× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

এক জেলাতেই এত ঋণখেলাপি!

জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:২৪ পিএম

আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:৩৫ পিএম

এক জেলাতেই এত ঋণখেলাপি!

চট্টগ্রামের শীর্ষ ৫৪ ব্যবসায়ী ও শিল্প গ্রুপের কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা ৪৬ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। এই টাকা আদায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেনাদার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আদালত থেকে খেলাপিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এরপরও পাওনা পরিশোধ করছে না তারা, রহস্যজনক কারণে গ্রেপ্তারও হচ্ছে না।

এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ব্যাংকে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। ব্যবসায়িক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নতুন করে ঋণও নিয়েছে ব্যাংক থেকে। কিন্তু পরিশোধ হয়নি পুরোনো দায়। এক দশকের ব্যবধানে দেশের এমন বেশ কয়েকজন ঋণখেলাপি এখন প্রবাসী। তাদের কেউ দুবাই, কেউবা আবার সপরিবার কানাডার নাগরিক বনে গেছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে রেখেছে ব্যাংক। তবে আইনি জটিলতায় দীর্ঘমেয়াদি হয়ে পড়ছে আদায় প্রক্রিয়া। অন্যদিকে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন ওপরতলার এই ঋণখেলাপিরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যারা ঋণ পরিশোধ না করে বিদেশে গেছেন, তারা সবাই ইচ্ছাকৃত খেলাপি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দেখেও দেখছে না। প্রভাবশালী এসব ঋণখেলাপিকে ধরতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োজন।

এক-তৃতীয়াংশই চট্টগ্রামের 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ব্যাংক খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ১৪ শতাংশ পেয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। কিন্তু মোট খেলাপির এক-তৃতীয়াংশই এই বিভাগের গ্রাহকদের দায়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের তথ্য বলছে, ৫৪ খেলাপি গ্রাহকের কাছে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের বর্তমান পাওনা ৪৬ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার ওপর। যাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে রয়েছে আদালতের রায়। কেউ আদালতে পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন, কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন, কেউ কেউ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টায় রয়েছেন।

বিভিন্ন ব্যাংকে এক হাজার কোটি টাকার ওপর খেলাপি রয়েছে এমন চট্টগ্রামভিত্তিক গ্রাহক ১৬ জন। যাদের কাছে সুদে-আসলে এখন ব্যাংকের পাওনা ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

১০ ব্যাংকে খেলাপি ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড এখন ১০টি ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহক। এক হাজার কোটি টাকার ওপর তাদের দেনা। সোনালী, ব্যাংক এশিয়া, ন্যাশনাল ব্যাংকসহ সবগুলো ব্যাংকই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

এ বিষয়ে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের জি এম (কমার্শিয়াল) শাহেদুল বাশার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘২০১০ সালের দিকে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আমাদের কোম্পানি ক্ষতির মুখে পড়ে। সেই সময় ঋণগুলো খেলাপি হয়ে গেলেও পরে আবার পরিশোধও করা হয়েছে। তবে এরই মধ্যে সুদের পাহাড় জমে মূল ঋণের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। এখন যে ঋণ দেখা যাচ্ছে সেগুলো মূলত সুদের বোঝা। তবে কোম্পানির পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। আশা করি, সহসাই ঋণখেলাপি সমস্যার সমাধান হবে।’

বাগদাদ গ্রুপ

চট্টগ্রামভিত্তিক আর একটি কোম্পানি বাগদাদ গ্রুপ। সুদে-আসলে এখন এর দেনা এক হাজার কোটি টাকার বেশি। বাগদাদ গ্রুপের কর্ণধার চট্টগ্রামের রাউজানের ফেরদৌস খান আলমগীর। চট্টগ্রামের মাঝিরঘাটে সারের ব্যবসা শুরু করার পর একপর্যায়ে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় আসেন ফেরদৌস খান আলমগীর ও তার আরও দুই ভাই তানভীর খান আলমগীর ও আজাদ খান আলমগীর। বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, এই গ্রুপের চেয়ারম্যান এখন সপরিবার কানাডাপ্রবাসী।

ইলিয়াস ব্রাদার্স গ্রুপ

ইলিয়াস ব্রাদার্স গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ ইলিয়াসের মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে আসেন নুরুল আবছার ও সামসুল আলম। ব্যবসা সম্প্রসারণে নিতে থাকেন একের পর এক ব্যাংকঋণ। কিন্তু ব্যবসায় তখন শুরু হয়েছে ভাটার টান। নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় নাম ওঠে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প গ্রুপের। শেষ দিকে প্রতিষ্ঠানের হাল ধরার চেষ্টা করেন ইলিয়াসের নাতি শোয়েব রিয়াদ। নতুন কিছু প্রকল্পে বিনিয়োগও করেন তিনি। কিন্তু এতটুকুও কমেনি ঋণের বোঝা। সব মিলিয়ে লোকসানের ধাক্কায় এখন অস্তিত্বসংকটে ‘ইলিয়াস ব্রাদার্স’।

শোয়েব রিয়াদ বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের সময় আমাদের ব্যবসার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে আস্তে আস্তে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি আমরা। ব্যাংকের সঙ্গেও ঋণ সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে। আমরা আশা করি, সব দেনাই পরিশোধ হয়ে যাবে। তবে কিছুটা সময় লাগবে।’ তিনি বলেন, ‘এখন আমি এডিবল ওয়ের কোম্পানির দায়িত্বে আছি। বাকিগুলো পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আমি এখন এটা নিয়েই কাজ করছি।’ পতেঙ্গায় গ্রুপের একটি অবকাঠামো এখন ভাড়া দিয়ে রেখেছেন বলেও নিশ্চিত করেন শোয়েব।

মিশম্যাক, সিলভিয়া গ্রুপসহ আট প্রতিষ্ঠান 

মিজানুর রহমান শাহিন ও মজিবুর রহমান মিলন দুই ভাই। চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার বাসিন্দা। দুই ভাই মিলে প্রতিষ্ঠা করেন একের পর এক প্রতিষ্ঠান। তাদের উদারহস্তে ঋণ দেয় বিভিন্ন ব্যাংক। প্রধানত মিশম্যাক, সিলভিয়া গ্রুপসহ মোট আট প্রতিষ্ঠানের নামে নয়টি ব্যাংক থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দুই ভাই দীর্ঘদিন ধরে উধাও। সুদে-আসলে সেই ঋণ এখন দুই হাজার কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করেছে। ব্যাংক তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের নেওয়া সব ঋণই এখন খেলাপি। জানা গেছে, তাদের একজন এখন আছেন কানাডায়, অন্যজন সিঙ্গাপুরে। ব্যাংকগুলো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না।

সাদ মুসা গ্রুপ

চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সাদ মুসা গ্রুপকে ঋণ দিয়ে আদায় করতে পারছে না এক ডজনেরও বেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অনিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগ, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, ফান্ড ব্যবস্থাপনার অভাব, করপোরেট সংস্কৃতি চর্চার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ডুবতে বসেছে সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবসা। দেশের ১৪ ব্যাংক ও তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাদ মুসা গ্রুপকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণ দিয়ে এখন আর উদ্ধার করতে পারছে না। ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা রয়েছে গ্রুপটির বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোহসীন বলেন, ‘আমরা ঋণগুলো শোধ করার চেষ্টা চালাচ্ছি। প্রতিষ্ঠান কখনও নিয়মিত, কখনও অনিয়মিত হওয়ার মধ্যে আছে। আশা করি, এ বছরের মধ্যে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে। জনগণের আমানতের টাকা পরিশোধ করেই মরতে চাই।’ ঋণ ঘাড়ে নিয়ে মানসিক অশান্তির মধ্যে রয়েছেন বলেও জানান তিনি।

হাবিব গ্রুপ

চট্টগ্রামের পুরোনো শিল্পপরিবারগুলোর একটি হাবিব গ্রুপ। কিন্তু গ্রুপটি এখন একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপি। সুদে আসলে সেই ঋণের পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কিন্তু মালিককে খুঁজে পাচ্ছে না ব্যাংক।

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম মহানগরীর জুবিলী রোডের লাভ লেনে অবস্থিত হাবিব গ্রুপের করপোরেট অফিসে গিয়ে গ্রুপের কর্ণধার ও রিজেন্ট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলী, ইয়াসিন আলী, পরিচালক সালমান হাবিব, তানভীর হাবিব ও মাশরুর হাবিব কাউকে পাওয়া যায়নি। রিসিপশনিস্ট বলেন, ‘তারা এখন বিদেশে থাকেন। অনলাইনে মিটিংগুলোতে যুক্ত হন। এর বেশি কিছু জানি না।’

ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল

চট্টগ্রামের অপর শিল্প গ্রুপ ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল। ডজনখানেক ব্যাংকের কাছে দুই হাজার কোটি টাকার ওপর দেনা এ গ্রুপের। একাধিকবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি, এখনও খেলাপিই তারা। ব্যাংকে দেওয়া গ্রুপের হেড অফিসের ঠিকানা ৬৫৯ ম্যাক গার্ডেন, পশ্চিম খুলশী আবাসিক এলাকা, ১ নং রোড, পাহাড়তলীতে গিয়ে গ্রুপটির কোনো খোঁজ মেলেনি। এলাকার মানুষও এ নামের অফিসের বিষয়ে কিছুই জানেন না।

হারুনুর রশিদ গ্রুপ

হারুনুর রশিদ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রুবাইয়া ভেজিটেবল। তাদের ব্যাংকঋণ এখন সুদে-আসলে দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যার পুরোটাই খেলাপি। টাকা আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলাও হয়েছে। ব্যাংকের কাছে দেওয়া গ্রুপের হেড অফিসের ঠিকানা ফারুক চেম্বার শেখ মুজিব রোড, চট্টগ্রামে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভবনের পাহারাদার জানান, তারা অনেক আগেই এই ভবন ছেড়ে চলে গেছে। তাদের কাছে এখনও দুই-তিন লাখ টাকা ফ্লোর ভাড়া পাওনা আছে। তারা সে টাকা না দিয়ে চলেই গেছে। ফ্লোরটিতে অন্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অফিস বসেছে।

সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের পরিচালক হাসনাইন হারুনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর রাতে ২৪টি সিআর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও ১০টি সিআর সাজা পরোয়ানামূলে হালিশহর থানা পুলিশের একটি টিম হাসনাইন হারুনকে গ্রেপ্তার করে।

মেসার্স সিদ্দিক ট্রেডার্স

চট্টগ্রামের মেসার্স সিদ্দিক ট্রেডার্সের কর্ণধার আবু সাঈদ চৌধুরী সম্রাট। ঋণখেলাপি মামলায় তাকে ও তার স্ত্রীকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। ওয়ান ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার দায়ের করা মামলায় ২৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত এ আদেশ দেন। তথ্যমতে, ২০১৫ সালের আগপর্যন্ত ছিদ্দিক ট্রেডার্সের কাছে ১৪টি ব্যাংকের পাওনা ছিল ৮৯০ কোটি টাকা। এখন সুদে-আসলে তা দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এদিকে টাকা আদায়ের জন্য মামলা করেছে সবগুলো ব্যাংক।

আরএসআরএম

একসময়ে রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডকে (আরএসআরএম) বিবেচনা করা হতো দেশের প্রথম সারির ইস্পাত ব্র্যান্ড হিসেবে। কিন্তু একাধিক ব্যাংকের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ডুবতে বসেছে কোম্পানিটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়িক ভুল পরিকল্পনা, অসৎ উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ ও ঋণ ব্যবহারের কারণে আরএসআরএম ইস্পাত খাতের ব্যবসা যেমন হারিয়েছে, তেমনি অর্থ তছরুপ এবং ঋণের টাকা অপ্রদর্শিত খাতে বিনিয়োগের কারণে অন্তত ১০টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেও বিপদে ফেলেছে।

আরএসআরএমের কাছে শুধু জনতা ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকেরই পাওনার পরিমাণ সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের পাওনা ১ হাজার ২০৪ কোটি টাকা ও সোনালী ব্যাংকের ৬৭৬ কোটি টাকা। যা আরএসআরএম গ্রুপের মোট খেলাপি ঋণের ৭৫ শতাংশের বেশি।

চট্টগ্রাম টেকনিক্যাল কলেজের উল্টো পাশে (মুরাদপুর) অবস্থিত আরএসআরএমের করপোরেট অফিসের ভবনটির এখন নাজুক অবস্থা। চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ভবনটির এক পাশ ভেঙে ফেলেছে। সরেজমিনে ভবনের নিচতলায় দেখা মেলে দুই সিকিউরিটি গার্ডের। তারা জানান, এখন এখানে কেউ আসেন না। কখনও কখনও এমডি আসেন। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকেন না। 

রাইজিং গ্রুপ

চট্টগ্রামের একসময়ের জাহাজ ভাঙা শিল্পের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ‘রাইজিং গ্রুপ’। গ্রুপটির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কনফিডেন্স সুজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে সবশেষ ১৭০ কোটি টাকার মামলা করে বেসিক ব্যাংক। এতে গ্রুপটির কাছে ১৯ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এই পাওনা আদায়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩০টি মামলা করেছে।

ব্যাংকে দেওয়া ঠিকানা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত বিএসইসি সদন (দ্বিতীয়তলা) গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব মেলেনি। সেখানে রয়েছে এসোসিয়েটেড অক্সিজেনের অফিস। যেখানে কাজ করেন দুই থেকে তিনজন কর্মকর্তা। তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাইজিং গ্রুপের মূল অফিস আসলে ছিল ফৌজদারহাট। তবে সেখানেও তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন না। অনেক আগেই ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে।

ইমাম গ্রুপ

ইমাম গ্রুপের মোহাম্মদ আলীর মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে দেশের ১৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আড়াই হাজার কোটি টাকা পাওনা আটকে আছে। ঋণের এ অঙ্ক সুদ ও আসলের সামষ্টিক রুপ। খেলাপি ঋণ আদায় ও চেক ডিজঅনার হওয়ায় গ্রুপটির বিরুদ্ধে ৬০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। এ ছাড়া ১০টিরও বেশি চেক ডিজঅনার মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড হয় তার।

সম্প্রতি অর্থঋণ আদালতের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন ইমাম গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে আলী ইমাম। তবে সেই রিট বাতিল করে দেন আদালত। রায়ে উল্লেখ করা হয়, ২০১২ সালে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মো. আলী, তার স্ত্রী ও সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করে আইএফআইসি ব্যাংক। ব্যাংকটিতে ৬১ কোটি টাকার ঋণখেলাপি তারা। দীর্ঘদিন মামলা চলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ জানুয়ারি তাদের পাসপোর্ট জমা দেওয়ার ও অনুমতি ছাড়া দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত। কিন্তু এর আগেই মোহাম্মদ আলী ও তার স্ত্রী জেবুন নাহার বিদেশে পালান। কিন্তু দেশে রয়ে গেছেন তাদের ছেলে আলী ইমাম। আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি বিদেশে যেতে পারেননি। তবে জানুয়ারিতেই অর্থঋণ আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন আলী ইমাম। গত ৪ আগস্ট বিচারপতি জেবিএম হাসান ও রাজিক আল জলিলের দ্বৈত বেঞ্চ তার রিট বাতিল করে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের রায় বহাল রাখেন।

তথ্যমতে, চট্টগ্রাম আদালতের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী একজন। ২০টির বেশি মামলায় তার গ্রুপের কাছে দেড় হাজার কোটি টাকার ওপরে পাওনা রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। শীর্ষস্থানীয় ঋণখেলাপিরা বিদেশে পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।

ব্যাংকে দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী আন্দরকিল্লায় অবস্থিত ফাহিম ম্যানশনের পাঁচতলায় ইমাম গ্রুপের হেড অফিসে গিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার মতো কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাচ দিয়ে তিনটি ছোট ঘরে বিভক্ত ক্ষুদ্র অফিসটিতে সাত-আটজন কর্মী বসেন। তাদের মধ্যে একজন রুহুল আমিন সিদ্দিক। তার দরজার সামনে লেখা পরিচালক (অ্যাডমিন)। তিনি বলেন, ব্যাংকঋণ বিষয়ে কথা বলার জন্য অফিসে কেউ নেই। তাদের এমডি চেয়ারম্যানের খোঁজ তারাও জানেন না। আরেক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘এটাই আমাদের হেড অফিস।’

মোস্তফা গ্রুপ 

চট্টগ্রামসহ সারা দেশের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় একচেটিয়া ব্যবসা করত মোস্তফা গ্রুপসহ হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখন বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এদের ঋণের বোঝা আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। খেলাপি টাকা আদায় না হওয়ায় শতাধিক মামলাও হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭টি মামলায় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

ব্যাংকে দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, খাতুনগঞ্জের রহমান চেম্বার থেকে প্রতিষ্ঠানটি গুটিয়ে নিয়েছে অফিস। নিরাপত্তাপ্রহরী জানান, এখন এটা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা। এ ছাড়া এখানে হেফাজতুর রহমান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি ব্রোকার হাউস পরিচালিত হয়। তিনি জানান, মোস্তফা গ্রুপের মূল অফিস এখন আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকাতে। সেখানে গিয়ে কোম্পানির কার্যক্রম লক্ষ করা গেলেও কেউ কথা বলেননি। তারা জানান, ব্যাংকঋণ বিষয়ে কথা বলার জন্য অফিসে কেউ নেই। তা ছাড়া এমডি-চেয়ারম্যানও চট্টগ্রামের বাইরে।

নূরজাহান গ্রুপ

একসময়ের ভোগ্যপণ্য ব্যবসার অন্যতম প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামভিত্তিক নূরজাহান গ্রুপ। ভোজ্যতেল, গম, মসলাসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা এতদিন আধিপত্যের সঙ্গে করলেও গত কয়েক বছর গ্রুপটির ব্যবসা সংকুচিত। গ্রুপটির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশান থেকে নূর জাহান গ্রুপের পরিচালক টিপু সুলতানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরদিন চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থানা পুলিশ তাকে আদালতে সোপর্দ করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নূরজাহান গ্রুপের চেয়ারম্যান জহির আহম্মদের সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এসএ গ্রুপ

চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী এসএ গ্রুপের ব্যাংকঋণের অবস্থাও একেবারে খারাপ। ভোগ্যপণ্য খাতে খেলাপি হওয়া বড় শিল্প গ্রুপগুলোর মধ্যে এসএ গ্রুপ শীর্ষে রয়েছে। গ্রুপটির কাছে ১৮ ব্যাংকের পাওনা পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আলম। এ গ্রুপের প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে। মুসকান ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল, আটা, ময়দা, সুজি, বোতলজাত পানি এবং গোয়ালিনি ব্র্যান্ডের মিল্ক পাউডার ও কনডেন্সড মিল্কের উৎপাদক ও সরবরাহকারী এসএ গ্রুপ। এ ছাড়া আবাসনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে তাদের ।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা