৮০তম জন্মদিনে রাষ্ট্রপতি
মধ্যাঞ্চলীয় ব্যুরো
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৩ ১০:৩৯ এএম
আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:১১ পিএম
রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। ফাইল ফটো
আজ ১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের ৮০তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে তিনি তার ৬০ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি বলেছেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য ত্যাগী ও সুশিক্ষিত প্রজন্মকে কাজে লাগাতে হবে। নতুন প্রজন্মকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা না গেলে, প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানে সমৃদ্ধ করতে না পারলে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের গতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। তিনি কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞাননির্ভর বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গড়ে তোলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন।
জন্মদিন উপলক্ষে শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেন রাষ্ট্রপতি। তিনি শারীরিকভাবে খুব একটা ভালো নেই। কিছুদিন ধরে ঘাড়ের ব্যথাসহ বেশকিছু শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। নিজের শারীরিক সুস্থতার জন্য দেশবাসীর দোয়া কামনা করেছেন রাষ্ট্রপতি। বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ে তিনি বলেন, পদ কখনও স্থায়ী নয়। পদ পেয়ে আত্মম্ভরিতায় ভুগলে এবং জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করলে তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন, একসময় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। রাজনীতি হচ্ছে জনসেবার ব্রত। যারা জনসেবা এড়িয়ে চলেন তারা নেতা হতে পারেন না, হয়ে যান রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী তার বিচক্ষণ নেতৃত্বের মাধ্যমে গত ১৪ বছরে দেশে অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন করেছেন।
এ ধারা অব্যাহত রাখা প্রতিটি সচেতন নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, দুই বছরের করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধজনিত বৈশ্বিক সংকটের সময়ও বর্তমান সরকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে যেভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে, তা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। আজকের রাজনীতিকদের এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে বলে দৃঢ়তার সঙ্গে জানান রাষ্ট্রপতি।
কিশোরগঞ্জে রাষ্ট্রপতির ৮০তম জন্মদিন পালনের আয়োজন করা হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন ও জেলার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রপতির জন্মদিন পালন উপলক্ষে জেলা শহরে সাজসাজ রব বিরাজ করছে।
আবদুল হামিদের জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত হাওর উপজেলা মিঠামইনের কামালপুর গ্রামে। মাটি ও মানুষের নিবিড় ভালোবাসায় ছায়া-সুশীতল প্রকৃতির স্নিগ্ধতা নিয়ে জন্মেছিলেন হাওরবেষ্টিত অজপাড়াগাঁয়ের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। হাওরের উদারতায় বেড়ে উঠেছেন এই অসাধারণ ভূমিপুত্র। নিতান্ত ছেলেবেলা থেকেই বিপন্নের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে সব সময় পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রিয় স্বজনের মতো।
বাংলাদেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। তার বাবা হাজী মো. তায়েবউদ্দিন এবং মা তমিজা খাতুন। স্থানীয় কামালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু। এরপর ভৈরবে কেবি স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। নিকলী উপজেলার গোড়াচাঁদ হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস। কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করে ঢাকার সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে কিশোরগঞ্জ বারে আইন পেশায় যোগ দেন আবদুল হামিদ। তিনি জেলা বারের পরপর পাঁচবারের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতা কখনও দেশের কল্যাণ আনতে পারে না। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সব অচলাবস্থা দূর করার জন্য তিনি পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে গণমুখী কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এর জন্য প্রতিটি নাগরিককে দেশপ্রেম ও সততা নিয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও একশ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকের চরিত্রে পরিবর্তন না এলে সব অর্জন বিফলে যাবে। তাই তিনি সবাইকে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত হাওর এলাকায় জন্ম নিয়েও তিনি ষাটের দশকের প্রথমার্ধে বঙ্গবন্ধুর মতো মহান রাজনীতিকের স্নেহস্পর্শ পেয়েছেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় পাকিস্তানি দুঃশাসকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলনে শরিক হয়ে কারাভোগ করেছেন। শত প্রতিকূলতা ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দুঃসময়েও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আঁকড়ে থেকেছেন তিনি। কখনও কোনো হুমকি বা লোভের কাছে পরাভূত হননি। তার এই নিঃস্বার্থ ত্যাগের কারণেই রাজনীতিতে সর্বোচ্চ সম্মান ও মূল্যায়ন পেয়েছেন বলে তিনি মনে করেন।
পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সারা দেশে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তখন সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে ১৯৬৪ সালে ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে মো. আবদুল হামিদ ছাত্ররাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সে সময় রাজনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার একের পর এক আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে থাকেন। ছাত্ররাজনীতির সুবাদেই একসময় তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য লাভ করেন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত আগ্রহে মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি দুর্গম হাওর এলাকার সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তদানীন্তন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের (ময়মনসিংহ-১৮) সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং একজন সংগঠক ও সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতের মেঘালয় রিক্রুটিং ক্যাম্পে এবং তৎকালীন সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (মুজিব বাহিনী) সাব-সেক্টরের কমান্ডার পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালের তথাকথিত নির্বাচন বাদে তিনি তার এলাকা থেকে একাদিক্রমে সাতবার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে বিজয়ী হন। তিনি মানুষকে অতি সহজেই কাছে টানতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্য পাওয়ার কারণে তার চরিত্রে বঙ্গবন্ধুর অনেক গুণের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তিনি মাঠপর্যায়ের একজন সাধারণ কর্মী কিংবা সাধারণ মানুষকেও দীর্ঘদিন পর নাম ধরে ডাকতে পারেন। তার এই গুণের কারণে জেলার সকল শ্রেণির মানুষের কাছে তিনি অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হন।
স্বাধীনতার পরপরই মোঃ আবদুল হামিদ নিজের প্রজ্ঞার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে সজ্জন রাজনীতিক ও ভাটির শার্দূল হিসেবে অভিহিত হন। জিয়া সরকারের মন্ত্রিত্ব গ্রহণের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করায় ১৯৭৬ সালে তাকে কারাবরণ করতে হয়। কারাগারে নিয়েও স্বৈরশাসক তাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও পথ থেকে সরাতে পারেনি। সেই নিপীড়ন ও অটল বিশ্বাসের যথার্থ মূল্যায়নও পেয়েছেন তিনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহে জননেতা মোঃ আবদুল হামিদ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। পরে তিনি একই সংসদে স্পিকারের দায়িত্ব পান।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে এলে মোঃ আবদুল হামিদ বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের নবম সংসদে আবারও তিনি স্পিকার হন। দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর মোঃ আবদুল হামিদ বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব লাভ করেন। ২০১৮ সালে তার ২০তম রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হলে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২১তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি লাভ করেছেন স্বাধীনতা পুরস্কার।