ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৫ ২৩:০৪ পিএম
আপডেট : ১১ মে ২০২৫ ১১:০৭ এএম
ছবি ফোকাস বাংলা
শনিবার সকাল ৭টা, পাঁচ তলার পূর্ব বারান্দায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়নি জিসান আহমেদের। সকালের সোনালী রোদ, যেখানে কিছুটা স্বস্তি থাকার কথা তার, তার বদলে গরমে উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে ঘরের টাইলস। বাহির থেকে ঠাণ্ডার বদলে ঢুকতে আগুনে পোড়ানো বাতাস। শুধু সকাল নয় বরং সারা দিনই বাতাস ছিল গরম। এর আগে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টায় একই ধরনের অবস্থার মুখোমুখি হন তিনি।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, শনিবার ঢাকার তাপমাত্রা ছিল রেকর্ডে সর্বোচ্চ। ২০০৪ সালে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮.১ ডিগ্রি, সেখান থেকে আজ ছিল ৪০.১; অর্থাৎ দুই দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
শুধু ঢাকা নয়, সিলেট, চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের ৬২টি জেলাতেই আজ মৃদু, মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ (আরিচা), পাবনা, যশোর ও চুয়াডাঙ্গাসহ ৯ জেলায় বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। আজ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রা মে মাসের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বুধবার থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বয়ে যাওয়া তাপ প্রবাহ আজ রবিবার পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টি হলে কিছুটা কমবে বলে প্রত্যাশা আবহাওয়া অধিদপ্তরের।
অধিদপ্তর জানিয়েছে, সোমবার ময়মনসিংহ ও সিলেটের কিছু কিছু জায়গায়, রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বিদ্যুৎ চমকানো, বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এতে সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা ১-৩ ডিগ্রি কমতে পারে।
তবে বৃষ্টি হলেও পুরোপুরি তাপপ্রবাহ শেষ হয়ে যাবে না বলে জানিয়েছেন, আবহাওয়াবিদ খন্দকার হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, কোথাও কোথাও তাপপ্রবাহ কিছুটা কমলেও একেবারে শেষ হয়ে যাবে না।
ঢাকায় ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ঢাকায় গত ২০ বছরের মধ্যে গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে ২০০৪ সালের হিসেব সংরক্ষিত রয়েছে। সেখানে দেখা যায় ২০০ ৪ সালে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৩৮.১ ডিগ্রি। ২০০৭ সালে তা কিছুটা কমে ৩৭.৫, ২০১৩ সালে ৩৭.১ এবং ২০১৭ সালে শুধু ৩৭ ডিগ্রি। এ বছরই প্রথম ঢাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ঘর ছাড়াল।
ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনের কারণ সম্পর্কে আবহাওয়া ও পরিবেশবিদ ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাছপালা কম থাকা, জলাশয় ভরাট, খোলা জায়গার স্বল্পতা। পাশাপাশি রয়েছে নতুন করে কাঁচে ঘেরা ভবনের কারণে।
এ ব্যাপারে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের আর্কিটেক্টচার বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান মোহাম্মদ জাকারিয়া ইবনে রাজ্জাক বলেন, ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিল্ডিং অন্যতম দায়ী। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দায় রয়েছে কাঁচে ঘেরা ভবনের। এখন বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ভবন ও কিছু ক্ষেত্রে আবাসিক ভবন তৈরি হচ্ছে কাঁচ দিয়ে। এই কাঁচ থাকার কারণে দুটি অবস্থা সৃষ্টি হয়। সূর্য তাপ কাঁচে পড়ার পর তা শহরে বা তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে আশপাশ এলাকা গরম হয়ে পড়ে। আবার বাইরে থেকে যে তাপ পড়ে সেটি ভবনের ভিতরেও যায়। তখন সেই তাপ বাইরে বের হতে পারে না। এতে ভিতরটাও গরম হয়ে উঠে। অর্থাৎ দুই দিকেই গরম করে। তবে এখন ডাবল গ্রেস বা ইউভি প্রটক্ট করে এমন কিছু কাঁচ বের হয়েছে তা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ঢাকায় এটির ব্যবহার বেশি নেই বললেই চলে।
তাছাড়া ঢাকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৬ এপ্রিল ২০২৩ সালে। এদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কেরর্ড করা হয় ৪০.৬ ও ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মে মাসের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর অনেক দেশেই উষ্ণতম মাস হিসেবে ধরা হয় এপ্রিল ও মে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উষ্ণতম হচ্ছে এপ্রিল। এ বছর এপ্রিলে মৃদু মানের তাপপ্রবাহ ছিল। তবে বিস্তৃর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছিল না। শনিবার পর্যন্ত তাপ প্রবাহ দেশের ৬২ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। তার মধ্যে ৯টি জেলায় তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। তারমধ্যে এই মে মাসে তাপপ্রবাহ বেশি। বিশেষ করে আজ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার আগে শুক্রবার ছিল ৪১.২ ডিগ্রি।
এ ব্যাপারে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ১৮ মে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। সেদিন রাজশাহীতে তাপমাত্রা ছিল ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রি, যা মে মাসের হিসেবে এটিই সর্বোচ্চ।
স্থানভেদে দেশে তাপমাত্রা বেড়েছে সাড়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস
এদিকে দেশে গত ৫ দশকে স্থানভেদে দেশে তাপমাত্রা কতটা বেড়েছে তা নিয়ে ২০২৪ সালে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব অটোয়া ‘এন আনসাস্টেইনেবল লাইফ: দ্য ইম্পেক্ট অব হিট অন হেলথ এন্ড দ্যা ইকোনোমি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে, বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তাপমাত্রা বেড়েছে সাড়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সার্বিকভাবে সারা দেশে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি।
গবেষণায় বাংলাদেশের এই উষ্ণতাকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণায় ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে সার্বিকভাবে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাওয়ায় মানব স্বাস্থ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
তাতে বলা হয়, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহ ইতিমধ্যেই অনেক দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় বলা হয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি বিশেষ করে বাংলাদেশ, তাপ-সম্পর্কিত রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। উচ্চ তাপমাত্রার সংস্পর্শে আসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে দক্ষিণাঞ্চলে। সেখানে তাপমাত্রা বেড়েছে ৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তরাঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ৪ দশমিক ৯ ডিগ্রি। আর রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। তারমধ্যে রাজধানী ঢাকা শহুরকে তাপ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী একটি হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শেষ বৈশাখে রংপুরে তাপদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন
রংপুর অফিস জানায়, শেষ বৈশাখে রংপুরে তাপদাহে অতিষ্ঠ হয়েছে জন-জীবন। সূর্যের উত্তাপে নাকাল মানুষ। প্রতি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না কেউ। নগরীতে ছাতা মাথায় চলাচল করতে দেখা গেছে পথচারীদের। তীব্র গরমে ভ্রাম্যমাণ দোকানে বেল, আখসহ নানা ফলের শরবত খেয়ে স্বস্তির ঢেকুর তুলেছেন তারা। তাপদাহের মাঝে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে হাতপাখার দোকানে ভিড় বেড়েছে। এদিকে গরমের কারণে শিশু-বৃদ্ধসহ নানা বয়সী মানুষ জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথাব্যাথাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায পুড়ছে চুয়াডাঙ্গা
চুয়াডাঙ্গা প্রতিবেদক জানান, ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায পুড়ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গা। গতকাল বিকেল ৩ টায় এ জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের আদ্রর্তা ছিল ১৬%।
বগুড়ায় একদিনের ব্যবধানে ভাংল সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড
বগুড়া অফিস জানায়, বগুড়ায় একদিনের ব্যবধানে এই মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছে। আজ তিনটায় জেলায় ৩৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি তাপমাত্রার রেকর্ড করা হয়। যা এই মৌসুমের এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। এর আগে শুক্রবার জেলায় ৩৯ ডিগ্রি তাপমাত্রার রেকর্ড করা হয়।২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছে।
যশোরে তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
যশোর প্রতিবেদক জানান, শনিবার দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুক্রবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৩৯ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এটি এবছরের যশোরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও ঘটে।
দক্ষিণাঞ্চলে রেলের তাপমাত্রা ৫০ ছাড়িয়েছে
কুমিল্লা প্রতিবেদক জানান, বৈশাখের গরম চারদিকে। দেশজুড়ে তীব্র দাবদাহে হাঁসফাঁস অবস্থা। কুমিল্লার তাপমাত্র টানা দুদিনই ৪০ ছুঁইছুঁই। তীব্র গরমে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের রেললাইনগুলোতে তাপমাত্রা গিয়ে ঠেকছে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি। এতে রেললাইন বেঁকে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই কুমিল্লাসহ দক্ষিণ অঞ্চলের রেল চলাচলে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে রেলের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষ। বিষয়টি জানিয়েছেন রেলওয়ে কুমিল্লার ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (পথ) লিয়াকত আলী মজুমদার।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রতিদিনের বাংলাদেশের বিভিন্ন অফিস ও জেলা প্রতিবেদক।