× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

গুরু অপরাধে লঘু দণ্ড

ফসিহ উদ্দীন মাহতাব

প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:৫০ পিএম

আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:০৬ পিএম

সচিবালয়। ফাইল ফটো

সচিবালয়। ফাইল ফটো

মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তারা একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করে সমালোচনার জন্ম দিচ্ছেন। নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অনাকাঙ্ক্ষিত কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। এসব ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিভাগীয় মামলাও হচ্ছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন তারা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লঘু দণ্ড হিসেবে বদলি, ভাতা হ্রাস ও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রাখা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কঠোর শাস্তি না হওয়ায় মাঠপ্রশাসনে প্রতিনিয়ত এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। 

অভিযোগ আছে, স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা বা এমপিদের অনুগত হওয়া কিংবা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য থাকায় মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের শাস্তি হয় না। গত কয়েক বছরে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছোট সাজা দিয়ে মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার নজির আছে। কেউ কেউ পদোন্নতিও পেয়েছেন। যেমন মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় আলোচিত কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনকে শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। উল্টো তাকে পদোন্নতি দিয়ে বদলি করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাঠপ্রশাসনে কয়েকজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে গোটা প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় যা ঘটেছে, তা একেবারেই কাম্য নয়। এসব ঘটনার দ্রুত নিষ্পত্তি করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। না হলে জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হবে এবং সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের অভিমতমাঠপ্রশাসনে কাজ করতে হলে পরিপক্ব কর্মকর্তাকে ইউএনও নিয়োগ দিতে হবে। কারণ উপজেলা পর্যায়ে নির্বাহী প্রধানকে এলাকার ক্ষমতাবানদের মেজাজ বুঝে কাজ করতে হয়। অল্প বয়সে স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাহী প্রধান হলে শিষ্টাচার সম্পর্কে তার ধারণা থাকা উচিত। 

প্রশাসনের শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, অনেক ঘটনা গণমাধ্যমে না এলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে যায়। এগুলো ভাইরাল হয়ে সরকারকে বিব্রত করে।

তারা বলেন, যে-ই অন্যায় বা দুর্নীতি করুক, আইন সবার জন্য সমান। কাজেই সবাইকে নিজ কর্মস্থলে কথায়, কাজে, আচরণে দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রশাসনিক কার্যক্রম একটি জটিল বিষয়। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নির্বাচনী দায়িত্ব, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, ভেজালবিরোধী অভিযান, সরকারি সম্পত্তির অবৈধ দখলমুক্তকরণ, জটিল তদন্ত কার্যক্রম, চোরাচালান দমন ইত্যাদি কার্যক্রম পালন করতে হয়। এগুলো করতে গিয়ে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী মহলের সঙ্গে বিরোধ বাধে। এসব ক্ষেত্রে মাথা গরম না করে ধৈর্যের সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করাই ভালো। স্বচ্ছ মাঠপ্রশাসন গড়তে হলে কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে বলেও মত দেন তারা। 

মাঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, শৃঙ্খলা ও দুর্নীতিজনিত ১৫ হাজার ৫৭টি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা বিভাগে জমা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মোট অভিযোগ ৯৫৩টি। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভাগীয় মামলা হয়েছে ৭৭টি। এর মধ্যে ৪৫টি নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০২১-২২ বছরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট রিট মামলা ৪ হাজার ৮২০টি। এর মধ্যে জনপ্রশাসনের ৩৩টি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন সংযুক্ত দপ্তর বা সংস্থার মামলা ৪১টি এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ২৯৯টি। এর আগের বছরগুলোর অনিষ্পন্ন মামলা রয়েছে ৫ হাজার ৮৩৯টি। এর মধ্যে লিভ টু আপিল ১১৩টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে লিভ টু আপিল হয়েছে ১৩টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি এবং এর আগে ছিল ৯৮টি। রিভিউ পিটিশন মামলা আগে ছিল ৬টি। গত দুই বছরে হয়েছে ৬টি। কন্টেম্পট পিটিশন (কেন রায় বাস্তবায়ন হলো না) আগে ছিল ৩২৩টি, গত দুই বছরে হয়েছে ৩৯টি। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা আগে ছিল ১৮০টি। বর্তমানে তা বেড়ে ২০৬টি হয়েছে। প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলা আগে ছিল ১৯টি। বর্তমানে হয়েছে ৩১টি। লিভ টু আপিল মামলা আগে ছিল ১৯টি। বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ২৩টি। 

আচরণবিধিতে যা আছে : সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার ২৭ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারী সংকীর্ণতা, প্রিয়তোষণ, বেআইনিভাবে ক্ষতিগ্রস্তকরণ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ আর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২ (২)-এ উল্লেখ আছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সরকারের কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি তো বটেই, সেই সঙ্গে সংবিধানেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে প্রশাসন-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

ছাগলে ফুল খাওয়ায় জরিমানা : নিজ কার্যালয়ের বাগানে ‘ছাগলে ফুল খাওয়ার অপরাধে’ মালিককে দুই হাজার টাকা জরিমানা করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ইউএনও সীমা শারমীন। তার এমন কাণ্ডে হতবাক হয়েছিল পুরো দেশ। অবলা প্রাণীর ফুল খাওয়ার দায়ে তার মালিককে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সরকার ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন মহলকেও লজ্জায় ফেলেছিলেন তিনি।

আপা সম্বোধন করায় মা বলে ডাকার নির্দেশ : কুমিল্লার বুড়িচংয়ের ইউএনও সাবিনা ইয়াছমিনকে ‘আপা’ সম্বোধন করায় তিনি স্থানীয় এক ব্যবসায়ীকে ‘মা’ বলে ডাকতে বলেন। এ ছাড়া মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের ইউএনও রুনা লায়লাকে ‘স্যার’ না বলে ‘আপা’ বলায় পুলিশ দিয়ে এক ব্যবসায়ীকে পেটানোর খবরও বেশ আলোচিত হয়েছিল। 

চার কর্মকর্তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড : বান্দরবানের আলীকদমের ইউএনও মেহরুবা ইসলাম ফুটবল খেলার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলের ট্রফি বিতরণ না করে সবার সামনে আছড়ে ভেঙে ফেলেন। এমন কাণ্ডের পর ওই কর্মকর্তাকে তিরস্কার না করে উল্টো তাকে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। বগুড়া সদরের ইউএনও সমর কুমার পালের বিরুদ্ধে অভিযোগতিনি এলজিইডির চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছেন। কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ইউএনওর বিরুদ্ধে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অমিত দত্ত নিজ অফিসের দুই কর্মচারীকে মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে।

এ ছাড়া নিজের স্ত্রীকে যৌতুকের জন্য মারধর করা, একাধিক বিয়ে, পরনারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক থাকার অভিযোগ এনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সারোয়ার সালামের বিরুদ্ধে মামলা করেন স্ত্রী। সেই মামলার বিচারকাজ মহানগর হাকিম আদালতে চলমান থাকলেও ওই কর্মকর্তা নরসিংদীতে এখনও কর্মরত আছেন।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য : এসব বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যখন বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়, তখন তার অপরাধটা কী, তা শুনানির মাধ্যমে জানার চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনায় গঠিত কমিটি সরেজমিনে যায়। এরপর যখন দোষী সাব্যস্ত হয়, তার অপরাধের ধরন (গ্রাভিটি অব ক্রাইম) বা অনিয়ম (ইরেগুলারিটিস) যেটা আসে, সেটা অনুযায়ী গুরু বা লঘু শাস্তি দেওয়ার দুটি বিধান আছে।

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, একজন কর্মকর্তা তার ওপর ন্যস্ত রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করেন। তারপরও কাজ করতে গিয়ে কোনো ভুল করতেই পারেন। কেমন ভুল হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নেয়। 

অপরাধ করে চাকরিতে বহাল থাকা ঠিক না : সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে মানুষ বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আসবে, আসাটাই স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা যাবে না। এগুলো কোনো শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। চাকরিবিধিতেও এসব বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা আছে। বিভিন্ন সময় অপরাধ করেও সরকারি চাকরিতে বহাল থাকা ঠিক না।

তিনি বলেন, চাকরিবিধি অনুসারে দোষী হলে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। সংশোধন না হলে বিভাগীয় যে সিদ্ধান্ত আছে, সেভাবেই কঠোর হাতে তা দমন করতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, দিনশেষে সবারই জনগণের কথা ভেবে কাজ করতে হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা