তানভীর হাসান
প্রকাশ : ১৭ জুন ২০২৫ ০৯:৪৫ এএম
আপডেট : ১৭ জুন ২০২৫ ১৭:৩৭ পিএম
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বছর না পেরোতেই পুরনো রূপে ফিরে যাচ্ছে দেশের কারাগারগুলো। টাকার বিনিময়ে মাদক সেবন থেকে শুরু করে অবাধে মিলছে মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ। ৮৮টি নেটওয়ার্ক জ্যামারের মধ্যে ৭৮টি বিকল থাকায় বন্দিরা লুকিয়ে মোবাইলে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে বলে দাবি করেছেন কারা কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, আদালতে হাজিরা শেষে কারাগারে ফেরার সময় মাদক ও মোবাইল ফোন নিয়ে আসছে বন্দিরা। কারাফটকের তল্লাশিতে প্রায়ই তাদের ধরা হলেও অনেকে চোখ ফাঁকি দিচ্ছে। এই নিয়ে যন্ত্রণায় পড়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগারের ভেতরে বন্দিদের অপরাধ রোধ করতে নানা কৌশল নিয়েও হিমশিম খেতে হচ্ছে। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এসব তথ্য। এমন পরিস্থিতিতে সবকটি কারাগারে জ্যামার বসানোসহ নানামুখী পরিকল্পনা নিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। আগামী ছয় মাসের মধ্যে নতুন জ্যামার স্থাপনসহ এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে বলে কারা অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, কারাগারে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলাকারী সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সুজনের গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। কীভাবে তিনি আত্মহত্যা করলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইতোমধ্যে ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও আলাদাভাবে বিষয়টি মনিটরিং করছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। তা ছাড়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় কারাগার থেকে পালানো সন্ত্রাসী, জঙ্গিসহ প্রায় ৭০০ অপরাধীর হদিস না মেলায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা কর্তৃপক্ষ। তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে সরকারের হাইকমান্ড। ওইসব বন্দির ছবিসহ নাম ও ঠিকানা সবকটি বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সাবেক চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সুজন গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ‘সকালে তিনি নাশতা করেছেন। এরপরই কক্ষে ফাঁস দেন।’ কীভাবে এ ঘটনা ঘটল, তা খতিয়ে দেখবে কমিটি। সেইসঙ্গে মোবাইলে কথা বলা কারাগারে জ্যামার বসানোরও পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া অনিয়ম রোধে আরও কিছু পরিকল্পনা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আদালত থেকে হাজিরা শেষে বন্দিদের কারাগারে আনার সময় তারা মাদক ও মোবাইল ফোনসেট নিয়ে আসছে। ধারণা করা হচ্ছে, মাদক সিন্ডিকেটের সদস্যরা আদালত থেকে তাদের মাদক সরবরাহ করছে। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়েছে। কারণ আসামি আনা-নেওয়া ও আদালতের গারদখানার দায়িত্বে তারাই থাকেন। তারপরও কারা ফটকে আসামি আসার পর তাদের তল্লাশি করে ভেতরে ঢোকানো হয়। সেখান তাদের কাছে মাদক পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগের। এ বিষয়ে কারাগারের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে হাসিনা সরকারের পতনের পর কারাগারগুলোর অবস্থা বেশ পরিবর্তন হয়েছিল। খাবারের মান এবং নিয়ম-শৃঙ্খলার অনেকটা উন্নত হওয়ায় বন্দিরাও বেশ আশ্বস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু গত কয়েক মাসে ধীরে ধীরে সেই পুরনো হ-য-ব-র-ল অবস্থায় ফিরে যেতে শুরু করেছে দেশের অধিকাংশ কারাগার। নিষিদ্ধ থাকার পরও এখন দেশের সবকটি কারাগারেই দেদারসে মোবাইল ফোনে কথা বলছে বন্দিরা। মাদক কারবারসহ অন্যান্য অপরাধও হচ্ছে কৌশলে। এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কারা কর্মকর্তা ও কারারক্ষী বন্দিদের কাছ থেকে ‘সুবিধা’ নিয়ে অপকর্ম চালানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, জ্যামার না থাকার কারণে বন্দিরা মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারছে। এমনকি বাইরে থেকেও তাদের মোবাইল ফোনে কল আসে বলে তথ্য মিলেছে।
বর্তমানে দেশে ৬৯টি কারাগার রয়েছে। এগুলোর ধারণক্ষমতা ৪২ হাজারের কিছু বেশি। ৫ আগস্টের পর ৫০ হাজারের কিছু বেশি বন্দি ছিল। তারপর কারাবন্দির সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে কারাবন্দি রয়েছে ৬৫ হাজারের বেশি। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬৯টি কারাগারের মধ্যে ১৭টি কারাগার অনেক পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কারাগার দ্রুত সংস্কার, মেরামত ও পুনর্নির্মাণ না করলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। ৫ আগস্ট ও পরবর্তী সময়ে ২২ শতাধিক কারাবন্দি পালিয়ে গেছে। তার মধ্যে অনেকে স্বেচ্ছায় ফিরে আসেন। আবার অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৫০০ জন ধরা পড়েছে। এখনও ৭০০ বন্দির হদিস মিলছে না।
অন্যদিকে গত কয়েক মাসে জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ১৭৪ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছে।এ ছাড়া বিভিন্ন আলোচিত মামলার আসামি ও জঙ্গি সদস্যের মধ্যে এখনও পলাতক ৭০ জন। এদের মধ্যে প্রায় তিন বছর আগে ঢাকার সিএমএম আদালতে শুনানি শেষে প্রিজন ভ্যানে তোলার আগ মুহূর্তে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেলকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। এই দুই জঙ্গিকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ করে টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে সারা দেশে রেড এলার্ট জারি করে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়েরের পর তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশাল ইউনিট। ঘটনার তদন্তে মন্ত্রণালয় ও পুলিশের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন করা হয়। দুই কমিটিই তদন্তের এক পর্যায়ে দেখতে পায়, কারাগারে বসেই জঙ্গিরা মোবাইল ফোনে তাদের সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলত। এখনও তাদের ধরা সম্ভব হয়নি।
কারা সূত্র জানায়, বেশিরভাগ কারাগারেই জ্যামার থেকেও না থাকার অবস্থা দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় কারাগারে ৮৮টি জ্যামার থাকলেও ৭৮টি বিকল হয়ে আছে। ওইসব জ্যামার সচল করার পাশাপাশি নতুনভাবে স্থাপন করতে সম্প্রতি কারা অধিদপ্তরকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অভিযোগ উঠেছে, মোটা অঙ্কের অর্থ পেয়ে জ্যামারগুলো বিকল করে রাখে অসাধু কারারক্ষীরা। কারা এসব অপকর্ম করছেÑ তা বের করতে কাজ করছে গোয়েন্দারা।
সূত্র আরও জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কশিমপুর পার্ট-১ ও ২, নারায়ণগঞ্জ জেলা ও হাইসিকিউরিটি কারাগারে ৮৮টি জ্যামার বসানো হয়। ওই যন্ত্র দিয়ে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু মাত্র ৪ বছরের মাথায় এসব যন্ত্র্রের মধ্যে ৭৮টি নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬টি সচল রয়েছে। হাই সিকিউরিটি কারাগারে দুটি ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় দুটি জ্যামার সচল রয়েছে। কিন্তু তাও নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহার হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
কারাগারের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কারাগার হবে সংশোধনাগার’Ñ এমন স্লোগানের কারণে কারাগার থেকে বন্দিদের স্বজনদের সঙ্গে সপ্তাহে এক দিন কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। আর ওই সময়ে বন্ধ রাখা হয় জ্যামার। আর এই সুযোগে কিছু অসাধু কারারক্ষী বন্দিদের অন্য মোবাইলে কথা বলার সুযোগ করে দেয়। পাশাপাশি অনেক বন্দি তাদের কক্ষেই মোবাইল ফোন রাখার অভিযোগ রয়েছে। হেভিওয়েট হওয়ার কারণে অনেক সময় তাদের কক্ষ তল্লাশি করার সাহস দেখায় না কারা কর্তৃপক্ষ। বিনিময়ে তারাও বাড়তি সুবিধা নিয়ে থাকেন।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, অসাধু ও অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে আইনি সংস্কারের উদ্যোগও। পাশাপাশি বন্দি ব্যবস্থাপনা অধিকতর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ২৪ ঘণ্টা হটলাইন সেবা চালু ও কারা অভ্যন্তরে মাদক রোধে ঝুঁকিপূর্ণ কারাগারগুলোতে ডগ স্কোয়াড মোতায়েন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
কারাগারে আনার পর সব বন্দিকে শ্রেণি বা নির্ধারণপূর্বক প্রকৃতি অনুযায়ী নির্ধারিত ওয়ার্ড, সেল এলাকায় পাঠানো হয়। বিশেষ বন্দিদের ওয়ার্ড, সেলে মোবাইল ফোন জ্যামার স্থাপন করাসহ সিসি ক্যামেরা দ্বারা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিদিন কয়েকবার তল্লাশি করা হয়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আদালতের আদেশ ছাড়াও সব ধরনের বিচারাধীন বন্দি প্রতি ১৫ দিনে এবং সাজাপ্রাপ্ত বন্দি ৩০ দিনে, আইনজীবীসহ একবারে পরিবারের সর্বোচ্চ পাঁচজন সদস্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন। প্রত্যেক বন্দিই প্রতি ৭ দিনে একবার আইনজীবীসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনটি নম্বরে ১০ মিনিটের জন্য কথা বলার সুযোগ পান। শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দিরা দিনে দুবেলা এবং অন্য বন্দি দিনে একবেলা আমিষ জাতীয় খাবার পান। ভেতরের ক্যান্টিনের পণ্যের দাম ন্যায্যতার সঙ্গে নির্ধারণসহ ক্যান্টিন সুবিধা সবার জন্যই উন্মুক্ত রাখা হয়েছে, তবে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষে মাসিক সর্বোচ্চ ব্যয় নির্ধারণ করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
পুলিশ সূত্র জানায়, মাস দুয়েক আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কারাগারের বিষয়ে কিছু সুপারিশ পাঠায়। সুপারিশে বলা হয়, কারাগারের নিরাপত্তাসহ বন্দিদের আদালতে আনা-নেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে কারা কর্তৃপক্ষকে। কারাগারের সর্বত্র সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং সেই সিসি ফুটেজ ছয় মাস থেকে এক বছরের ব্যাকআপের (সংরক্ষণের) ব্যবস্থা রাখতে হবে। কারাগারগুলোর প্রতিটি প্রবেশ দ্বারে ব্যাকআপসহ বডি ও লাগেজ স্ক্যানার স্থাপন করতে হবে; যাতে কেউ ইচ্ছা করলেই অবৈধ কোনো মালামাল বা মাদকদ্রব্য নিয়ে ঢুকতে না পারে। কারাগারের স্পর্শকাতর জায়গায় যেসব কারারক্ষী বা কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করবেন তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় সরকারি এজেন্সির মাধ্যমে যাচাই করতে হবে। ফাঁসির আসামি বা দুর্ধর্ষ বন্দির বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত চিঠিপত্রের মাধ্যমে না করে ই-মেইল বা স্বীকৃত অন্য কোনো মাধ্যমে করতে হবে। আদালতের শুনানি কার্যক্রমে ফাঁসির আসামি বা দুর্ধর্ষ বন্দির ক্ষেত্রে শারীরিক উপস্থিতি অব্যাহতি দিয়ে ভার্চুয়ালি হাজিরার ব্যবস্থা করতে হবে। আসামিদের শুনানির ক্ষেত্রে আদালত চত্বরে সব ধরনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে একটি সেল গঠন করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চালাতে হবে।
কারাগারে চালু হলো হটলাইন নম্বর
কারাগারের যেকোনো তথ্য বা যোগাযোগের জন্য হটলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে। গতকাল সোমবার গণমাধ্যমে কারা অধিদপ্তরের পাঠানো খুদেবার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। হটলাইন নম্বরটি হলো ১৬১৯১। খুদেবার্তায় বলা হয়, এখন থেকে ১৬১৯১ হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করলে বন্দির সাক্ষাৎ, অবস্থান ও শাস্তি সম্পর্কে জানা যাবে এবং যেকোনো কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়েও তাৎক্ষণিক সাড়া (রেসপন্স) পাওয়া যাবে।