× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পার পাচ্ছেন পরিবহন মালিকরা

হিরা তালুকদার

প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৩ ০৮:৪৫ এএম

আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৩ ০৮:৪৯ এএম

পার পাচ্ছেন পরিবহন মালিকরা

সড়ক দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু যদি হত্যাকাণ্ড বলে প্রমাণিত হয়, তবে সাজা মৃত্যুদণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের দায় শুধু যে চালকেরই হবে তা নয়; দায় গাড়ির মালিকেরও। কোনো কোম্পানি এই ধরনের অপরাধ করলে ওই কোম্পানির মালিক, পরিচালক, নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপক, সচিব বা অন্য কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে সবার জন্যই সাজার বিধান এক। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮তে এমনটাই বলা হয়েছে। 

দেশে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এর মধ্যে যেসব ঘটনা আদালতে গড়াচ্ছে, বিচারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধ প্রমাণিত হলে সাজা পাচ্ছেন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালক ও হেলপাররা। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের মালিকপক্ষ থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ থাকার পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন পরিবহন মালিকরা। 

আইনে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মালিকদের দায় রাখা হয়েছে, বিভিন্ন মামলার বিচারের সময় বা রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারকরাও মালিকদের দায় থাকার বিষয়টি উল্লেখ করছেন। এরপরও পার পেয়ে যাচ্ছেন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের মালিকরা। 

আইনজ্ঞদের মতে, দুর্ঘটনা রোধে আইনে কী কী বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার পর কার দায় কতটুকু- এসব সবার আগে দেখভালের দায়িত্ব পরিবহন মালিকদের। কিন্তু অধিকাংশ পরিবহন মালিক আইনের এসব ধারা জানেন না বা তোয়াক্কা করেন না। চালক ও হেলপার নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনের তোয়াক্কা না করা এবং আদালতের ক্ষতিপূরণের আদেশ না মানার প্রবণতা পরিবহন মালিকদের ক্ষেত্রে প্রকট হয়ে উঠেছে। দুর্ঘটনার পর তাদের অনেকেই নিজেকে যেমন অন্তরালে রাখার চেষ্টা করেন, তেমনি ফিটনেসহীন যানবাহন ও বেপরোয়া বা অদক্ষ চালককে দিয়ে বারবার কাজ চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার জন্য লড়াই চালান সর্বোচ্চ। 

বাস্তবতা হলো- নতুন সড়ক পরিবহন আইন, দণ্ডবিধি কিংবা রিট যেভাবেই মামলা হোক না কেন, মালিকপক্ষ বিচারের আওতায় আসছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তারা দায়ী। তবে মামলা দায়ের থেকে শুরু করে নিষ্পত্তি পর্যন্ত দীর্ঘসূত্রতা এবং সাক্ষ্যগ্রহণে জটিলতায় পরিবহন মালিকরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরকম উদাহরণও আছে প্রচুর।

মালিকদের দায় দিয়েছে আদালতও

‘দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে গাড়ির মালিকরা গাড়ির চালকদের মতোই অপরাধী!’ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ নিহত হওয়ার মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত এ কথা বলেছিলেন। মামলাটি সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য মানদণ্ড হিসেবে কাজ করতে পারে বলেও উল্লেখ করেছিলেন বিচারক। 

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর। এই ঘটনায় করা মামলায় অভিযুক্ত ড্রাইভারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও কোনো দণ্ড হয়নি মালিকের। জরিমানার মামলাটিও এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন আছে।

২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর শ্যামলী এন আর পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুভংকর ঘোষ রাকেশকে উদ্দেশ করে হাইকোর্ট বলেন, ‘আপনার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে হতাহতের ঘটনা ঘটাল। অথচ আহতদের একটি বারের জন্যও দেখতে গেলেন না, নিলেন না খোঁজখবরও। আপনারা আছেন শুধু টাকা কামানো নিয়ে। আসলে আপনারা মানুষের পর্যায়ে পড়েন না। আপনাদের মানবিকতা নেই। মানবিকতা অর্জন করুন। পরিবহন মালিক নয়, চেষ্টা করুন মানুষ হওয়ার।’

দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৫ ব্যক্তির প্রাণহানি হচ্ছে। আর বাংলাদেশ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১২ হাজার মানুষ নিহত ও ৩৫ হাজার আহত হয়। 

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলন গত জানুয়ারিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে সড়ক, নৌ ও রেলপথে ৭ হাজার ২৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর আগের বছর ২০২১ সালে ঘটেছিল ৪ হাজার ৯৮৩টি। অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ২ হাজার ৪১টি। 

বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২২ সালে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৯ হাজার ৯৫১ জন। সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির এই সংখ্যা গেল আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১২ হাজার ৩৫৬ জন। 

আইনে কী আছে

সড়ক পরিবহন ও সড়ক দুর্ঘটনাসংক্রান্ত একটিই আইন আছে, যা ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ নামে পরিচিত।

চালকের যোগ্যতা : সংশোধিত সড়ক পরিবহন আইনে বলা আছে, গাড়ি চালানোর জন্য বয়স অন্তত ১৮ বছর হতে হবে। চালকের সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে পরোয়ানা ছাড়াই চালককে গ্রেপ্তারও করা যাবে। 

মালিকপক্ষের দায় : এই আইনের ধারা ১০৬ (১)-এ মালিকপক্ষ সম্পর্কে বলা আছে, ‘কোনো কোম্পানি কর্তৃক এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হইলে, উক্ত অপরাধের সহিত প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রহিয়াছে উক্ত কোম্পানির এইরূপ মালিক, পরিচালক, নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপক, সচিব, অন্য যেকোনো কর্মকর্তা উক্ত অপরাধ সংঘটন করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন, যদি না তিনি প্রমাণ করিতে পারেন যে উক্ত অপরাধ তাহার অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হইয়াছে এবং উহা রোধ করিবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন।’ 

এই ধারার উপধারা (২)-এ বলা হয়েছে, ‘উপধারা (১) এ উল্লেখিত কোম্পানি আইনগত সত্তা হইলে, উক্ত উপধারায় উল্লেখিত ব্যক্তিকে অভিযুক্ত ও দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে, তবে এর ওপর (মালিকপক্ষ) সংশ্লিষ্ট বিধান অনুসারে শুধু অর্থদণ্ড আরোপ করা যাইবে।’ 

এই ধারায় কোম্পানি অর্থে, নিয়মিত বা নিবন্ধিত হোক বা না হোক, কোনো কোম্পানি বা সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, অংশীদারি কারবার, সমিতি বা একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত সংগঠন এবং সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা সরকারের সম্পূর্ণ বা আংশিক মালিকানাধীন যেকোনো কোম্পানি বা সংস্থা এর অন্তর্ভুক্ত হবে।

অপরাধ সংঘটনে সহায়তা, প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্রের দণ্ড হিসেবে আইনের ধারা-৯৯ এ বলা আছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন বা প্ররোচনা প্রদান করেন বা ষড়যন্ত্র করেন এবং যার ফলে সংশ্লিষ্ট অপরাধটি সংঘটিত হয়, তা হলে সহায়তাকারী, যড়যন্ত্রকারী বা প্ররোচনা প্রদানকারী ব্যক্তি ওই অপরাধ সংঘটনের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের সমপরিমাণ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

একই অপরাধ আবার ঘটালে ধারা-১০০ অনুযায়ী উল্লিখিত অপরাধের জন্য অপরাধীকে নির্ধারিত সর্বোচ্চ দণ্ডের দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে এবং এটা কোনোভাবেই আগের দণ্ডের দ্বিগুণের কম হবে না। আইনজ্ঞদের মতে, এই সহায়তাকারীরা হতে পারে মালিকপক্ষ। 

কর্মঘণ্টা নির্ধারণ : সড়ক পরিবহন আইনের ৩৯ ধারার উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে, ‘সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (২০০৬ সালের ৪২ নম্বর আইন) এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবহন চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করবেন। (২) নিয়োগকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উপধারা (১) মেনে চলবেন।’ 

পরে সরকার এক প্রজ্ঞাপনে বলে, ‘চালকদের একটানা ৫ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো যাবে না এবং ৫ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রাম দিতে হবে।’

চালকদের বিষয়ে গাড়ির মালিকের দায় : গাড়ি পরিচালনা, ড্রাইভার নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মালিকদের দায়িত্ব, কর্তব্য বা করণীয় সম্পর্কে ধারা ১৩ (১)-এ বলা হয়েছে, ‘যেসব ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই বা স্থগিত আছে বা বাতিল আছে তাদের কোনো অবস্থাতেই মোটরযান মালিকগণ নিয়োগ দিতে পারবেন না।’ 

ধারা ১৩ (২) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘শ্রম আইন ২০০৬ (২০০৬ সনের ৪২ নম্বর আইন) লিখিতভাবে চুক্তি সম্পাদন ও নিয়োগপত্র ব্যতীত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো চালককে নিয়োগ দিতে পারবেন না।’ 

ধারা ১৪ (১) বলা হয়েছে, ‘কোনো গণপরিবহনে লাইসেন্স ব্যতীত কাউকে গাড়ি পরিচালনাকারী বা কন্ডাক্টর নিয়োগ দিতে পারবেন না। উপধারা (২)- শ্রম আইন ২০০৬ (২০০৬ সনের ৪২ নম্বর আইন) লিখিতভাবে চুক্তি সম্পাদন ও নিয়োগপত্র ব্যতীত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো পরিচালনাকারী নিয়োগ দিতে পারবেন না।’ এই আইনে চালক, কন্ডাক্টর, হেলপারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। 

গাড়ির লাইসেন্স : দুর্ঘটনায় যানবাহনের মালিকদের লাইসেন্স বা কোনো অনুমোদন বা কাগজ দেওয়ার ব্যাপারে এই আইনে কিছু বলা নেই। তবে এই আইনে মোটরযান রেজিস্ট্রেশন স্থগিত বা বাতিলের বিষয়ে ধারা-২৪ (১) এ বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা বিধি দ্বারা নির্ধারিত মোটরযান রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত শর্তাবলির কোনো শর্ত ভঙ্গ করিলে বা এই আইনের পরিপন্থি কোনো কাজ করিলে কর্তৃপক্ষ শুনানি গ্রহণ করিয়া সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রেশন স্থগিত বা ক্ষেত্রমতে বাতিল করিতে পারিবেন।’ এখানে রেজিস্ট্রেশন শর্তের কথা বলতে বিআরটিএর ধারা-১৬ (১) অনুসারে বিভিন্ন বিধির কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো- ‘মোটরযান মালিক রেজিস্ট্রেশন সনদ ব্যতীত সড়ক, মহাসড়ক বা পাবলিক প্লেসে মোটরযান চালাইতে বা চালাইবার অনুমতি প্রদান করিতে পারিবেন না।’ 

ক্ষতিপূরণের বিধি : আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের বিষয়ে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির চিকিৎসা খরচ না দিলে সড়ক পরিবহন আইনের ধারা ৬২ এর বিধান লঙ্ঘন হবে। এক্ষেত্রে এটি একটি অপরাধ এবং এর জন্য তিনি অনধিক ১ (এক) মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ (বিশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। চালকের ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ (এক) পয়েন্ট কাটা হবে। কোনো মোটরযানে দুর্ঘটনার ফলে কোনো ব্যক্তি আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে, ওই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ক্ষেত্রমতো তার উত্তরাধিকারীগণের পক্ষে মনোনীত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, চিকিৎসার খরচ প্রাপ্য হবেন; যা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট মোটরযান কর্তৃপক্ষকে।

আইনটি প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ এর ১০৬ (১) ও (২) ধারায় মালিকপক্ষের অপরাধের বিষয় ও দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। আইনের যেকোনো ধারায় অপরাধে মালিকদের সংশ্লিষ্টতা থাকলেই তাকে অভিযুক্ত করা যাবে।’ 

এই ধারায় শুধু অর্থদণ্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই ধারাটিতে দোষী প্রমাণিত হলে মালিকদের শুধু অর্থদণ্ডের কথাই বলা হয়েছে।’ তবে প্ররোচনা, যেমন প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানোর নির্দেশনা যদি মালিকপক্ষ থেকে থাকে এবং এ কারণে যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে ধারা ৯৯ অনুসারে চালকের শাস্তির সমপরিমাণ শাস্তির কথা বলা আছে।

কী ঘটছে বাস্তবে

গত রবিবার (১৯ মার্চ) খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের একটি বাস মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে খাদে পড়ে যায়। এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে। শিবচর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু নাঈম মোহাম্মদ মোফাজ্জেল হক বলেন, ‘দুর্ঘটনাকবলিত বাসটির কোনো ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না। নিহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে। চালক টানা ৩৩ ঘণ্টা বিশ্রাম ছাড়াই গাড়ি চালিয়েছেন এবং বাসটির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিক ছিল না বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়।’

এদিকে ১৯ জন নিহতের ঘটনায় বাস কোম্পানিকে অভিযুক্ত করে শিবচর থানায় মামলা করেছে হাইওয়ে পুলিশ। রবিবার (১৯ মার্চ) গভীর রাতে শিবচর হাইওয়ে থানার সার্জেন্ট জয়ন্ত সরকার বাদী হয়ে মামলাটি করেন। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ৯৮/৯৯/১০৫/১০৬(১) ধারার অপরাধ উল্লেখ করে মামলাটি করা হয়।

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাস কোম্পানিকে অভিযুক্ত করে হাইওয়ে পুলিশ মামলা করেছে। দুর্ঘটনায় বাসটির চালক, সুপারভাইজার, সহকারীর মৃত্যু হওয়ায় মামলায় তাদের রাখা হয়নি। বাসটি একটি কোম্পানির অধীনে পরিচালিত হতো। তাই নির্দিষ্ট কারও বিরুদ্ধে মামলা না করে কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে কার কী দায় সেটা বের করবে। এদিকে দুর্ঘটনাকবলিত বাসটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। মালিকপক্ষ তো অবশ্যই এর দায় এড়াতে পারবে না।’

এদিকে দুর্ঘটনার পর মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) পল্লব কুমার হাজরা এবং কমিটির সদস্যরা হলেন মাদারীপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মনিরুজ্জামান ফকির, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক শাহনেওয়াজ হাসানাত-ই-রাব্বি ও মাদারীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হোসেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের বাসটি পদ্মা সেতুতে ওঠার আগে চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে সেটি ছিটকে পড়ে। বাসটি দুমড়েমুচড়ে যায়। এর কারণ বাসটি চলার সময় বেশি গতি ছিল। চালকের পেশাদার লাইসেন্স থাকলেও ভারী যান চালানোর লাইসেন্স ছিল না।

ঢাকার রাজারবাগে গ্রিনলাইনের হেড অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা থেকে পরিবহনটির যেসব গাড়ি চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেটে যায়; সেসব গাড়ির ড্রাইভাররা প্রতিদিন ওইসব গন্তব্যে একই দিনে আসা-যাওয়া করেন। গত ২৯ জানুয়ারি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে কোনো বিশ্রাম না নিয়েই আবার ঢাকায় ফিরে আসেন গ্রিনলাইন গাড়ির ড্রাইভার রহমত (ছদ্ম নাম)। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোনো বিশ্রাম ছাড়াই তিনি গাড়ি চালিয়েছেন বলে এই প্রতিবেদককে জানান। অথচ একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানোই বিধিবহির্ভূত। 

বিষয়টি স্বীকার করে গ্রিনলাইন পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘চালকদের বিশ্রামের ব্যবস্থা কোনো পরিবহনই করতে পারবে না। তা ছাড়া ড্রাইভারদের বিশ্রামের মতো ব্যবস্থা কোনো রুটেই এখনও করতে পারেনি রাষ্ট্র। বিশ্রামটা তাহলে কীভাবে নেবে?’ 

পাঁচ ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রাম নেওয়ার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও তা কেন মানা হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এক গাড়িতে দুজন ড্রাইভার থাকেন। তবে একসঙ্গে নয়। একজন ট্রিপ নিয়ে যান, আবার ফিরে আসেন। এরপর ড্রাইভার পরিবর্তন করে আবার ট্রিপ দেওয়া হয়। তবে দূরের গন্তব্যে পাঁচ ঘণ্টার বেশি একটানা গাড়ি চালাতে হয়।’

বিশ্রামের অভাবে দুর্ঘটনা হলে এর দায় মালিকপক্ষের আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এর দায় আমাদের আছে, এটা মানছি।’

অনিয়মে কম যায় না রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিআরটিসিও। বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের বাকেরগঞ্জে গত বছর ২০ জুলাই বিআরটিসি বাসের সঙ্গে অটোরিকশার সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হয় তিনজন। পরে জানা যায় বিআরটিসির ওই বাসটির সাত বছর ধরে ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না। এমনকি পাঁচ বছর ধরে বাসটির রেজিস্ট্রেশনও নবায়ন করা হয়নি। সামনের অংশ ভাঙা থাকা বিআরটিসি বাসটি দীর্ঘমেয়াদি লিজ নিয়ে চলছিল বলে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ তখন জানায়। 

বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মো. শাহ আলম জানান, ২০১৫ সালের ২৮ মের পর থেকে বাসটির ফিটনেস ছিল না। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বরের পর বাসটির রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। বিআরটিসি বরিশাল ডিপো ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বাসটির দীর্ঘমেয়াদি লিজ নেওয়া ছিল।’ তবে চালকের লাইসেন্স ছিল কি না- সে বিষয়ে তিনি জানেন না বলে জানান। 

গত ২২ জানুয়ারি দুপুরে রাজধানীর কুড়িল এলাকায় ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় নিহত হন রাজধানীর নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী নাদিয়া সুলতানা (২০)। এ সময় নাদিয়ার বন্ধুও গুরুতর আহত হন। জানা গেছে, যে বাসটি তাদের ধাক্কা দিয়েছে সেটি একসময় ছিল সুপ্রভাত পরিবহনের। নাম বদলে হয়েছে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহন। ভিক্টরের মতো সুপ্রভাত পরিবহনও এর আগে সড়কে চাপা দিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটিয়েছে। 

২০১৯ সালের মার্চ মাসে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সামনের সড়কে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের চাপায় প্রাণ হারান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। ঘটনার পর সুপ্রভাত বাসটির রুট পারমিট বাতিল করে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। কিন্তু বিআরটিএর এ ঘোষণার আগেই অবস্থা বেগতিক দেখে বদলে ফেলা হয় সুপ্রভাত পরিবহন নামটি। বদলে যায় বাসের রঙও। ভিক্টর ক্লাসিক, আকাশ ও সম্রাট ট্রান্সলাইন নাম ধারণ করে বাস নামায় আগেরকার সুপ্রভাত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। ঠিক আগের মতোই চাঁদাবাজি ও জুলুম চালক-কন্ডাক্টরদের ওপর চাপিয়ে দেন বাস মালিকরা। এতে রাস্তায় নেমে সেই আগের মতোই বেপরোয়া অবস্থানে থাকে চালকরা। 

জানা যায়, সুপ্রভাত প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির নামে বিআরটিএর রুট পারমিট ইস্যু ছিল ১৮৭টি বাসের। কিন্তু বাসপ্রতি এককালীন এক লাখ টাকা ও দৈনিক হারে চাঁদা আদায়ের সুবিধায় ওই রুটে চলছিল তিনশ বাস-মিনিবাস; যা এখনও চলছে। এই অধিকসংখ্যক বাসের কারণে রাস্তায় চলে প্রতিযোগিতা, হয় দুর্ঘটনা। তাই এর জন্য মূলত মালিকরাই দায়ী বলে জানিয়েছেন আইনজ্ঞরা।

২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকার মেয়র মো. হানিফ ফ্লাইওভারে গ্রিনলাইন বাসের সঙ্গে রাসেল সরকারের গাড়ির ধাক্কা লাগে। পরে গাড়ির চালক রাসেল বাইরে বের হয়ে এসে কারণ জানতে চান। এসময় বাসচালকের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। বাসচালক এক পর্যায়ে তার পায়ের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে নিয়ে যায়। এতে রাসেলের বাম পা ঘটনাস্থলেই সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ওই ঘটনায় গ্রিনলাইন পরিবহনকে প্রথমে হাইকোর্ট ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিলেও আপিল বিভাগ তা স্থগিত করে দেন। পরবর্তীকালে হাইকোর্ট ক্ষতিপূরণের টাকা কমিয়ে ২০ লাখ টাকা ধার্য করলে ঘটনার প্রায় তিন বছর পর ২০২১ সালে সেই টাকা দেওয়া হয় রাসেলকে। আর ওই ঘাতক ড্রাইভারকে বরখাস্ত করেই দায়মুক্ত হয় পরিবহনটির মালিকপক্ষ। 

সাজা নয়, শুধু ‘তিরস্কার’ 

ঢাকার রূপনগরের সবজি বিক্রেতা আয়নাল হোসেনের (৫৫) স্ত্রী ফিরোজা বেগম (৪৫) ঢাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অ্যাম্বুলেন্সে স্ত্রীর লাশ নিয়ে আয়নাল হোসেন ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল ঢাকা থেকে গাইবান্ধায় বাড়িতে ফিরছিলেন। তবে পথে বাসচাপায় আয়নালও বাড়ি ফিরেছেন লাশ হয়ে। একই দুর্ঘটনায় ওই অ্যাম্বুলেন্সের চালকও নিহত হন। বগুড়ার শেরপুরে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের ঘোগা সেতুর পাশে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত অ্যাম্বুলেন্সচালকের নাম দ্বীন ইসলাম (৪৫)। তার বাড়ি পিরোজপুর জেলার কাউখালী থানায়। দুর্ঘটনায় নিহত আয়নাল হোসেনের তিন ছেলে গুরুতর আহত হন। আহত ব্যক্তিরা হলেনÑ শহীদ হোসেন (২০), ফরহাদ হোসেন (১৮) ও ফিরোজ হোসেন (২৯)।

এই ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট মামলা করা হয়। এর প্রাথমিক শুনানি শেষে গত ৭ আগস্ট বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুলসহ আদেশ দেন। আদেশে সড়ক পরিবহন আইনের অধীনে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের ফান্ড গঠনে কী অগ্রগতি হয়েছে, তা দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতকে জানাতে বোর্ডের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সড়ক ও পরিবহন সচিব, আইন সচিব, বিআরটিএর চেয়ারম্যান ও শ্যামলী পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। 

আইনজীবী শিশির মনির জানান, এ ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইনি নোটিস দেওয়া হয়েছিল। শ্যামলী পরিবহনের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তারা এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। পরে বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষে সাতজন রিট করেন। এই মামলায় আদালত মালিকপক্ষকে তিরস্কার করে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেন। 

বিশেষজ্ঞদের অভিমত

সড়ক দুর্ঘটনার পর দায়মুক্তির ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের অর্থ ও ক্ষমতা এবং বাংলাদেশের বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, “আইনে ‘অবহেলাজনিত মোটরযান চালনার’ কথা বলা হয়েছে। মালিকরা তো গাড়ি চালান না। তাই মালিকদের অবহেলা থাকলেও আইনে তাদের দণ্ডের কথা উল্লেখ নেই। তাই এই আইনটাই সংশোধন করতে হবে মালিক ও চালকদের সংশোধন করতে হলে।”

দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এ ধরনের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিধান সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না থাকা ও পরিবহন মালিকদের ভয় পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না।’

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল বলেন, ‘শুধু আইন দিয়ে যেহেতু পরিবহন মালিকদের কিছু করা যায় না, তাই সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আলাদা ট্রাইব্যুনাল করা দরকার। এ ছাড়া দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে তদন্ত কর্মকর্তারা যদি চাপে থাকতেন, তাহলে সাধারণ মানুষ সড়ক পরিবহন আইনের সুফল পেতেন।’ 

তারেক মাসুদের মামলার প্রসঙ্গ টেনে ব্যারিস্টার বাদল বলেন, ‘তাদের ক্ষমতা আছে বড় আইনজীবী দিয়ে সংবিধানের ১১০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টে মামলা করেছেন। কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশও পেয়েছেন। সাধারণ পরিবহন মালিকরা যেই ধরনের আরাম বা অব্যাহতি উপভোগ করেন, তা এই মামলার ক্ষেত্রে হয়নি। তাই সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এটি হলে পরিবহন মালিকরা আর ঔদ্ধত্য দেখানোর সাহস পাবে না।’

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘পরিবহন মালিকদের অনেক ক্ষমতা অনেক টাকা। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে টাকা দিয়ে দুর্ঘটনার পুরো দায় চালক কিংবা ভুক্তভোগীর ওপর চাপিয়ে দেন। আর নিজেরা আরামে বসে থাকেন।’ 

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘পরিবহন মালিকরা প্রথমেই অর্থ আর ক্ষমতা দিয়ে মামলা থেকে দূরে সরে যেতে সক্ষম হন। এরপর ক্ষতিপূরণের জন্য আদেশ দেন আদালত তা দিতে গড়িমসি করেন। একের পর এর আপিল আর আবেদন করে মামলা বিলম্বিত করেন। সবশেষ যেটুকু ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ থাকে তাও ঠিক মতো দেন না। আর মামলার এই দীর্ঘ পথচলায় ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রণে ভঙ্গ দেন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবার।’ 

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও সড়ক বিশেষজ্ঞ শামসুল হক বলেন, ‘সড়কে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী শুধু চালকরা নয়। পরিবহন মালিক, বিআরটিএ ও সড়কসংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান এর জন্য দায়ী। কেউ কারও দায়িত্ব পালন করেন না।’

তিনি বলেন, মালিকদের মধ্যেও অসুস্থ প্রতিযোগিতা আছে। আছে অধিক মুনাফার লোভ। আছে অনেক ক্ষমতা। নেই শুধু মানবিকতা। আর ক্ষমতার কারণেই তাদের আইনের আওতায় আনা যায় না।’ সংশোধিত সড়ক পরিবহন আইনে মালিকদের ছাড় দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এই আইন আবারও সংশোধন করা উচিত।’

মালিকদের কী অভিমত

শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ ঘোষ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের গাড়ি যখন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে, তখন আমাদের মানসিক অবস্থা কী হয়- সেটা কাউকে বোঝাতে পারব না। মানুষ হতাহত হচ্ছে, গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এরপরও আপনারা দোষ চাপান আমাদের ওপর।’

আইন মেনে রাস্তায় গাড়ি চালানো হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের গাড়ি সড়ক পরিবহন আইন পুরোপুরি মেনেই মহাসড়কে নামে। কোনো ত্রুটি থাকলে সেই গাড়ি রাস্তায় বের করার তো প্রশ্নই আসে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা চালক ও চালকের সহকারীকে নিয়োগ দিই সম্পূর্ণ আইন মেনেই। রাস্তায় নিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চালাতে নির্দেশনা দেওয়া আছে। এরপরও বিভিন্ন কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। এর জন্য মালিকরা কীভাবে দায়ী হয়?’ 

দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে মালিকদের গড়িমসির বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আদালতের নির্দেশ থাকলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিই।’ ‘আপনাদের এত ক্ষমতা- যা ইচ্ছে তাই করেন’ হাইকোর্টের এমন মন্তব্যের ব্যাপারে রমেশ ঘোষ বলেন, ‘হাইকোর্ট বলেছেন, এখন আমার আর কী বলার আছে।’

মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রায়ই নাম আসে এনা পবিহনের। ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার রশিদপুরে একটি পেট্রোলপাম্পের কাছে এনা পরিবহন ও লন্ডন এক্সপ্রেসের দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে ছয়জন ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়। ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর হবিগঞ্জে মাধবপুরে এনা পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেলের এক আরোহী নিহত হন।

২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এনা পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে অটোরিকশার সংঘর্ষ ঘটে। এতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুজন আহাম্মেদ নিহত হন। ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে বিয়ানীবাজারগামী এনা পরিবহনের একটি বাস খাদে পড়ে যায়। তবে দুর্ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। ২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় এনা পরিবহনের বাস খাদে পড়ে তিন যাত্রী নিহত হন। ২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট নরসিংদীর শিবপুরে এনা পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের চাপায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। 

প্রতিটি দুর্ঘটনার জন্যই এনা পরিবহনের অতিরিক্ত গতির কথা উল্লেখ করেছে হাইওয়ে পুলিশ। 

এনা পরিবহনের মালিক ও পরিবহন ব্যবসায়ী নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকা থেকে কাছাকাছি দূরত্বের রুটে একজন ড্রাইভার দিনে দুবার ট্রিপ দেন। তবে দূরে যেমন কক্সকবাজার, এসব রুটে এনার ড্রাইভাররা দিনে একবারই ট্রিপ দেন।’ তিনি দাবি করেন, এনা পরিবহনের সব গাড়িতে ডিভাইস লাগানো আছে। কেউ অতিরিক্ত গতিতে বা বেপরোয়া চালাতে পারে না। আমরা গাড়ির সব স্টাফদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকি। এরপরও রাস্তায় দুর্ঘটনা তো বিভিন্ন কারণে হতেই পারে। সব কিছুর দায় মালিকদের নিতে হবে কেন?’ 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা