্যাক্কারজনক গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হবে।
সোমবার (২২ মে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয়ের আবদুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে ‘বাংলাদেশ জেনোসাইড ১৯৭১’ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ দাবি তুলে ধরেন বক্তারা। আমরা একাত্তর, ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম (ইবিএফ) এবং প্রজন্ম’৭১ যৌথভাবে আয়োজন করে সম্মেলনটি। এর উদ্দেশ্য ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলা।
সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সাবেক ডাচ এমপি ও মানবাধিকার কর্মী হ্যারি ভ্যান বোমেল, অ্যামস্টারডামের ভ্রিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক ড. এ্যানথনি হলসল্যাগ, যুক্তরাজ্যের সিনিয়র সাংবাদিক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন, পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত সুইডিশ বিচারক সৈয়দ আসিফ শাহকার, ১৯৭১: গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, জেনোসাইড গবেষক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতিক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, একুশে টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আমরা একাত্তরের প্রধান সমন্বয়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা হিলাল ফয়েজী, আমরা একাত্তরের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃণাল সরকার, ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরামের (ইবিএফ) যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি আনসার আহমেদ উল্লাহ, ইবিএফ নেদারল্যান্ডস শাখার সভাপতি বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, শহীদ সন্তান ও জেনোসাইড গবেষক প্রদীপ কুমার দত্ত এবং তৌহিদ রেজা নূর। এ ছাড়া দেশ-বিদেশে অবস্থানরত জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, শহীদ সন্তান ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
বক্তারা বলেন, রুয়ান্ডা, বসনিয়া, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, আফগানিস্থান- তালিকা করলে আরও দীর্ঘ হবে। একেকটি গণহত্যা হয়, একে অস্বীকার করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয় না। ক্ষতিপূরণ তো বহুদূরের বিষয়। এতে করে আবারও বিশ্বের কোথাও না কোথাও ঘাপটি মেরে থাকা নরপশুরা চালায় গণহত্যা। একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি এনে পাকিস্তানকে জবাবদিহির আওতায় আনা বাংলাদেশের সামনে বড় একটি সুযোগ আছে। একাত্তরে ঘাতকদের বিচারের তথ্য-উপাত্ত, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের দলিল-পত্র, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, বধ্যভূমির আলামতসহ বহু উপকরণ এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে। প্রয়োজন শুধু সুষ্ঠু গবেষণা আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ফেরানো।
সেমিনারে দাবি ওঠে- শুধু দু:খ প্রকাশ যথেষ্ঠ নয়। বিচার হতে হবে, ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছেই নয়, বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্থানের ক্ষমা চাইতে হবে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, এই যুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যর্থ হলে পাকিস্তান জয়ী হয়ে যায়। অপরাধীরা মাথা উঁচু করে থাকে। তাই এই রাজনীতি থামাতে হবে। জেনোসাইড (গণহত্যা) স্বীকৃতি না পেলে সেটির পুনরাবৃত্তি হয়। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন-আমরা আজকে সেটা দেখতে পাচ্ছি মিয়ানমার ও মধ্যপ্রাচ্যে।
সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গণহত্যার মূলকেন্দ্র। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের নৃশংস গণহত্যার নজির নেই। দেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা এই গণহত্যায় সহযোগিতা করেছিল।
নেদারল্যান্ডসের সাবেক সংসদ সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী হ্যারি ভ্যান বোমেল বলেন, স্বাধীনতার ৫১ বছরেও ১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চালানো জেনোসাইডের স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশ। এর অন্যতম কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় চলমান স্নায়ুযুদ্ধ এবং পাকিস্তানের ওপর তখনকার বৈশ্বিক সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন।
আমস্টারডামের ভ্রিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ্যানথনি হলসল্যাগ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশে জেনোসাইডের বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ এখনো চলমান। এটি শেষ হলে স্বীকৃতি আদায়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
যুক্তরাজ্যের সিনিয়র সাংবাদিক জেনোসাইড গবেষক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন বলেন, এই সম্মেলন ও ভ্রমণের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশে কী ঘটেছিল, তা আরও ভালোভাবে জানতে চাই। আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার ফলে এক ধাপ এগোনো গেছে। এখন পরবর্তী ধাপ পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। গণহত্যা নিয়ে যা জেনেছি ও শুনেছি তা নিজ দেশে ফিরে গিয়েও জানাব।
সম্মেলনে সাবেক ডাচ এমপি ও মানবাধিকারকর্মী হ্যারি ভ্যান বোমেল হ্যারি ভ্যান বোমেল বলেন, গণহত্যা ইতিহাসের অংশ। গণত্যার স্বীকৃতি আদায় করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমাদের অবশ্যই এর স্বীকৃতির জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।