দীপক দেব
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৩ ০৯:০৭ এএম
আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৩ ১১:৪৩ এএম
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের সামনে ভাষণ দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
অনেক আগে থেকেই বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুধু একাত্তরের ৭ মার্চ নয়, এর আগেও তিনি প্রকাশ্য জনসভায় স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। তিনি না থাকলেও বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন যেন থেমে না যায় একাত্তরের ৩ মার্চ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার প্রতি এই আহ্বান জানিয়েছিলেন বাঙালির মুক্তির মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান।
’৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি মরে গেলেও ৭ কোটি মানুষ দেখবে দেশ সত্যিকার স্বাধীন হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘হয়তো এটাই আমার শেষ ভাষণ। আমি যদি নাও থাকি আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন যেন না থামে।’ পরদিন ৪ মার্চের দৈনিক ইত্তেফাক ও আজাদে ওই সভার বিস্তারিত ছাপা হয়। বঙ্গবন্ধু তার ৩ মার্চের সেই ভাষণেরই প্রতিধ্বনি করলেন ৭ মার্চ আরও সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাসহ।
ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ওই জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ।
ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘সর্বাধিনায়ক’, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
ড. মোহাম্মদ হান্নান তার ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি লিখেন বঙ্গবন্ধু এদিন ভাষণে অফিস-আদালতে যাওয়া এবং কর খাজনা দেওয়া বন্ধ রাখতে বলেন। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করলে তিনি তা লঙ্ঘন করার নির্দেশ দেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দানবের সাথে লড়াইয়ে যে কোনো পরিণতিকে মাথা পেতে বরণের জন্য আমরা প্রস্তুত। তেইশ বছর রক্ত দিয়ে এসেছি। প্রয়োজনবোধে বুকের রক্তে গঙ্গা বহাইয়া দেবো। তবু সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বাংলার বীর শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানি করবো না।’
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে সাংবাদিক লেখক মুস্তাফিজ শফি সম্পাদিত ‘ভাষণ অথবা একটি কবিতার গল্প’ বইয়েও একাত্তরের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ নিয়ে একটি লেখা ছাপা হয়েছে।
ড. মোহাম্মদ হান্নান তার গ্রন্থে আরও লিখেছেন, পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার কথা বলায় উদ্বেলিত মানুষ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো, গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়ো মুক্তিবাহিনী গঠন করো’ স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে।
সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এম নজরুল ইসলাম একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘৩ মার্চ সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণার পরও পাকিস্তানি সামরিক চক্র বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেনি। এর অন্যতম কারণ ছিল, বাঙালিদের প্রতিরোধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব। তাদের সার্বিক প্রস্তুতি নিতে ২৫ মার্চ পর্যন্ত লেগে গিয়েছিল। যে কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, রোববার দ্বিতীয়বার বাঙালিদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা ও সংগ্রামের সুস্পষ্ট কর্মসূচি নিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগ পান। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্র। যুদ্ধের নয়টি মাস মুক্তিকামী বাঙালি জাতি তাদের প্রিয় নেতার ঐতিহাসিক ভাষণটি শুনে উজ্জীবিত ও প্রাণিত হয়েছে।’ লেখাটি আওয়ামী লীগের দলীয় ওয়েব সাইটেও প্রকাশ করা হয়।
এই প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের তৎকালীন সহসভাপতি ও জাতীয় পার্টি জেপির মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ওই সভায় স্বাধীনতার ইশতেহার যেটা আমার ড্রাফট করা। সেটা বঙ্গবন্ধুর সামনেই পাঠ করেছিলেন শাহজাহান সিরাজ। স্বাধীনতার ঘোষণা, পতাকা, জাতীয় সংগীতÑএই সবকিছুই ওই ইশতেহারে ছিল। ওই দিনই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ৭ মার্চ পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।
তিনি বলেন, ১ মার্চ ইয়াহিয়ার ঘোষণাও শেষ, পাকিস্তানও শেষ। এরপরই সবকিছু বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ধরতে গেলে ওই সময় থেকেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আনুষ্ঠান ঘোষণা না করলেও সবকিছুই তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ রাতে এবং ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মূলত ১ মার্চ ইয়াহিয়ার ভাষণের পর থেকেই এই ভূখণ্ডের ওপর থেকে কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলে পাকিস্তানি হানাদাররা। ছাত্র-জনতা সবাই তখন তাকিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের দিকে। হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধু তখন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলন করে ইয়াহিয়ার ঘোষণার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান এবং ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালনের ঘোষণা দেন। ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভা থেকে পরবর্তী করণীয় ঘোষণা করবেন বলেও জানান।
এদিকে ৩ মার্চের পল্টনের জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু ৪ থেকে ৬ মার্চ দেশব্যাপী ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করে দেশের খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি ঘরে ঘরে সংগ্রাম কমিটি ও মুক্তিবাহিনী গঠনেরও আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পর ৪ মার্চ থেকে আরও উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ, দাবানলের মতো ছড়িয়ে যেতে থাকে আন্দোলন। ‘পিন্ডি না ঢাকা-ঢাকা, ঢাকা’ স্লোগানে প্রকম্পিক হয়ে ওঠে পুরো দেশ। আন্দোলনে হানাদার বাহিনীর আক্রমণে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিহত হয় শতাধিক ব্যক্তি। কোনোভাবেই দমানো যায়নি মুক্তিকামী জনতাকে। অস্ত্র সংগ্রহ করতে শুরু করে ছাত্র ও যুব নেতারা। দেশব্যাপী সংগ্রাম কমিটি গঠনের কাজ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে স্বাধীনতার দিকে। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং পাকিস্তান টেলিভিশন ‘ঢাকা টেলিভিশন’ নামে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে। বেতার ও টেলিভিশনে বাজতে শুরু করে দেশাত্মবোধক গান।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রামের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধুর মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা ও পরবর্তী নির্দেশ জানতে সেই দিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এসে সমবেত হয় ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কয়েক বর্গমাইল এলাকা লোকারণ্য হয়ে যায়।
‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। উড়তে থাকে বাংলাদেশের পতাকা। পরিবেশিত হয় জাতীয় সংগীত। বেলা ৩টার পর মঞ্চে ওঠেন বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯ মিনিটের এক জাদুকরি ভাষণে হাজার বছরের শৃঙ্খল ভঙ্গ করে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বাঙালি জাতিকে মুক্তির সংগ্রামের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ...’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠের এই ভাষণ পুরো বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উজ্জীবিত করেছিল।