জরিপ
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৫ ১৭:০৪ পিএম
আপডেট : ১৯ জুন ২০২৫ ১৭:১১ পিএম
বাংলাদেশের সরকারি সেবা খাতে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনেরও বেশি নাগরিক দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন—এমন উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস) ২০২৫’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বিকেলে রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিবিএস এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-এর ১৬ নম্বর অভীষ্টের ছয়টি সূচক মূল্যায়নে সারাদেশের ৬৪ জেলায় জরিপটি পরিচালিত হয়। এতে ১ হাজার ৯২০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিটের (PSU) আওতায় ৪৫ হাজার ৮৮৮টি খানার ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী ৮৪ হাজার ৮০৭ জন নারী-পুরুষ অংশ নেন।
জরিপ অনুসারে, ৩১.৬৭ শতাংশ নাগরিক সরকারি সেবা গ্রহণে ঘুষ বা দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। পুরুষদের মধ্যে এই হার ৩৮.৬২ শতাংশ, যা নারীদের ২২.৭১ শতাংশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দুর্নীতির শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ), যেখানে ৬৩.২৯ শতাংশ নাগরিক ঘুষ বা দুর্নীতির সম্মুখীন হওয়ার কথা জানিয়েছেন। এরপর যথাক্রমে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (৬১.৯৪ শতাংশ), পাসপোর্ট অফিস (৫৭.৪৫ শতাংশ) ও ভূমি অফিস (৫৪.৯২ শতাংশ)।
নিরাপত্তা, সুশাসন ও মতপ্রকাশের অধিকার
জরিপে দেখা যায়, নাগরিকদের বেশিরভাগই নিজ এলাকায় নিরাপদ বোধ করেন। সন্ধ্যার পর একা চলাফেরায় ৮৪.৮১ শতাংশ নাগরিক নিরাপত্তাবোধের কথা জানান। যদিও পুরুষদের (৮৯.৫৩ শতাংশ) তুলনায় নারীদের (৮০.৬৭ শতাংশ) মধ্যে এই হার কম। শহরাঞ্চলে নিরাপত্তাবোধের হার ৮৩.৭৫ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ৮৫.৩০ শতাংশ। নিজেদের বাড়িতে সন্ধ্যার পর নিরাপদ বোধ করেন ৯২.৫৪ শতাংশ নাগরিক।
তবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। মাত্র ২৭.২৪ শতাংশ নাগরিক মনে করেন তারা সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে মুক্তভাবে মতামত দিতে পারেন। পুরুষদের মধ্যে এই হার ৩১.৮৬ শতাংশ হলেও নারীদের মধ্যে তা মাত্র ২৩.০২ শতাংশ। রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে; মাত্র ২১.৯৯ শতাংশ নাগরিক মনে করেন তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবার মূল্যায়ন
সরকারি স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে নাগরিকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। গত এক বছরে ৪৭.১২ শতাংশ নাগরিক এই সেবা গ্রহণ করেছেন। তাদের ৮২.৭২ শতাংশ সেবাকে সহজপ্রাপ্য এবং ৮৯.৩৪ শতাংশ ব্যয়কে গ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন। তবে চিকিৎসার মান, স্বাস্থ্যকর্মীদের সময় দেওয়া ও আচরণের ক্ষেত্রে সন্তুষ্টির হার যথাক্রমে ৬৫.০৭ শতাংশ, ৬৩.১৩ শতাংশ ও ৬৩.১৯ শতাংশ—যা সেবার মান উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
শিক্ষাখাতেও অনেক নাগরিক সন্তুষ্ট। ৪০.৯৩ শতাংশ নাগরিক জানিয়েছেন, তাদের পরিবারের অন্তত একটি শিশু সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে। প্রাথমিক স্তরে ৯৬.৪৬ শতাংশ নাগরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহজ প্রবেশাধিকার এবং ৯২.৬৬ শতাংশ শিক্ষাব্যয়কে সহনীয় মনে করেন। তবে মাধ্যমিক স্তরে এই হার কিছুটা কম (৮২.২০ ও ৮০.৮৬ শতাংশ)। মানসম্পন্ন শিক্ষার বিষয়ে সন্তুষ্টির হার প্রাথমিক পর্যায়ে ৬৭.৯৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৭১.৮৬ শতাংশ।
অন্যান্য সেবা ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া
পরিচয়পত্র ও নাগরিক নিবন্ধনের মতো প্রশাসনিক সেবায় ৭৮.১২ শতাংশ নাগরিক প্রাপ্তিযোগ্যতায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ব্যয় সন্তোষজনক মনে করেন ৮৬.২৮ শতাংশ। তবে কার্যকারিতা, সময়মতো সেবা পাওয়া ও সমতাভিত্তিক আচরণে সন্তুষ্টির হার তুলনামূলকভাবে কম—৬২.৬০ শতাংশ, ৫১.২৮ শতাংশ ও ৫৬.২৬ শতাংশ।
বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ ও বৈষম্য
গত দুই বছরে ১৬.১৬ শতাংশ নাগরিক কোনো না কোনো বিরোধের সম্মুখীন হয়েছেন। এদের মধ্যে ৮৩.৬০ শতাংশ বিচারপ্রক্রিয়ার আওতায় আসতে পেরেছেন। আনুষ্ঠানিক (আদালত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) ব্যবস্থার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করেছেন ৪১.৩৪ শতাংশ, আর অনানুষ্ঠানিক (কমিউনিটি নেতা, আইনজীবী) ব্যবস্থায় নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৮.৯৬ শতাংশ।
গত এক বছরে ১৯.৩১ শতাংশ নাগরিক কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্য বা হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন। শহরে এর হার ২২.০১ শতাংশ, গ্রামে ১৮.০৭ শতাংশ। বৈষম্যের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে পরিবার (৪৮.৪৪ শতাংশ), গণপরিবহন বা উন্মুক্ত স্থান (৩১.৩০ শতাংশ) এবং কর্মক্ষেত্র (২৫.৯৭ শতাংশ)। তবে মাত্র ৫.৩৫ শতাংশ ভুক্তভোগী তাদের অভিজ্ঞতা কোনো প্রতিষ্ঠানে রিপোর্ট করেছেন।
জরিপ অনুযায়ী, সিপিএস ২০২৫-এর তথ্য জাতিসংঘের গ্লোবাল কাস্টডিয়ান সংস্থা UNDP, UNODC এবং OHCHR-এর নির্দেশনা অনুযায়ী সংগৃহীত ও বিশ্লেষিত। এতে নাগরিকদের গোপনীয়তা ও মতামতের মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার ও প্রশাসনিক কাঠামোয় নীতিনির্ধারণের জন্য এই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।