প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:৫৮ পিএম
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ২২:০২ পিএম
বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ। ফাইল ছবি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ স্বেচ্ছায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। গত ৪ নভেম্বর সুলতানা কামাল ব্রিজের ওপর থেকে রাত ২টা ৩৪ মিনিট ২১ সেকেন্ডে ঝাঁপ দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর পানিতে পড়ে যান তিনি। রাত ২টা ৩৫ মিনিট ৯ সেকেন্ডে ফারদিনের মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়।
বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) রাতে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন এমন তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
ঘটনার একমাসেরও অধিক সময় তদন্ত শেষে এসব তথ্য জানিয়েছে বাহিনীটি।
তিনি বলেন, ‘ফারদিন নূর পরশ নিহত হওয়ার ঘটনায় র্যাব তার পারিবারিক সূত্র, অধিকতর তথ্য প্রযুক্তির বিশ্লেষণ, সিসিটিভি ফুটেজসহ স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রের আলোকে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে। এ সংক্রান্ত যেসব এভিডেন্স রয়েছে তা আমরা মামলার তদন্তকারী সংস্থার হাতে তুলে দিয়েছি।’
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গত ৪ নভেম্বর বিকাল ৩টায় রাজধানী ডেমরার কোনাপাড়া নিজ বাসা থেকে পরীক্ষার কথা বলে বুয়েটের হলের উদ্দেশে বের হয় ফারদিন। বিকাল আনুমানিক ৫টার দিকে ফারদিন সায়েন্স ল্যাব মোড়ে তার পরিচিতার সাথে দেখা করে। এরপর সেখান থেকে নীলক্ষেত ও ধানমন্ডিসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে। পরবর্তীতে সাত মসজিদ রোডে একটি রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা করে।’
তিনি বলেন, ‘রাত আনুমানিক ৮টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসহ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে তারা। এরপর রিকশাযোগে রামপুরার যায়। রাত পৌনে ১০টার দিকে রামপুরা ব্রিজ এলাকায় ফারদিন রিকশা থেকে নেমে যায় এবং কিছুক্ষণ রামপুরা ব্রিজ এলাকায় ঘোরাফেরা করে। প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পরবর্তীতে তিনি কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, বাবুবাজার ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা, পুরান ঢাকার জনসন রোড, গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট এলাকায় গমন করেন।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায় যে, রাত ২টা ১মিনিটে (সিসিটিভি ফুটেজ টাইম ২টা ৩ মিনিট ) যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচা থেকে ফারদিনকে লেগুনায় উঠতে দেখা যায়। রাত আনুমানিক টা ২০ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের অপর পাশে তারাবো বিশ্বরোডের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় লেগুনা থেকে নেমে যায় ফারদিন। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে জানা যায় যে, রাত ২টা ২৬ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের তারাবো প্রান্তে ফারদিনের অবস্থান ছিল। এরপর রাত ২টা ৩৪ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের প্রায় মাঝখানে আসে ফারদিন।’
তিনি বলেন, ‘ব্রিজের তারাবো প্রান্ত থেকে সুলতানা কামাল ব্রিজের মাঝখান পর্যন্ত দূরত্ব আনুমানিক ৪০০-৫০০ মিটার। রাত ২টা ৩৪ মিনিট ৯ সেকেন্ডে সুলতানা কামাল ব্রিজের রেলিং ক্রস করে ফারদিন এবং রাত ২টা ৩৪ মিনিটে ১৬ সেকেন্ডে সুলতানা কামাল ব্রিজের উপর থেকে স্বেচ্ছায় নদীতে ঝাঁপ দেয়। ঝাঁপ দেওয়ার পর রাত ২টা ৩৪ মিনিট ২১ সেকেন্ডে শীতলক্ষ্যা নদীর পানিতে পড়ে ফারদিন। রাত ২টা ৩৫ মিনিট ৯ সেকেন্ডে ফারদিনের মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও রাত ২টা ৫১ মিনিটে ফারদিনের হাতের ঘড়িতে পানি ঢুকে অকার্যকর হয়ে পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ, ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টসহ অন্যান্য সকল সংশ্লিষ্ট আলামত বিবেচনায় নিয়ে আমাদের তদন্তে বের হয়ে আসে যে, বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন স্বেচ্ছায় সুলতানা কামাল ব্রিজ হতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করে। তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ফারদিনের মৃত্যু সংক্রান্ত অন্য কোন সূত্র বা আলামত পাওয়া গেলে, তবে তা বিবেচনায় নিয়ে মামলার বিজ্ঞ তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।‘
এর আগে ১৭ নভেম্বর ফারদিনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেয় নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে বলা হয়, আঘাতজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। মাথায় ও বুকের পাঁজরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। মূলত মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলেই ফারদিনের মৃত্যু হয়।
ওই দিন দুপুরে ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালের আরএমও শেখ ফরহাদ এই ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন জেলা সিভিল সার্জনের কাছে জমা দেন।
সিভিল সার্জন এএফএম মশিউর রহমান বলেন, ‘ফারদিনকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তার বুকের দুপাশে দুই-তিনটি ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন আমরা পেয়েছি। পাশাপাশি তার মাথায় চার-পাঁচটি আঘাতের চিহ্ন ছিল। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘তার মাথায় যে আঘাতের কথা বলা হচ্ছে সেটা কতোটুকু নিশ্চিত সে ব্যাপারে কিছু বলব না। তবে ঝাঁপ দেওয়ার সময় সে পিলারের কাছেই পড়েছে।
মাদক কারবারিরা তাকে হত্যা করতে পারে এমন তথ্য র্যাব ও ডিবি শুরুর দিকে জানিয়েছিল।
তখন কোন তথ্যের ভিত্তিতে এ কথা বলা হয়েছিল এমন প্রশ্নের জবাবে মঈন বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আমরা পেয়েছিলাম চনপাড়ার আশপাশের স্থানে ফারদিনের অবস্থান ছিল। সেসময় বিভিন্ন সাংবাদিকরাও সেখানে গেছেন কাজ করেছেন। কেউ হয়ত তাকে চনপাড়ায় নিয়ে হত্যা করতে পারে। বিভিন্ন সময় মাদক কারবারিরা অনেককে ধরে নিয়ে চনপাড়ায় ফিডিং দিয়েছে, মালামাল লুট করেছে। চনপাড়ার আশপাশে ফারদিনের লোকেশন ছিল বলে সেখানে আমরা কাজ করেছি। তবে আমরা কখনই বলিনি ফারদিন মাদকাসক্ত ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘ফারদিনের মৃত্যু রহস্য নিয়ে আমরা অনেক কাজ করেছি। যার যার সঙ্গে কথা বলা দরকার-ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ, অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। আমাদের ফাইন্ডিংস আমরা তদন্তকারী সংস্থাকে জানিয়েছি।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘ডাক্তারের বক্তব্য নিয়ে কোনো কথা বলব না। ফারদিনের যে ড্রেসআপ ছিল, ঘড়ি ছিল, মোবাইল ছিল সবই ঠিক ছিল। ডেডবডির সঙ্গে এসব থাকায় অনেক কিছু বোঝায় যে, অন্তত ছিনতাইকারী তাকে খুন করেনি। মাথা, বুকে আঘাতের চিহ্ন অনেক কারণে হতে পারে। আমরা কনক্লুসিভ নিয়ে গত দুই-তিন দিন ধরে কাজ করছি। আমরা মনে করি ডিবি তদন্ত করছে। তারা কনক্লুশন জানাবেন।’
সিসি ক্যামেরায় যা দেখা গেছে, দূর থেকে লাফ দেয়া ব্যক্তির সঙ্গে ফারদিনের চেহারার মিল পেয়েছেন কি না, কীভাবে বলছেন কেউ ব্রিজ থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলেনি- এমন প্রশ্নের উত্তরে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘দূরের সিসিটিভি ফুটেজ। চেহারা বোঝার উপায় নাই। সময়, পারিপার্শ্বিক তথ্য উপাত্ত, মোবাইল বন্ধ হওয়া, ঘড়ি বন্ধ হওয়া, যেখান থেকে নামছে সেখান থেকে লাস্ট লোকেশন পর্যন্ত দূরত্ব, তদন্তকারী সংস্থাসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করেছি, স্বেচ্ছায় ফারদিন ব্রিজ থেকে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।’
গত ৪ নভেম্বর নিখোঁজ হন বুয়েট ছাত্র ফারদিন। পরের দিন ৫ নভেম্বর তার বাবা নূরউদ্দিন রানা রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ৭ নভেম্বর ফারদিনের মরদেহ শীতলক্ষ্যা থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় রামপুরা থানায় মামলা করেন ফারদিনের বাবা। এই মামলায় ফারদিনের বান্ধবী আয়াতুল্লাহ বুশরা কারাগারে আছেন।