ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ১১ মে ২০২৫ ১৪:১৮ পিএম
বাংলাদেশ সচিবালয়। ফাইল ফটো
পদ-পদোন্নতিসহ চাকরি-সংক্রান্ত নানা বিষয়ে বিভিন্ন ক্যাডারের বিসিএস কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব থামছেই না। দীর্ঘদিনের এই দ্বন্দ্ব গণঅভুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অনেকটা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ফেসবুকে নিজেদের দাবির পক্ষে লেখালেখি করায় শাস্তিমূলক হিসেবে ১৩ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর প্রকট হয়ে ওঠে আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব।
প্রশাসনের বাইরের ক্যাডার কর্মকর্তারা যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করে বিভিন্ন দপ্তর ও অধিদপ্তরের প্রধান পদগুলো গ্রেড-১ এ উন্নীত করার দাবি জানান। অভিযোগ রয়েছেÑ এক্ষেত্রে অন্য ক্যাডারের পদোন্নতিতে বাদ সাধছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। একের পর এক শর্ত পূরণের অজুহাতে প্রস্তাবগুলো আলোর মুখ না দেখায় মাঠপর্যায়ে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা আন্দোলনে নামেন। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করেন প্রশাসনের বাইরের ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অতীতেও নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কার্যক্রম শুরু করে। এরই মধ্যে সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে প্রশাসন ও অন্যান্য ক্যাডারের মধ্যে দেখা দেয় প্রকাশ্য বিরোধ। সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের মত প্রকাশ করতে থাকেন অনেকেই।
চলতি বছরের মার্চ মাসে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিয়ে ২৫ ক্যাডার সংগঠনের সদস্যদের ফেসবুকে লেখালেখির কারণে ১৩ কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হন। এ ঘটনায় ২৫ ক্যাডার সংগঠনের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বৈষম্যপূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে ২৫ ক্যাডারের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) প্রাঙ্গণে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। সংখ্যার দিক দিয়ে অন্যতম বৃহৎ এই ক্যাডারের কর্মকর্তারা বৈষম্য নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এ বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘২৫ ক্যাডারের কিছু বিষয় নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। শিক্ষা ক্যাডার অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে।’
শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা অনেক বৈষম্যের শিকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করতে হবে। ক্যাডার সদস্যদের অনেকেই মামলা বা হয়রানির শিকার। এগুলোর একটি সুন্দর সমাধান আসা জরুরি।’
বর্তমানে উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ পদোন্নতি হয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত প্রশাসনিক সার্ভিসের (বর্তমান প্রশাসন ক্যাডার) ৭৫ শতাংশ কোটা কমিয়ে ৫০ শতাংশ করার কথা বলেছে। বাকি ৫০ শতাংশ পদ অন্যান্য সার্ভিসের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কিন্তু ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা চান এই কোটা উঠিয়ে উন্মুক্ত পরীক্ষায় সব ক্যাডার থেকে উপসচিব করা হোক। তবে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের ভাষ্য, চাকরিতে পছন্দক্রম দিয়ে যোগ্যতা অনুযায়ী ক্যাডার নির্ধারণ হয়। সেখানে মাঝামাঝি সময়ে এসে প্রশাসনের উচ্চতর পদে অন্যদের প্রবেশ যৌক্তিক হবে না।
সূত্র বলছে, বর্তমানে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীনে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডারে নিয়োগ হয়। প্রতিটি ক্যাডারের কাজের ধরন যেমন আলাদা, তেমনি পদ-পদোন্নতি এবং সুযোগ-সুবিধাও আলাদা।
তথ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্যাডারসহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অভিযোগÑ প্রশাসন, কর, পুলিশ, পররাষ্ট্রসহ হাতেগোনা কয়েকটি ক্যাডার কর্মকর্তারা পদোন্নতি এবং সুযোগ-সুবিধায় এগিয়ে। আর অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতিতে পিছিয়ে। বিশেষ করে পদোন্নতিতে তথ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা বেশি পিছিয়ে।
সম্প্রতি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে যে সুপারিশ দিয়েছে, তাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য পৃথক দুটি পিএসসির কথা রয়েছে।
ভুক্তভোগীদের মতে, মূলত পদোন্নতি এবং সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য থেকেই আন্তঃক্যাডারের দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। সেক্ষেত্রে যদি প্রতিটি ক্যাডারের পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধায় সমতা আনা হয়, তাহলে এই সমস্যা এমনিতেই কেটে যাবে।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের নেতারা বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারবহির্ভূত করার প্রস্তাব থেকে সরে এসে কৌশলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা রাখা হয়েছে। যেন ধীরে ধীরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে মূলধারা থেকে বের করা যায়। এছাড়া পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারের বিষয় সংস্কার প্রস্তাবে না রাখা এবং পরিসংখ্যান ক্যাডারকে অযৌক্তিকভাবে সার্ভিসের বহির্ভূত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর ফলে এসব সেক্টরে মেধাবীরা কম আকৃষ্ট হবেন। সেক্টরসমূহ মেধাশূন্য হয়ে পড়বে।
পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় (ক্যাডার যার, মন্ত্রণালয় তার) বাস্তবায়ন, উপসচিব পদে কোটাপদ্ধতি বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, সব ক্যাডারের সমতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারসহ সব ক্যাডারকে একই কমিশনের আওতায় রাখার পক্ষে নেতৃবৃন্দ গুরুত্বারোপ করেন।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক মুহম্মদ মফিজুর রহমান বলেন, ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনে ২৫টি ক্যাডারের পক্ষ থেকেই পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং উপসচিব পদে কোটা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সমাজের বিভিন্ন স্তর হতেও সিভিল সার্ভিসে পেশাদারত্বকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। অথচ জনদাবি উপেক্ষা করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ক্ষমতাধর একটি গোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আরও বৃদ্ধির প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। কমিশনের রিপোর্ট পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে এবং প্রশাসনিক ফ্যাসিজম আরও শক্তিশালী হবে।’