ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৫ ১৩:৪৭ পিএম
আপডেট : ০১ মে ২০২৫ ১৩:৫৬ পিএম
পঞ্চাশ পেরোনো সোনামণি কাহারের সাত সদস্যের পরিবার। থাকেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৮ নম্বর কালীঘাট ইউনিয়নের ফিনলে টি কোম্পানির ভাড়াউড়া চা বাগানে। বাগানে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ আছে এই পরিবারের মাত্র একজনের, মজুরি ১৭৮ টাকা। এ টাকা দিয়ে কীভাবে সংসার চলবে?
বাধ্য হয়ে বাগানের বাইরে ইট ভাঙার কাজ করছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ১২ থেকে ১৫ টিন (ফুট) ইট ভাঙেন। প্রতি টিন ইট ভেঙে পান ১০ টাকা। এতে দৈনিক আয় ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। শুধু সোনামণি নন, বাগানে কাজ না থাকায় চা শিল্পের অনেক অস্থায়ী বা অনিবন্ধিত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বিকল্প পেশা ঝুঁকছেন। কেউ মাটি কেটে, কেউ রাজমিস্ত্রির যোগালি বা সহকারী হয়ে, কেউ রিকশা চালিয়ে পরিবারের দুমুঠো অন্ন, সন্তানদের শিক্ষাসহ নানা খরচের জোগান দিচ্ছেন।
২০১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী দেশের চা শিল্পাঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠী অন্যূন ৭ লক্ষাধিক। তার মধ্যে নিবন্ধিত ১৬৭টি চা বাগানে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ জন। আর অস্থায়ী শ্রমিক ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন (তথ্যসূত্র : স্ট্যাটিস্টিক্যাল হ্যান্ডবুক অন বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রি)।
২০০৭ সালে প্রথম শ্রেণির চা বাগানগুলোতে নিবন্ধিত বা স্থায়ী শ্রমিকের মজুরি ছিল দৈনিক ৩২ টাকা ৫০ পয়সা, ২০০৯ সালে ৪৮ টাকা, ২০১৩ সালে ৬৯ টাকা, ২০১৫ সালে ৮৫ টাকা, ২০১৬ সালে ১০২ টাকা, ২০১৮ সালে ১২০ টাকা এবং বর্তমানে ১৭৮ টাকা।
প্রতিটি শ্রমিক পরিবার থেকে একজন স্থায়ী শ্রমিক হলে মাত্র ১৭৮ টাকা দৈনিক মজুরিতে সংসার চালানো শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব। ফলে বাধ্য হয়েই শ্রমিক পরিবারের অনেকে বাইরে কাজের সন্ধান করছেন।
মৌলভীবাজার শহরে রিকশা চালান রাজনগর চা বাগানের শ্রমিক সন্তান দিলীপ তাঁতী। তিনি বলেন, ‘আমার মা বাগানের স্থায়ী শ্রমিক। আমি বাগানের অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতাম। এখন বাগানে কাজ না থাকায় রিকশা চালাই।’
ভুরভুরিয়া চা বাগানের লক্ষী চাষা বলেন, ‘আমার পরিবারে সদস্য ছয়জন। বাগানে কাজ নেই। তাই ইট ভাঙার কাজ করি।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলার জাগছড়া চা বাগানের অস্থায়ী শ্রমিক গনেশ মুড়া, খাইছড়া চা বাগানের অস্থায়ী শ্রমিক পূজন ভূঁইয়া, রানা ভূঁইয়া, সাজু ভূঁইয়া, সুমন চাষা বলেন, বাগানে যেটুকু কাজ আছে তার তুলনায় স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। তাই বাগানে কাজ পাওয়া যায় না। তারা বলেন, বাগানে অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যা মজুরি মেলে তার থেকে বাইরে কাজের মজুরি অনেক বেশি।
বাংলাদেশ চা জনগোষ্ঠী আদিবাসী ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী পরিচালক চা শ্রমিক নেতা পরিমল সিং বাড়াইক বলেন, ‘দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় চা শ্রমিক জনগোষ্ঠী অনেক পিছিয়ে। চা শ্রমিকরা যুগের পর যুগ নিপীড়ন ও বঞ্চনায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।’
দেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে চা শ্রমিকদের যোজন যোজন ফারাক বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘চা বাগানের কমপক্ষে ৯০ শতাংশ শ্রমিকরা দিন এনে দিন খান। দৈনিক মাত্র ১৭৮ টাকা মজুরিতে সংসার চলে না। প্রতিটি পরিবার থেকে একজন বা দুজন বাগানে কাজ পেলেও বাকিরা থেকে যান বেকার।’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রাম ভজন কৈরি বলেন, ‘চা বাগানের শ্রমিকদের কাজের জন্য বাগান ছেড়ে বাইরে যাওয়ার একমাত্র কারণ বাগানের কাজ করে যে মজুরি পাওয়া যায় তা দিয়ে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার পূরণ হচ্ছে না। শ্রমিক পরিবারের সন্তান যারা শিক্ষিত হচ্ছে তাদের কর্মসংস্থান বাগানে হচ্ছে না। চা শিল্পাঞ্চলের দেড় শতাধিক বছর পেরিয়ে গেলেও শ্রমিকদের ভূমির অধিকার নেই। প্রতিটি শ্রমিক পরিবারে ৪ থেকে ৮ জন সদস্য হলেও বাগানে কাজ পাচ্ছেন এক বা দুজন। ফলে একান্ত বাধ্য হয়ে তারা বাগানের বাইরে দিনমজুরের কাজ করছেন।’