× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

তিতাসের দুর্নীতিবাজরা এত শক্তিশালী!

মামুন-অর-রশিদ

প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৩ ১০:৫৪ এএম

আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৩ ১০:৫৬ এএম

তিতাসের দুর্নীতিবাজরা এত শক্তিশালী!

নারায়ণগঞ্জ, মগবাজার এবং সিদ্দিকবাজারে তিনটি বড় বিস্ফোরণের ঘটনা অনুসন্ধানে নাম এসেছে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কারও বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

অভিযোগ উঠেছে, প্রতিটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটবার সঙ্গে সঙ্গে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তদন্ত করে দায় এড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিতাসের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে সাহস করে না বলেই এরকম হচ্ছে। 

পর্যবেক্ষকরা বলছে, এ ধরনের বিস্ফোরণ-বিপর্যয়ে উদ্যোগী ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এসব দুর্ঘটনার পর জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত কমিটি পর্যন্ত গঠন করা হয়নি। তিতাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া দূরে থাক, অতীতে বরং দেখা গেছে, তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির কর্মীদের হুমকিতে তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য জ্বালানি সচিব পর্যন্ত ছুটে গেছেন। অবশ্য এখন সেই সাবেক সচিব বলছেন, তিতাসের কর্মীদের আইনগত সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে তারা কিছু করেননি।

নারায়ণগঞ্জ গ্যাস বিস্ফোরণ

নারায়ণগঞ্জের বায়তুস সালাত জামে মসজিদে শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটেছিল ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এশার নামাজের সময়। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বিস্ফোরণ বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, পাইপলাইনের লিকেজ দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে আসায় এই বিস্ফোরণ ঘটেছে।

যার ফলে তখন সব মিলিয়ে ৩৪ জন নিহত আর শতাধিক আহত হন। তখন তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির পক্ষ থেকে চারজনকে সাময়িকভাবে বরখস্ত করা হয়। ওই বছর ১৯ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ তিতাসের ৮ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে। এক দিন পর ২১ সেপ্টেম্বর তারা সবাই জামিনে বের হয়ে আসেন।

পর্যবেক্ষকদের অভিযোগ, গ্রেপ্তার হওয়া কর্মকর্তাদের মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ গ্রেপ্তারের পরদিন ২০ সেপ্টেম্বর তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মবিরতি শুরু করেন।

জ্বালানি বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দেশে স্বাভাবিক গ্যাস সরবরাহ প্রক্রিয়ায় ‘বিঘ্ন সৃষ্টির’ শঙ্কায় তৎকালীন জ্বালানি সচিব আনিসুর রহমান তিতাসে যান। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনার পর তিনি জামিনের আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন।

সাবেক জ্বালানি সচিব আনিসুর রহমান বর্তমানে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সরকারের তরফ থেকে তাদের কোনো আইনি আশ্রয় দেওয়া হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তারা জেলেও গিয়েছিলেন এবং এখন জামিনে রয়েছেন।

তিনি জ্বালানি সচিবের দায়িত্বে থাকার সময় নারায়ণগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে তিতাসের কর্মীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ার অনুমোদন চাওয়া হয়েছিল; এ তথ্য জানিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়, চার্জশিটটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল কি না। উত্তরে তিনি বলেন, বিষয়টি মনে করতে পারছি না। পাশাপাশি তিনি এ-ও জানান, তিনি মনে করেন, এ ধরনের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। 

নারায়ণগঞ্জ সিআইডি ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর এ ঘটনায় আদালতে ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে স্থানীয় আদালতে চার্জশিট দেয়। সেখানে যে ২৯ জনকে দায়ী করা হয়, তাদের সবাই মসজিদ কমিটির সদস্য এবং স্থানীয় নাগরিক। তখন জানানো হয়েছিল, সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেলে তিতাসের আট কর্মকর্তা কর্মচারীর নাম উল্লেখ করে সম্পূরক চার্জশিট দেওয়া হবে।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। বিষয়টি অনেক আগের। এটি আমার জানা নেই।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বাবুল আক্তার বলেন, আমরা তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তখন অনুমোদন চেয়েছিলাম। কিন্তু তিতাসের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তাই পরে আর সম্পূরক চার্জশিট দেওয়া হয়নি। 

মগবাজার গ্যাস বিস্ফোরণ

নারায়ণগঞ্জ ট্র্যাজেডির ঠিক ১০ মাস পর ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজার ওয়্যারলেস গেটের কাছে আড়ংয়ের উল্টোদিকে ভয়াবহ এক বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ১২ জন নিহন হন। আহত হন অনেকে। বিস্ফোরণ ঘটার পরপরই তিতাস সবার আগে তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়ে বলে, এই ঘটনায় তিতাসের কোনো দায় নেই। সেখানে কোনো গ্যাসের লাইন ছিল না।

তবে এ বিস্ফোরণের পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভবনের সামনের রাস্তার পাশে তিতাস গ্যাসের একটি রাইজার ছিল। ৭-৮ বছর আগে ওই ভবনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা হলেও ওই পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়নি। গ্যাস বিপণন নীতিমালা অনুসারে, এটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করার কথা থাকলেও সেটি তিতাস করেনি। 

ওই সময় বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস এবং রেগুলেটর হিসেবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এ ঘটনার তদন্ত পরিচালনা করে। 

বাংলাদেশে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সচিব ব্যরিস্টার মো. খলিলুর রহমান খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, গ্যাস বিপণন নীতিমালা অনুযায়ী তিতাসের এসব নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করার বিধান রয়েছে। তাদের সে ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারীও রয়েছে। তখনকার তদন্তে উঠে এসেছিল, তিতাসের নিয়মিত নজরদারির অভাব ছিল বলেই এই ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে নিয়মিত পরিদর্শনের সুপারিশ করেছিল বিইআরসি।

ব্যারিস্টার খলিল জানান, ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি বিইআরসির তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে।

কিন্তু এ ঘটনাতেও তিতাসের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করা সম্ভব হয়নি। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) তদন্তকারী কর্মকর্তা মোদাচ্ছের কায়সার জানান, অন্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়াতে তারা কাজটি শেষ করতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে তিনি বিশেষ করে জ্বালানি বিভাগেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়ার কথা উল্লেখ করেন।

জানতে চাইলে উপ-প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবদুল হান্নান বলেন, আমরা গত ৭ মার্চ পুলিশকে তদন্ত রিপোর্ট পাঠিয়েছি। 

উল্লেখ্য, একই ঘটনায় বিইআরসি এক বছরেরও বেশি সময় আগে গত বছরের ১৯ জানুয়ারি প্রতিবেদন দিয়েছে। অন্যদিকে বিস্ফোরক পরিদপ্তর দিয়েছে গত ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজার বিস্ফোরণ ঘটার দিন। 

সিদ্দিকবাজার বিস্ফোরণ

গত ৭ মার্চের এই ঘটনায় অন্তত ২৩ জন নিহত হয়েছেন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রাথমিক অনুসন্ধান বলছে, ২০০১ সালে এখানে গ্যাস সংযোগের লাইনটি রাইজার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবে সংযোগ লাইন অপসারণ করা হয়নি। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এ ঘটনাটিতেও মগবাজার বিস্ফোরণের অনুরূপ কার্যকারণ রয়েছে।

ভবনের বেজমেন্টে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের একটি পরিত্যক্ত লাইনের অস্তিত্ব পেয়েছেন অনুসন্ধানকারীরা। ভবনটির বেজমেন্টে একসময় রান্নাঘর ছিল, আর নিচতলায় ছিল খাবারের হোটেল। এই রান্নাঘরে তিতাস গ্যাসের বাণিজ্যিক লাইন ছিল। 

কিন্তু তিতাসের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির তদন্ত কমিটির প্রধান তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) ঢাকা মেট্রো মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, তিতাসের গ্যাস থেকে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি। 

গত ১২ মার্চ তিতাসের ১৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। পরে তিতাসের জেনারেল ম্যানেজার শামসুদ্দিন আল আজাদ বলেন, কয়েকটি গণমাধ্যমে তিতাসের গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি সঠিক নয়। এখানে আমরা কোনো গ্যাসের অস্তিত্ব পাইনি। 

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

সাম্প্রতিক বিস্ফোরণের পর তিতাসের সম্পৃক্ততা ও সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে জ্বালানি বিভাগের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলমের কাছে।

তিনি বলেন, তিতাসের এই দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কেউ সাহসই পায় না। তিনি অভিযোগ করেন, তিতাসের চেয়ারম্যান তো জ্বালানি বিভাগের সচিব। তিতাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানে তার বিরুদ্ধেই অভিযোগ।

যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি কী করে সেই অভিযোগের সুরাহা করবেন? শামসুল আলম বলেন, সচিব মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক নির্বাহী। আমি মনে করি, এই দুর্নীতিবাজদের তিনি প্রশাসনিক সহায়তা দিচ্ছেন।

জ্বালানি সচিবের বক্তব্য পাওয়া যায়নি

জ্বালানি সচিব ড. মো. খাইরুজ্জামান মজুমদারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে প্রসঙ্গটির উল্লেখ করে কথা বলতে চাওয়া হয়। বিষয়টি তিনি ‘সিন’ করার পর ফোন করা হয়। কিন্তু সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা