× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

চুরির যত আয়োজন

এম আর মাসফি

প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:২০ পিএম

আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:৫৫ পিএম

চুরির যত আয়োজন

খুলনা শহরের তিনটি লিংক রোড নির্মাণের জন্য প্রকল্পের প্রস্তাবটা পড়তে গিয়ে পরতে পরতে হোঁচট খেতে হল। প্রতিটা জিনিসের দাম বাজারদরের চেয়ে অস্বাভাবিক বেশি দেখিয়ে কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। একটা জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল। সেখানে লেখা আছে, সড়কের পাশে ১ হাজার ৪২০টি গাছের চারা লাগানোর খরচ ২৮ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। ভাগ অঙ্ক করলে একটি গাছের চারা লাগানোর পেছনে খরচ করতে চাওয়া হয়েছে ২ হাজার ৩৩ টাকা!

সরেজমিন গত শুক্রবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের গ্রিন হাব বিডি নার্সারিতে গেলে উদ্যোক্তা সাইদুল ইসলাম বললেন, ‘সড়কের পাশে যেসব গাছ লাগানো হয়, যেমন শিশু, মেহগনি, কড়ই, অর্জুন, নিম, আকাশমনি ইত্যাদি চারার দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা পিস। যদি ১ হাজার চারা ৩ মাস পরিচর্যাসহ লাগিয়ে নিতে চান, তাহলে আমাদেরকে ১০০ থেকে ১৩০ টাকা করে দিতে হবে।’ দামি গাছের মধ্যে আগর, রক্তচন্দনের বড় সাইজের চারার দাম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা; তবে এগুলো তো আর রাস্তার পাশে লাগানো হয় না, জানালেন সাইদুল। একই ধরনের তথ্য মিলল ওই এলাকার ইউনিক, ইয়ামিন, গ্রিনপল্লী নার্সারিতেও।

গণপূর্ত বিভাগের উদ্যোগে ওই প্রকল্পটা নেয় খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবও (ডিপিপি) প্রণয়ন করে তারা। তাই কাজটা যেখানে, সেই খুলনার নার্সারিগুলোতে খোঁজ নেওয়া শুরু হল এটা জানতে যে, সেখানে গাছের দাম এত বেশি কি না। একই দিন খুলনা শহরের বেগুনবাড়ীর ‘রবিউল নার্সারি’র মালিক মো. রবিউল ইসলামের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘মেহগনি, অর্জুন, আকাশমনি, কড়ই ইত্যাদির চারা লাগানো থেকে পরিচর্যা পর্যন্ত ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা খরচ পড়বে প্রতিটিতে। কোনোটা মারা গেলে সেটা আবার লাগিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও আমাদের।’ আরও কম দামে পরিচর্যাসহ ৮০ থেকে ১০০ টাকা করে গাছ লাগিয়ে দেওয়ার কথা জানালেন খুলনার সোনালি নার্সারির মালিক। তার নামও রবিউল ইসলাম। 

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেল, ২০১৮ সালে প্রথম দফার ডিপিপিতে সড়কের পাশে ৩৬৫০টি গাছ লাগাতে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছিল। আর ২০২২ সালে এসে সংশোধিত প্রস্তাবে গাছের সংখ্যা কমিয়ে খরচের অঙ্ক ১৩ গুণ বেশি চাওয়া হয়েছে।

‘কেন’? প্রশ্ন করলে প্রকল্পটির পরিচালক (পিডি) কেডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোরতোজা আল মামুন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আগে শুধু গাছের দাম হিসেবে ১৭০ টাকা দেওয়া হয়েছিল। এখন ভালো মানের ঔষধি গাছ ও পরিচর্যার খরচসহ ২ হাজার টাকা করে ধরা হয়েছে।’

স্থানীয় নার্সারিগুলোর দামের হিসাব জানিয়ে যুক্তি তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশন যত টাকা অনুমোদন দেবে, তা দিয়েই কাজ করা হবে।’ বুঝতে বাকি থাকল না, এখানে ‘চুরির আয়োজন’ করা হয়েছে ভালোভাবেই। কারণ প্রকল্পের প্রায় সবগুলো কাজের ক্ষেত্রেই বাজার-বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি খরচ চাওয়া হয়েছে। 

আগের ডিপিপিতে ২৩০ মিটার রিটেইনিং ওয়াল (ঠেস দেয়াল) নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছিল ৪৫ লাখ টাকা। অথচ সংশোধিত ডিপিপিতে ৫১৫ মিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মিটার ওয়াল নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। খরচ বাড়ানো হয়েছে সাড়ে আট গুণ। 

জলাশয়ের পাড়ে মাটি থেকে রিটেইনিং ওয়াল তুলতে এত বেশি খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে মোরতোজা আল মামুন বলেন, ‘লেকের পাড়ে আরসিসি ঢালাই দিয়ে দেয়াল নির্মাণ করা হবে। আপনি না দেখলে বুঝবেন না। আগে একটা ব্যয় ধরা ছিল, এখন তো কাজও বেড়েছে। তাই এই খরচ লাগবে।’

‘ওই জলাশয়ের পাড়ে ঢালাইসহ ৫১৫ মিটারের রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে কত খরচ পড়তে পারে’ এমন প্রশ্ন করলে গণপূর্ত অধিদপ্তর খুলনা জোনের সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু হিসাব-নিকাশ করে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ওখানে ঢালাইসহ ৫১৫ মিটার রিটেইনিং ওয়াল বানাতে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা হলেই হবে।’ 

‘সবচেয়ে ভালো মানের কাজ করলে এই ব্যয় সর্বোচ্চ কত হতে পারে’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বাজারেও কোনোভাবেই দেড় কোটি টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়।’

সংশোধিত ডিপিপি ঘেঁটে দেখা যায়, খুলনা শহরের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ২০১৮ সালের ২২ মে ৩৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সাতক্ষীরা সড়ক ও সিটি বাইপাস সড়ককে সংযুক্ত করে সংযোগ সড়কসহ তিনটি লিংক রোড নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। জুলাই ২০১৮ থেকে ডিসেম্বর ২০২০ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। পরে ব্যয় ঠিক রেখে এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত প্রকল্পটি অনুমোদনহীন রয়েছে। গত চার বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ। কিছু জমি অধিগ্রহণ ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এখন আবার প্রকল্পের কিছু কাজ কমিয়ে বাড়িয়ে মোট খরচ দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে ৮২৩ কোটি টাকা চেয়ে জুন ২০২৫-এর মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য সংশোধিত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ নতুন করে ১০৯ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়ে আরও ৪২৮ কোটি টাকা এবং আরও সাড়ে তিন বছর সময় চাওয়া হয়েছে।

শুধু তা-ই না, মূল ডিপিপিতে ১৬টি সেতু ও কালভার্ট নির্মাণে ১৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। কিন্তু সংশোধিত ডিপিপিতে সেতু-কালভার্ট মাত্র ৩টি যুক্ত করে খরচ ৭৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৯৫ কোটি ৫ লাখ চাওয়া হয়েছে। মূল ডিপিপিতে ৪ হাজার ১০০ মিটার ফুটপাত কাম ড্রেন নির্মাণে ১১ কোটি ৭২ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল; অথচ কাজ কমিয়ে এখন ২ হাজার ১৫০ মিটার ড্রেনের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ১৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ১ হাজার ৯৫০ মিটার কাজ কমলেও খরচ বেড়েছে ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

আবার মূল ডিপিপিতে স্থাপনার ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩৪ কোটি ২২ লাখ টাকা রাখা হয়েছিল। কিন্তু সংশোধিত ডিপিপিতে সেটা বাড়িয়ে ৮২ কোটি ২৮ লাখ টাকা করা হয়েছে। আগে ৪ লাখ ১ হাজার ৮৬৭ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়নে ৩৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হলেও সংশোধিত ডিপিপিতে কিছু কাজ বাড়িয়ে ৫ লাখ ৮৪ হাজার ৫৬৪ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়নে ৭৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রেও ব্যয় বেড়েছে ১০০ শতাংশেরও বেশি। পেভমেন্ট নির্মাণেও কাজ একটু বাড়িয়ে খরচ চাওয়া হয়েছে ১০০ শতাংশেরও বেশি। আবার সড়ক বিভাজন ও বিদ্যুতায়নের কাজ কমলেও সংশোধিত প্রস্তাবে খরচ চাওয়া হয়েছে প্রায় চার গুণ।

‘সংশোধনের বেলায় এত বেশি খরচ চাওয়ার যুক্তি কী?’— প্রশ্ন করলে প্রকল্প পরিচালক মোরতোজা আল মামুন বলেন, ‘মূল ডিপিপিতে যে ব্যয় ধরা ছিল, সেটা ২০১৪ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী। এরপর আরও দুটি রেট শিডিউল হয়েছে। এখন ২০২২ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী সংশোধিত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এজন্য খরচ বেশি মনে হচ্ছে।’

প্রকল্প পরিচালকের এই যুক্তি ধোপে টেকে কি না, যাচাই করার জন্য ২০১৮ এবং ২০২২ সালের রেট শিডিউলে কত শতাংশ ব্যয় বেড়েছে জানতে চাইলে পিডব্লিউডি ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মোসলেহ উদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, প্রতি রেট শিডিউলে আগের তুলনায় ১৫-১৬ শতাংশ ব্যয় বাড়ে। সেই হিসাবে ২০১৮ ও ২০২২ সালের রেট শিডিউলে ২০১৮ সালের তুলনায় সর্বোচ্চ ৩২ শতাংশ খরচ বেড়েছে। অথচ খুলনার এই প্রকল্পের বেলায় রেট শিডিউলের দোহাই দিয়ে গড়ে ১০০ শতাংশেরও বেশি খরচ বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে।

কেন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে এই ধরনের বিলম্ব এবং অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়, জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এগুলো কী উদ্দেশ্যে করে, সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা যোগসাজশ করে এই অতিরিক্ত ব্যয় অনুমোদন করে নেয়। জনগণের অর্থ লুটপাট করতেই এই আয়োজন। এটা যেন তাদের কাছে স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে।’

খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ডিপিপিতে লেখা আছে, ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত প্রকল্পটির ক্রমপুঞ্জীভূত আর্থিক অগ্রগতি ৭৯ কোটি টাকা বা ২০ শতাংশ এবং বাস্তব ভৌত অগ্রগতি ২৮ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত থাকায় এর পর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০২২ সালে নতুন রেট শিডিউল হবে এবং তারই আলোকে সংশোধন প্রস্তাব পাঠানো হবে, সেই আশায় প্রকল্পটি ২০২২ সাল পর্যন্ত অনুমোদনবিহীন পড়ে ছিল।

প্রকল্পের কাজ শুরু করতে দেরি হওয়ার বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক বলেন, ‘২০১৮ সালে অনুমোদন হলেই তো হবে না। আমাকে আগে জমি বুঝে পেতে হবে। জমি বুঝে পেতেই ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় লেগেছে। তখন দেখা যাচ্ছে ২০১৮ সালের রেট শিডিউল এসে গেছে। তখন কি ২০১৪ সালের রেট শিডিউলে ঠিকাদার কাজ করতে চাইবে? দুই বছর পর তো আমাকে অবশ্যই প্রকল্প সংশোধন করতে হবে। তা ছাড়া কাজ করা যাবে না। কেউ টেন্ডারে অংশ নেবে না। রেট শিডিউলের কারণেই প্রকল্প সংশোধন প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রথমে তো আমরা একটা প্রাথমিক ডিজাইন অনুযায়ী ডিপিপি দিয়েছিলাম। এখন ডিটেইল ডিজাইনসহ সংশোধিত ডিপিপি দেওয়া হয়েছে। এজন্য সবকিছুতে সময় ও খরচ বেড়েছে।’ 

প্রকল্পটিতে অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের পরিকল্পনা উইংয়ের যুগ্ম সচিব রফিকুল আলম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা বেশ কিছু খাতে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে বলে প্রশ্ন তুলেছি। তারা যে রেট শিডিউল দিয়েছে, সেখানেও কিছু ভুল আছে। সব বিষয়ে পিইসি সভায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে।’


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা