প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৪:৪৮ পিএম
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৫:১৮ পিএম
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মাজহারুল আনোয়ারের মরদেহে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন অসংখ্য মানুষ।
রাজনৈতিক মতাদর্শে গাজী মাজহারুল আনোয়ার যে দলেরই সমর্থক হোন না কেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা গানের জগতে তিনি সৃষ্টিশীলতার যে অনন্য স্বাক্ষর রেখে গেছেন, কেবল তাতেই কিংবদন্তি এ গীতিকারকে মূল্যায়ন করতে হবে বলে মনে করছেন সংস্কৃতিজনরা।
সোমবার বেলা ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়ার পর তার কফিনে শ্রদ্ধা জানান স্বজন, বন্ধুবান্ধব, রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মেয়ে দিঠি আনোয়ার ও ছেলে সরফরাজ আনোয়ার উপলও ছিলেন সেখানে।
সম্মিলিত জোট আয়োজিত এ শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে প্রথমেই দেওয়া হয় গার্ড অব অনার। এরপর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো শুরু হয়।
কিছুদিন ধরে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ভুগতে থাকা গাজী মাজহারুল আনোয়ার গতকাল রবিবার সকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বারিধারার বাসা থেকে তাকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
মেয়ে সংগীতশিল্পী দিঠি আনোয়ার যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় তার মরদেহ ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমঘরে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সোমবার সকালে মেয়ে দেশে ফিরলে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত হয়।
দিঠি আনোয়ার বলেন, ‘আব্বুর শেষ ইচ্ছা ছিল, শেষ পর্যন্ত যেন তার হাতে কলম থাকে। তাই ছিল। আমি দুই মাস ধরে আমেরিকায়। আমার আরও পরে আসার কথা ছিল। কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না। এ জন্য চলে এসেছি। আসার সময় পথেও বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এর মধ্যেই খবর পাই আব্বুর মৃত্যুর। আব্বু বলতেন, মা, আমি কোনো রাজনীতি বুঝি না। আমি দেশের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এর চেয়ে বড় আর কিছু হতে পারে না। আমাকে যখন যে ডাকবে, তার কাছেই যাব।’
দিঠি বর্তমান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘আব্বুকে শহীদ মিনারে নিয়ে আসতে পেরেছি এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’
ছেলে উপলও কথা বলেন এ সময়।
উপল বলেন, তার বাবার গানের পরিমাণ ২০ হাজারেরও বেশি। ৪২টির মতো সিনেমা পরিচালনা করেছেন তিনি। একটি অসমাপ্ত বই নিয়েও কাজ করছিলেন তারা, যেটি আগামী বইমেলায় প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল।
বাবার সৃষ্টি সংরক্ষণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন তারা।
তিনি আরও বলেন, গাজী মাজহারুল আনোয়ার বহু প্রলোভন, বহু হাতছানি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। নিমগ্ন থেকেছেন বহুমাত্রিকতায়, যে কঠিনতম কাজটি করে তিনি উদাহরণ রেখে গেছেন।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা জাসাসেরও উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।
তবে এ বছর আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে।
শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর কণ্ঠেও সেই আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে।
তিনি বলেন, গাজী মাজহারুল আনোয়ার তার হতাশার কথা আমাকে বলে গেছেন। ষাট ও সত্তরের দশকে আমাদের নাটক, গান ও চলচ্চিত্রে যে জোয়ার বয়ে গেছিল, নতুন সহস্রাব্দে সেই জোয়ার বা সাংস্কৃতিক ঐক্য রাজনৈতিক মেরুকরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আমার মতে, তিনি সব রাজনৈতিক মেরুকরণের ঊর্ধ্বে উঠে মূল্যায়িত হবেন তার সৃষ্টির সম্ভারে।
কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, গাজী ভাইয়ের সঙ্গে আমার ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সম্পর্ক৷ তিনি যে ২০ হাজার গান লিখেছেন তার প্রায় ছয় সাত হাজার গান তো আমিই গেয়েছি। তিনি, সত্যদা (প্রয়াত সুরকার সত্য সাহা) আর আমি ছিলাম টিমের মতো। কত স্মৃতি, কত কথা, কত গান, তা কী করে বলি এক মুহূর্তে! তিনি কফিনে শুয়ে আছেন, এ দিনটি আমাকে দেখতে হবে সেটা আমি কল্পনাও করিনি।
প্রবীণ চিত্রনায়ক ও বিএনপির সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল বলেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তার গানে আন্দোলিত হয়েছে৷ তার গান রেডিও, টেলিভিশন যেখানেই বাজুক, সেখানেই তার নাম সবসময় শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হবে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান বলেন, কথা প্রসঙ্গে পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি গান রচনা করে ফেলতেন। শুধু কী গানের রচয়িতা, আমরা তাকে পেয়েছি চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবেও। তার মতো বিরল প্রতিভা তো সহজে আসে না।
সংগীত ঐক্য বাংলাদেশ-এর পক্ষে শ্রদ্ধা জানান মহাসচিব নকীব খান, কুমার বিশ্বজিৎ, দপ্তর সচিব আসিফ ইকবাল।
কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, গাজী মাজহারুল আনোয়ার ছিলেন এক কালপুরুষ৷ একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে অথবা একজন নাগরিক হিসেবে তিনি আমাদের যা দিয়ে গেছেন, সেই ঋণ অপূরণীয়।
আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।
অসীম কুমার উকিল বলেন, গাজী মাজহারুল আনোয়ার সারা জীবন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থেকে গানে গানে বাংলার মানুষের কথা বলে গেছেন। তাই তিনি সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছেন। তার স্মৃতি সংরক্ষণে যা কিছু করণীয়, তা সরকার করবে৷
এদিন শিল্পকলা একাডেমি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, সুরতাল সংগীত একাডেমি, গণসংহতি আন্দোলন, ন্যাপ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি, যুব মৈত্রীসহ বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন শ্রদ্ধা জানাতে আসে।
পরে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কফিন নিয়ে যাওয়া হয় বিএফডিসিতে। সেখানে বাদ জোহর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে আরও একটি নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এরপর বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরে শ্রদ্ধেয় গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে দাফন করা হবে।
প্রবা/রাই /এসআর